Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাসূল (সা.) -এর প্রতি ভালোবাসা

মুহাম্মদ আবদুল হামিদ | প্রকাশের সময় : ২১ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

আমরা মুসলমান। আমাদের ধর্ম ইসলাম। আমাদের প্রভূ একমাত্র আল্লাহ। আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) এর উম্মাত। আমাদের কর্তব্য হলো রাসূল (সা.) এর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। তাঁর অনুসরণ-অনুকরণ করা। তাঁর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা। তাঁকে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা। আল্লাহ তা’লা কুরআনের একাধিক আয়াতে রাসূল (সা.) কে সৃষ্টিজগতের সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে বলেছেন। আল্লাহ তা’লা বলেন, ‘বলো, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তানাদি, তোমাদের ভাই, তোমাদের পরিবার-পরিজন, তোমাদের বংশ-গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং বাসস্থান, যাকে তোমরা পছন্দ কর, (তা যদি) আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করবেন না।’ (সূরা আত তাওবাহ: ২৪) অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক ঘনিষ্ঠ।’ (সূরা আল আহযাব: ৬)
হাদীস শরীফে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ (পূর্ণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান এবং অন্যান্য সকল মানুষ থেকে প্রিয়তম হব।’ (বুখারী ও মুসলিম) মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে হৃদয়ে ও বিশ্বাসে। যার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় তার আচার-আচরণ ও কাজ-কর্মে। নবী (সা.)-কে ভালোবাসলে আমাদের আচার-আচরণ ও সংস্কৃতিতে তাঁর প্রতিচ্ছবিই প্রস্ফুটিত হতে হবে। রাসূলের কল্পনা করলে অন্তর যেন খুশি হয়, তাঁর আলোচনা আত্মার জন্য খাদ্য হয়, জবান স্বাদ ও আনন্দ হাসিল করে এবং তাঁর মোবারক নাম দ্বারা অন্তর যেন প্রশান্তি লাভ করে।
এখানে জানা আবশ্যক যে, রাসূলের জন্য কেন সৃষ্টিজগতের সর্বাধিক ভালোবাসা হওয়া উচিৎ। এ প্রসঙ্গে হাদিস বিশেষজ্ঞ আল্লামা ইসহাক (রহ.) ‘দারসে মিশকাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, কারো প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হলো চারটি: ১. সৌন্দর্য ২. পরিপূর্ণতা ৩. এহসান বা অনুগ্রহ ৪. আত্মীয়তা। সৌন্দর্যের কারণে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। সৌন্দর্যের উপর কোনো কোনো জীবজন্তুও আশিক হয়ে যায়। যথা- চাঁদের সৌন্দর্যের উপর কোনো কোনো পাখি আশিক। প্রদীপের আলোর উপর কোনো কোনো পতঙ্গ এমনভাবে আশিক হয় যে, প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে দেয়। এমনিভাবে কারো উপর অন্য কারো দয়া-অনুগ্রহ থাকলে তার জন্যও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। মানুষতো আছেই; এমনকি জীবজন্তুও এহসানের বিনিময়ে ভালোবাসতে আরম্ভ করে এবং অনুগ্রহকারীর পোষ্য বনে যায়। যথা- কুকুর, বিড়াল, ইত্যাদি। আর যদি কারো মধ্যে সৌন্দর্য না থাকে তবে এহসান বা অনুগ্রহও পাওয়া যায় না। যোগ্যতার ক্ষেত্রে পূর্ণতা বিদ্যমান। যেমন- বড় কোনো বিজ্ঞানী, দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিকের প্রতি ভালোবাসা হয়ে যায়; ওই ব্যক্তি সুশ্রী না হলেও। আর আত্মীয়তার কারণে ভালোবাসা হওয়া তো অত্যন্ত পরিষ্কার। উল্লিখিত কারণসমূহের যে কোনো একটি থাকলেই যখন ভালোবাসা সৃষ্টি হয়; তাহলে রাসূল (সা.) এর মধ্যে উক্ত চারটি কারণ ও গুণ পরিপূর্ণ রূপে বিদ্যমান থাকার পরও তার প্রতি ভালোবাসা হবে না তো আর কার প্রতি হবে?
সৌন্দর্য : রাসূল (সা.) দেহের গড়ন ছিল মাধ্যম প্রকৃতির, সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিমিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাঁর চেহারায় ছিলো মমতার আবরণ, কথা-বার্তায় ছিল বদান্য, সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা সৌন্দর্যের অধিকারী এবং আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয়। যেহেতু আল্লাহ তা’লা তাকেই সর্বাপেক্ষা প্রিয় বানিয়েছেন, সুতরাং তাকে সর্বাপেক্ষা সুন্দরও বানাবেন। রাসূল (সা.) এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হযরত হাস্সান (রা.) একটি শ্লোক রচনা করেছেন। আরবি শ্লোকের অনুবাদ হচ্ছে, ‘আমার চোখ কখনও তোমার চেয়ে অধিক সুন্দর কাউকে দেখেনি এবং তোমার থেকে সুন্দর কোন মানুষকে কোন নারী প্রসব করেনি।’ এ প্রসংগে হযরত আয়শা সিদ্দীকা (রা.) বলেন- ‘একটি সূর্য রয়েছে আমার জন্য, আর অন্য সূর্যটি রয়েছে সমগ্র জগৎবাসীর জন্য। কিন্তু আমার সূর্য হলো আকাশের সূর্য থেকে উত্তম। জগতের সূর্যটি ফযরের পর উদয় হয়, আর আমার সূর্যটি রাত্রে এশার পর উদিত হয়।’
পরিপূর্ণতা: এই পূর্ণতা মানবীয় চরিত্রের, মানবিক গুণাবলির। রাসূল (সা.) ছিলেন আপন মহিমায় মানবীয় গুণাবলীর পূর্ণতার সুউচ্চ শিখরে সমাসীন। তা ইলম ও আমলের দিক থেকে হোক, কিংবা চারিত্রিক ব্যাপারে হোক, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক, কিংবা মানুষের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে হোক। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কোরআনে এরশাদ করেন, ‘আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ অন্যসব নবী রাসূলগণকে যে সকল পরিপূর্ণতা দান করা হয়েছিল, সবই একত্রে রাসূল (সা.)-কে দান করা হয়েছে।
এহসান বা অনুগ্রহ: রাসূল (সা.) এর দয়া, অনুগ্রহ এবং নম্রতা এত বেশি যে, পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সমস্ত জগৎবাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ রাসূল (সা.) সমস্ত বনী আদমকে চিরস্থায়ী জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্য প্রচেষ্টা করেছেন এবং অনেককে বাঁচিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা জাহান্নামের গর্তের কিনারায় গিয়ে পৌঁছে ছিলে; কিন্তু রাসূল এ থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন।’
রাসূল (সা.) এর আগমনপূর্ব যুগকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা অজ্ঞতা ও অন্ধকারের যুগ বলা হয়। দিনের আকাশে সূর্য, রাতে চাঁদ-তারকারা থাকা সত্তে¡ও সেই যুগকে অন্ধকার যুগ বলা হয় কেন? তখন কাব্য-সাহিত্য, সংগীতে আরবরা দুনিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ থাকা সত্তে¡ও সেই যুগকে অজ্ঞতার যুগ বলা হবে কেন? আসল কথা হচ্ছে, এই অন্ধকার ও অজ্ঞতা ছিল মানব চরিত্রের চরম অধঃপতনের। এই অজ্ঞতা ও অন্ধকারের মধ্যদিয়ে তারা জাহান্নামের কিনারায় গিয়ে পৌঁছে ছিল। আল্লাহ তা’লা এই অজ্ঞতা ও অন্ধকারের যুগে রাসূল (সা.)-কে প্রেরণ করে মানুষের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করেছেন। রাসূল (সা.) পৃথিবীতে ঐশ্বরিক সৌন্দর্য বিতরণ করলেন, আলো ছড়ালেন। হানাহানি, রক্তপাতের পরিবর্তে মুসলমানরা ভাই ভাই শিক্ষা দিলেন। প্রেম-মমতা, ত্যাগ, পরোপকার, প্রভৃতির মাধ্যমে মায়া-মমতার একটি বেহেশতী সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর এই শিক্ষা ও চরিত্রের সৌন্দর্যের জোয়ার ছড়িয়ে পড়ল দুনিয়াজুড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা পেলাম ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী জীবন দর্শনের সন্ধান। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা হলাম সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, বিশ্বনবী (সা.) এর উম্মাত।
আত্মীয়তা: সামন্য গভীর দৃষ্টিতে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, রাসূল (সা.) এর সাথে মুমিনের আত্মীয়তার সম্পর্ক অন্যদের চেয়ে বেশি। কেননা অন্যদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ‘জিসমানী’ বা শারীরিক আর রাসূলের সাথে ‘রুহানি’ বা আত্মিক। আত্মাহীন দেহ মূল্যহীন। রাসূল (সা.) হলেন আমাদের মূল্যবান আত্মার পরম আত্মীয়। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুমিনদের সাথে রাসূলের সম্পর্ক তাদের সত্ত¡ার চেয়েও বেশি এবং রাসূল হলেন তাদের পিতৃতুল্য।’ আবু দাউদ শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য তোমাদের পিতার সমতুল্য।’
ফার্সি কবি আল্লামা শেখ সাদি (রহ.) রাসূল প্রেমে রচিত কবিতায় চমৎকারভাবে বিষয়গুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। আরবি ভাষায় লিখিত তাঁর চার লাইনের এই কবিতাটি মুসলিম উম্মাহের সর্বমহলে সমাদৃত। শেখ সাদি বলেন, ‘বালাগাল উলা বি-কামালিহি, কাশাফাদ্দুজা বি-জামালিহি, হাসুনাত জামিয়ু খিসালিহি, সাল্লু আলায়হি ওয়া আলিহি।’ কবিতাটির বাংলা অর্থ অনেক কবি সাহিত্যক অনেকভাবে করেছেন। কোনো এক বিখ্যাত কবির ভাষায় এর অনুবাদ, ‘সুউচ্চ শিখরে সমাসীন তিনি নিজ মহিমায়, তিমির-তমসা কাটিল তাঁর রূপের প্রভায়, সুন্দর আর সুন্দর তাঁর স্বভাব চরিত্র তামাম, জানাও তাঁর ও তাঁর বংশের পরে দরূদ-সালাম।’
কোরআন ও হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী, সব রকমের লোক, যথা- বড়-ছোট এবং সম-সাময়িকদের ভালোবাসার চেয়ে অধিক ভালোবাসা রাসূলের জন্য হওয়াটা পূর্ণাঙ্গ ঈমানের দাবি। সাহাবায়ে কেরামগণ রাসূল (সা.)-কে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। তাঁকে যথাযথভাবে মর্যাদা দিতেন। সর্বদা তাঁর অনুসরণ-অনুকরণে ব্রতী ছিলেন। তাঁর আদেশ-নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। রাসূলের আদর্শকে সমুন্নত রাখাই ছিল তাঁদের একমাত্র সাধনা। রাসূলের জন্য তাঁদের ভালোবাসা নিজেদের ছেলে-মেয়ে, পিতা-মাতা, আত্মীয় স্বজনদের চেয়েও অধিক ছিল। ওহুদের যুদ্ধে হযরত আবু তালহা (রা.) রাসূলের সামনে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করলেন যে, নিজের সমস্ত দেহ আহত হয়ে গেল; কিন্তু রাসূলের উপর একটা তীরও পতিত হতে দিলেন না।
সাহাবায়ে কেরামগণের মতো আমাদেরকেও রাসূল (সা.)-কে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে হবে। সর্বাবস্থায় তাঁর আদর্শকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করতে হবে। রাসূল (সা.) যা বলেছেন তা সত্য বলে মেনে নেয়া এবং তাঁর আনুগত্য করা আমাদের জন্য অপরিহার্য। প্রত্যেক কাজে রাসূলের অনুগত্য করাই হচ্ছে রাসূলের প্রতি ভালোবাসা। রাসূলের প্রতি ভালোবাসা যতো বাড়বে রাসূলের আনুগত্যও ততো বাড়বে। এতে আল্লাহ তা’লা সন্তুষ্ট হবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে রাসূল আপনি) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদিগকে ভালোবাসেন এবং তিনি তোমাদের গোনাহখাতা মাফ করে দেবেন; আল্লাহ তা’লা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়াবান।’ (সূরা আল-ইমরান: ৩১)
লেখক: শিক্ষক, জামেয়া ইসলামিয়া আনওয়ারে মদিনা মাদরাসা, ইসলামপুর, সদর, সিলেট



 

Show all comments
  • md obidullah ৩০ অক্টোবর, ২০২০, ৯:২৯ এএম says : 0
    আমরা সকল মুসলমান রাসূল সাঃ কে নিজের পিতা মাতার চেয়েও বেশি ভালবাসি
    Total Reply(0) Reply
  • md obidullah ৩০ অক্টোবর, ২০২০, ৯:৩২ এএম says : 0
    হে আল্লাহ আপনি আমাকে রাসূলের ভালবাসার পাত্র বানিয়ে দাও।
    Total Reply(0) Reply
  • Imam Hossain ১৪ নভেম্বর, ২০২০, ৭:৫৮ পিএম says : 0
    মা শা আল্লাহ... খুবই চমৎকার এবং তাত্ত্বিক প্রবন্ধ...
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন