Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমনের বাম্পার ফলনেও হতাশ কৃষক

| প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চলছে রোপা আমন ধান কাটার উৎসব। ধানের বাম্পার ফলনের ধারাবাহিক সাফল্য দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় অবদান রাখছে যদিও খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণতা অর্জনকে নিজেদের কৃতিত্ব হিসেবে দাবী করছে সরকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ বিষয়ে অনেক আলোচনা ও লেখালেখি হলেও কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতে সরকারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ধানের মূল্যে ধস নামার কারণে বগুড়ার আদমদীঘি ও সান্তাহারে ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত কৃষক পরিবারগুলো বাম্পার ফলনেও গভীর হতাশায় ভুগছে। ধানের উচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে কৃষকদের যে পরিমান আর্থিক বিনিয়োগ ও শ্রম দিতে হয়েছে, বিনিয়োগের ন্যায্য মুনাফা দূরের কথা, বর্তমান বাজারমূল্যে উৎপাদন খরচও উঠছে না।এমনকি গতবারের বাজার মূল্যের চেয়েও মনপ্রতি দুই থেকে তিনশ টাকা কমে এবার ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কৃষক। যেখানে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশী হওয়াকে অবশ্যই ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে হবে। কৃষকের উৎপাদন খরচ এবং নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উপর ভিত্তি করেই চালের মত নিত্যপণ্যের বাজার মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালনে সরকার বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে।
ধানের উৎপাদন খরচ ও বিক্রয় মূল্যে সমন্বয়হীনতার কারণে একদিকে যেমন দেশের ধানচাষীরা লোকসান দিতে দিতে ধানচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, অন্যদিকে চালের মূল্য কমে যাওয়ার কারণে চাতাল ও মিলাররাও কোটি কোটি টাকা লোকসান দিতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানা যায়। খুচরা বাজারে চালের মূল্য এখন স্থিতিশীল ও সহনীয় থাকলেও দেশের কৃষক এবং রাইসমিলগুলো লোকসানের পেছনে রয়েছে দেশের কৃষক ও মিলারদের স্বার্থ উপেক্ষা করে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে যথেচ্ছ চাল আমদানীর সুযোগ। নিরলস কায়িক শ্রম এবং সেচ, বীজ, সার ও কীটনাশকসহ উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে অকুণ্ঠ বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে এ দেশের কৃষকরা দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করলেও ধান-আলুসহ ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার মধ্য দিয়ে নিজেরাই ঋণগ্রস্ত, নিরন্ন জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির মূল ভিত্তি বহুলাংশে কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষকের ভাগ্যোন্নয়ন ছাড়া উন্নয়নের জাতীয় লক্ষমাত্রা কখনোই কাঙ্খিত সাফল্য রেখা স্পর্শ করতে পারবে না। কোটি কোটি কৃষক পরিবারকে লোকসান ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়ে উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা অসম্ভব। দেশকে খাদ্যে স্বনির্ভর করার মূল কারিগর কৃষকরা ধান উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়লে তা এক সময় দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে।
কৃষকরা ধান উৎপাদন করলেও চাল উৎপাদন করে মিলাররা। অতএব সরকারের চাল ক্রয়ের সুফল ভোগ করে মূলত:অর্থলগ্নিকারী মহাজন ও মিলাররা। সেই সাথে সারাবছর যথেচ্ছভাবে চালের মূল্য বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফার সুযোগও মিলার ও মজুদদারদের সিন্ডিকেটের হাতে। যেখানে চলতি আমন মওসুমে উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে দেড় কোটি মেট্টিক টনের কাছাকাছি, সেখানে সরকার স্থানীয় বাজার থেকে মাত্র ৬ লাখ টন আমন চাল সংগ্রহ করবে বলে জানা যায়। ইতিমধ্যে আমনের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় অর্ধেক কৃষকের গোলায় উঠলেও এখনো সরকারী চাল ক্রয় শুরু হয়নি। ধান-চাল ক্রয়ে ধীরগতি, অস্বচ্ছতা এবং অনিয়মের মধ্য দিয়ে ধান-চাল সংগ্রহে সরকারী লক্ষ্যমাত্রা অপূর্ণ থাকলেও বিদেশ থেকে অসময়ে চাল আমদানী কখনো বন্ধ হয়না। দেশে বাম্পার ফলনের পরও ভরা মওসুমে ভারত থেকে চাল আমদানীর সুযোগ দিয়ে দেশের কৃষকদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়ার নজিরও আছে। যেখানে দেশে প্রতি বছর সাড়ে তিন কোটি মেট্টিক টনের বেশী ধান উৎপাদিত হয় সেখানে কৃষক ও আভ্যন্তরীন বাজার থেকে ধান-চাল সংগ্রহ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলে ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে কৃষকরা এর সুফল পেতে পারে। ধান-চাল কেনার ক্ষেত্রেও নানাবিধ অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, রাজনৈতিক দলবাজির অভিযোগ উঠতে দেখা যায়। যেহেতু প্রান্তিক কৃষকরা চাল বিক্রি করে না, তাদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যে সরাসরি ধান কেনার কার্যক্রম গ্রহণ করাই যুক্তিসঙ্গত। বছরে চালের চাহিদার প্রায় পুরোটা দেশের কৃষকরা উৎপাদন করলেও কোটি কোটি টন চালের বাজারমূল্যের নিয়ন্ত্রণ থাকে মধ্যস্বত্ত্বভোগী সিন্ডিকেটের হাতে। চালের মূল্য দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে এবং কৃষকের উৎপাদন খরচ ও বিনিয়োগের লাভ নিশ্চিত করতে মূল্য সমন্বয় এবং কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং জোরদার করতে হবে। খাদ্য মজুদ ও আমদানী সম্পর্কে অস্বচ্ছতা দূর করার পাশাপাশি কৃষিখাতের ভর্তুকি বাড়াতে হবে এবং প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে এর সুফল নিশ্চিত করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কৃষক


আরও
আরও পড়ুন