পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
উত্তর ইয়েমেনের যে কঙ্কালসার শিশুর ছবি নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষের হৃদয়কে নাড়া দেয়া সেই ৭ বছরের শিশু আমল হোসেন গত সপ্তায় মারা গেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের সুবাদে ব্যাপক পরিচিতি পাওয়া শিশুটি অবশেষে মারা যাওয়ায় পশ্চিমা বিবেক কি ব্যথিত হয়েছে। তারা কি আমল হোসেনের ভাই-বোনসহ আরো অসংখ্য এমন হাড্ডিসার, মৃত্যুর মুখে থাকা ইয়েমেনি শিশুদের বাঁচানোর কোন উদ্যোগ নিয়েছে, নিতে যাচ্ছে? আপাতত এমন কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ইতিপূর্বে সিরীয় যুদ্ধের নির্মম শিকার অভিবাসন প্রত্যাশি পরিবারের ফুটফুটে শিশু আইলান কুর্দির লাস তুরস্কের উপকুলে সমুদ্রতটে পড়ে থাকার দৃশ্যটিও নাকি বিশ্ববিবেবেকে তোলপাড় তুলেছিল। এতে সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জ বা অভিবাসন নিয়ে পশ্চিমাদের নীল নকশায় কোন হেরফের হয়নি। পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের মিডিয়া একজন জামাল খাসোগির অপমৃত্যুর ঘটনার পেছনে যে সময় ও শক্তি ব্যয় করছে ইয়েমেনের লাখো শিশু ও কোটি কোটি মানুষের দুর্দশা লাঘবে ও জীবন রক্ষার জন্য তার সিকি ভাগও ব্যয় করছেনা। তথাকথিত মানব সভ্যতার এটা এক অদ্ভুত ট্রাজেডি। সউদি ভিন্ন মতাবলম্বি সাংবাদিক জামাল খাসোগির মৃত্যুর পর মার্কিন শাসকরা নতুন মওকা পেয়ে আবারো বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সুবিধাদি আদায় করে নিয়েছে বলে জানা যায়। মার্কিনী ও ইসরাইলীদের সহায়তা সউদি সামরিক জোট প্রায় ৫ বছর ধরে ইয়েমেনে বোমা মেরে কি করছে তা পশ্চিমা বিশ্বের অজানা নয়। ইয়েমেনের দেড়কোটি মানুষ এখন চরম দুর্ভিক্ষের কবলে। গত ৫ বছরে সউদি জোটের বোমা হামলায় যত সংখ্যক মানুষ নিহত ও হতাহত হয়েছে। যত সংখ্যক বাড়িঘর জনপদ ও অবকাঠামো ধ্বংস করতে সউদি জোটের যে খরচ হয়েছে তা দিয়ে আফ্রিকার এই অন্যতম দরিদ্র দেশটিকে একটি সমৃদ্ধ জনপদে পরিনত করা সম্ভব ছিল। এখানে যা ধ্বংস করা হচ্ছে, যে সব প্রযুক্তি, তথ্য ও সরঞ্জাম দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে সে খরচ থেকে মার্কিন এমআইসি(মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। হাজার হাজার বছরের ধারবাহিক জনবসতি ও প্রতœতাত্তি¡ক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ইয়েমেনের জনপদগুলোকে বোমা মেরে ধূলোর সাথে মিশিয়ে দেয়ার ক্ষয়ক্ষতি শুধুমাত্র অর্থের মানদন্ডে নিরূপন করা সম্ভব নয়। খাদ্যে উদ্বৃত্ত বিশ্বে যোগাযোগ প্রযুক্তি ও ব্যবস্থার চরম উৎকর্ষের এই যুগে লাখ লাখ শিশু-কিশোর খাদ্যাভাবে কঙ্কালসার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার চলমান ইতিহাস মানব সভ্যতার জন্য এক বড় কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করছে। তবে এ নিয়ে শক্তিশালী পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। দেশে দেশে যুদ্ধ থেমে গেলে, মানবিক সত্তা জেগে উঠলে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের প্রতিভ’ মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের অস্ত্রবাণিজ্যের মুনাফা অনেক কমে যাবে। এটা সবারই জানা। এ কারণেই কি যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা বা ভয়াবগ দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কার মত পরিস্থিতি পশ্চিমা মেইন স্ট্রীম মিডিয়ায় তেমন গুরুত্ব পায়না? সিরিয়া বা ইয়েনের লাখো শিশুর মৃত্যুর চেয়ে একজন জামাল খাশোগির মৃত্যু অথবা মার্কিন নির্বাচনে কথিত রুশ হস্তক্ষেপের ঘটনা এসব গণমাধ্যমে অনেক বেশী কভারেজ পেয়েছে।
মুক্তবিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণমাধ্যম অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে থাকে। কিন্তু এসব গণমাধ্যম কারা চালায়, এদের নেপথ্যের কুশীলবদের ভ‚মিকা ও লক্ষ্য কি। এমন প্রশ্নের জবাবে বেরিয়ে আসবে কর্পোরেট পুঁজিবাদি স্বার্থ এবং অনেক ভ‚-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এজেন্ডার বিষয়। পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সিআইএ এবং সা¤্রাজ্যবাদি এলিটদের বিশ্বনিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক কর্মসূচির নীল নকশাও সক্রিয় রয়েছে। কোন একপাক্ষিক বা সরল রৈখিক তত্ত¡ দিয়ে এই বহুমাত্রিক এজেন্ডার প্রকৃতি ও লক্ষ্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। বর্ণবাদী ও একদেশদর্শি মনোভাবাপন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুদিন ফিরিয়ে আনতে ইতিহাসের পরম্পরায় বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে মার্কিন শাসকদের দায়বদ্ধতার জায়গাগুলোকে সংকীর্ণ করে তোলার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন তখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, এই ডোনাল্ড ট্রাম্প আসলে কার স্বার্থে কাজ করছেন? সবচেয়ে বেশী খটকা লাগে যখন দেখি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট পশ্চিমা শক্তিশালী গণমাধ্যমকে মার্কিন জনগণের শত্রæ বলে আখ্যায়িত করছেন। মার্কিন গণমাধ্যমকে এর আগে আর কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমনভাবে আক্রমন করেছেন কিনা আমাদের জানা নেই। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর থেকেই কিছু মিডিয়ার ফেইক নিউজ সম্পর্কে তিনি অনবরত কথা বলে চলেছেন। আমরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রদায়িক নীতি, মুসলিম বিদ্বেষ, অমানবিক ও মার্কিন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী অভিবাসন নীতি, চরমভাবাপন্ন অর্থনৈতিক কৌশলের অনেক সমালোচনা করতে পারি। তবে তিনি মার্কিন গণমাধ্যমের ফেইক নিউজ ও গণবিরোধী ভ‚মিকা সম্পর্কে বার বার যে অভিযোগের আঙুল তুলছেন, পরিস্থিতির পরিবর্তনে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। যে কারণেই হোক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ইস্যুটিকে আলোচনায় নিয়ে আসলেও মার্কিন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেছেন বলে শোনা যায়নি। এমনকি হোয়াইট হাউজের তরফ থেকেও গণমাধ্যমের গণবিরোধি ভ‚মিকা সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের অভিযোগ সম্পর্কে কোন ব্যাখ্যা ও অবস্থান স্পষ্ট করা হয়নি। পক্ষান্তরে পশ্চিমা গণমাধ্যমের বর্তমান ভ‚মিকা সম্পর্কে বৃটিশ লেবার পার্টি নেতা জেরেমি করবিনের অবস্থান অনেক বেশী স্বচ্ছ ও বস্তুনিষ্ঠ। গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে তার প্রত্যাশা অনেক বেশী। সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রি মিডিয়া হ্যাশট্যাগ দেয়া জেরেমি করবিনের টুইট বার্তাগুলোতে পশ্চিমা মিডিয়ার নানামাত্রিক ম্যানিপুলেশনের বিষয়গুলো উঠে এসেছে। তিনি গণমাধ্যম কর্মীদেরকে বিলিয়নিয়র মালিক, টেক-জায়ান্ট বা রাষ্ট্রশক্তির প্রভাবমুক্ত হয়ে গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধের অনুকুল সৃষ্টিশীল ভ‚মিকা পালনের আহŸান জানিয়েছেন। এরপর থেকেই জোরেশোরে তার বিরুদ্ধে এন্টি সেমিটিজমের অভিযোগ উঠতে থাকার মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমের গণবিরোধী ভ’মিকার নেপথ্য শক্তি সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারনা করা যায়। বৃটেনে ইহুদি জনসংখ্যা তিনলাখের কম হলেও তারা পুরো রাষ্ট্রশক্তিকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। ইহুদি জনসংখ্যার ১০গুন মুসলমানের পক্ষেও এতটা শক্ত অবস্থান কল্পনা করা যায়না। বৃটিশ কর্পোরেট বাণিজ্য, মিডিয়া এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ইহুদিরা যে কাউকে বেকায়দায় ফেলে দিতে পারে। তবে জর্জ গ্যালওয়ে এবং জেরেমি করবিনের মত সাহসী রাজনৈতিক নেতারা জায়নবাদি প্রপাগান্ডাকে থোরাই কেয়ার করেন। পাশাপাশি সেখানকার মুসলমানদের মধ্যে সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটতে দেখা যাচ্ছে। বৃটেনের জাতীয় নির্বাচনে, লন্ডনের মেয়র সাদিক খান অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক মধ্যবর্তি নির্বাচনে অনেক মুসলমান তরুন নেতৃত্বের উত্থান ঘটেছে। এর মানে হচ্ছে, জায়নবাদিদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় মুসলিম বিদ্বেষ বা ইসলামোফোবিক এজেন্ডায় অনবরত প্রপাগান্ডা মুসলমানদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উত্থান ঠেকাতে পারছেনা। বৃটিশ নির্বাচনের আগে ২০১৫ সালে জেরেমি করবিন ও লেবার পার্টির বিরুদ্ধে জায়নবাদিদের পরিকল্পিত প্রপাগান্ডা তেমন কোন কাজে আসেনি। করবিন যখন বৃটিশ গণমাধ্যমের সংস্কার এবং গণমাধ্যমকর্মীদের সত্যানুসন্ধ্যানের তাগিদ দেন, মিডিয়া তার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে ট্রাম্পের গণমাধ্যম বিদ্বেষী ভ‚মিকার সমর্থক হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে।
বাস্তবতা ও জনমত যাই হোক ,একতরফা প্রচারনা ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুল তথ্য হাজির করে সত্য আড়াল করাই যেন জায়নবাদ প্রভাবিত কথিত গণ বিরোধী গণমাধ্যমের লক্ষ্য। মাঝে মাঝে সত্যের কাছাকাছি রোমহর্ষক ঘটনার খন্ডিত উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে তারা জনসমাজে এক ধরনের মনোস্তাত্তি¡ক সুড়সুঁড়ি দিয়ে থাকে। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত ৭ বছরের ইয়েমেনি শিশু আমল হোসেইনের কঙ্কালসার ছবিটি যখন প্রকাশিত হয় তখনো জাতিসংঘ অন্তত ১০ লাইখ ইয়েমেনির জীবন চরম ঝুঁকিতে থাকার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এ মাসের একেবারে শুরুতে আমল হোসেইনের মৃত্যু সংবাদ প্রকাশের সময়ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা দুর্ভীক্ষে দেড় মিলিয়ন ইয়েমেনির মৃত্যুর আশঙ্কা প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ব কাঁপানো ছবি প্রকাশের পর আমল হোসেইনের পরিবারকে নেকড়া দিয়ে বানানো রিফিউজি ক্যাম্প থেকে কোন উন্নত আশ্রয়কেন্দ্র বা চিকিৎসার জন্য কোন উন্নত হাসপাতালে নেয়া হয়নি। এমনকি ওর খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পুরনে কেউ এগিয়ে আসেনি। আমল হোসেইনের মৃত্যুর পর পশ্চিমা গণমাধ্যমের তরফ থেকে আমল হোসেনের মা মরিয়ম আলির প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়েছিল। অধিক শোকে পাথর বনে যাওয়া এই নারী প্রিয় শিশুকন্যাটির সদা হাসোজ্জ্বল মুখচ্ছবির কথা মনে করে টেলিফোনে কাঁদতে কাঁদতে নিজের এবং এখনো বেঁচে থাকা অন্য সন্তানগুলোর ভবিষ্যত নিয়েই বেশী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। হুথি বিদ্রোহীদের ঘাঁটি সন্দেহে ইয়েমেনে রাজধানীতে হাজার বছরের পুরনো জীর্ন বসতি অথবা একেকটি পর্ণ কুটির ভেঙ্গে দিতে বোমারু বিমান, বৈমানিক ও বোমার পিছনে যে পরিমান অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তা দিয়ে হয়তো ইয়েমেনের মত ১০টি দেশের দারিদ্র নিরসন সম্ভব ছিল। ইয়েমেন বা উত্তর আফ্রিকার দারিদ্র বিমোচনে মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের স্বার্থ না থাকলেও জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রতিশ্রæতির কি কোনো মূল্য নেই। গণমাধ্যম কার স্বার্থ দেখছে, বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রত্যাশিত শান্তি নাকি মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের স্বার্থ? বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতিশ্রæতি সভ্যতার দাবী পুরণে মানবাধিকার গ্রæপগুলোর পাশাপাশি গণমাধ্যমকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করার কথা থাকলেও পশ্চিমা গণমাধ্যম ফেইক নিউজের পেছনে অর্থ ও সময় ব্যয় করতেই যেন বেশী আগ্রহী। কখনো কখনো ঘটনাক্রমে আইলান কুর্দি বা আমল হোসেইনের মত শিশুদের বিয়োগান্তক ছবি ছেপে তারা এক ধরণের অ্যাডভেঞ্চারিজমের আস্বাদ লাভ করে। এসব নিউজ ও ছবি দেখে বিশ্ব জনমতে আলোড়ন উঠলেও সা¤্রাজ্যবাদের নীল নকশা ও যুদ্ধনীতিতে দৃশ্যত কোন হেরফের ঘটে না। কেউ কেউ পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের গণমাধ্যমে ইয়েমেনে বিমান হামলা ও দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর কাছাকাছি থাকা লাখ লাখ বনি আদমের চাইতে জামাল খাশোগির মৃত্যু ঘটনাকে অনেক বেশী প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে এটুকু বলা যায়, তুরস্কের সউদি কনসুলেট ভবনে জামাল খাশোগিকে হত্যার ঘটনা নিয়ে সউদি আরবের সাথে মার্কিনী ও ইসরাইলীদের বিলিয়ন ডলারের স্বার্থ এবং স্ট্রাটেজিক সুবিধা আদায় করে নেয়ার পণ ও গোপন দর কষাকষির সুযোগ আছে।
পশ্চিমা মেইনস্ট্রীম মিডিয়া যে ভ‚মিকাই পালন করুক, সেখানে এখনো কিছু সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক আছে বলেই বিশ্বের মানুষ অনেক সত্য জানতে পারছে। ফটো সাংবাদিক এলেক্স পোটার ২০১২ সাল থেকে ইয়েমেনে কাজ করছেন। গত সপ্তায় আদার ওয়ার্ডস নামের একটি বøগপেইজে প্রকাশিত এলেক্স পোটারের একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘প্রফিটস ট্রাম্প লাইভস ইন ইয়েমেন’। অর্থাৎ ইয়েমেনিদের জীবনের বিনিময়ে ট্রাম্প মুনাফা করছেন। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের একদিনের অভিজ্ঞতার কথা এভাবে তুলে ধরেছেন এলেক্স, উপকুলীয় শহর হুদাইদায় সউদি জোটের বোমা হামলায় অন্তত ২০জন নিহত হয়েছে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত শহরের বাসিন্দারা তীব্র অর্থ ও খাদ্য সংকটের মুখোমুখি। বিক্রি করার মত যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে বাজারে এসেছে বিক্রিত অর্থ দিয়ে খাদ্য কেনার জন্য। বাজারে বিমান হামলার পর পরিবারের সদস্যরা মৃত প্রিয়জনের ছিন্নভিন্ন দেহাংশ খুঁজতে হয়রাণ হয়ে গেল। বোমায় উড়ে যাওয়া হাত পা, রক্তাক্ত, আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। এলেক্স পোটারের মতে, এমন অসংখ্য হৃদয়বিদারক ঘটনার এটি একটি ঘটনার বর্ণনা মাত্র। জুলাই মাসে একটি স্কুল বাসে বোমা হামলায় ৪০ শিশুর নির্মম মৃত্যু ঘটে। আগস্টে একটি হাসপাতালের উপর বোমা হামলায় ৫০জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়। ভোরবেলায় ইয়েমেনি রাজধানীতে সউদি জোটের বোমা হামলায় একটি পরিবারের সব সদস্যরা ঘুমের মধ্যেই নিহত হওয়ার ঘটনাও আগস্টে ঘটেছে। এই যুদ্ধের, এই বোমা হামলার আদৌ কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা, এমন প্রশ্নের বাইরে এলেক্স পোটার বলেছেন, এই যুদ্ধকে উপলক্ষ্য করে করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সউদি আরবের কাছে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করছেন। জীবনের চেয়ে ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ যখন প্রাধান্য পায় তখন মানবিক সভ্যতার দাবী ধোপে টিকে না।মেইনস্ট্রীম মিডিয়াগুলো মানুষের পক্ষে, মানবতার পক্ষে, গণতন্ত্র, শান্তি ও সম্প্রীতির বদলে কর্পোরেট অর্থনীতি ও মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের স্বার্থে কথা বলছে। এটাই চলমান বিশ্বব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। তবে যুদ্ধ বিরোধী, জায়নবাদ বিরোধী লেখক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্টের সংখ্যাও কম নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পদের শত বাঁধা-বিপত্তির পরও পশ্চিমা রাজনৈতিক মানচিত্রে নতুন সম্ভাবনার যোগসুত্র এখানেই।
এবার নিজ দেশ ও সমাজের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চাই। আমাদের দেশে বিচারহীনতা সংস্কৃতি, সামাজিক অবক্ষয়, গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিচ্যুতি পুরো সমাজকে অস্থির ও হতাশায় নিমজ্জিত করে ফেলেছে। যেখানে একপাক্ষিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ ও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে সেখানে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে মূলধারার গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা ও ভ’মিকা বহুগুন বেড়ে যায়। কিন্তু এ দেশে কখনোই গণমাধ্যমকে গণমানুষের প্রতিনিধিত্বশীল ভ‚মিকায় বিকশিত হতে দেয়া হয়নি। আশির দশকের শুরুতে যখন দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শৈশবকাল, তখন সামরিক একনায়কত্বের হাতে বন্দি গণতন্ত্রের সাথে সাথে বন্দি হয়ে পড়ে দেশের গণমাধ্যমও। সে সময় দেশে কোন বেসরকারী সেটেলাইট টিভি বা রেডিও চ্যানেল না থাকায় সরকারী রেডিও, টিভি হয়ে পড়ে সরকারী প্রচারনার একতরফা মাধ্যম। সে সময় অনেকেই বিটিভিকে বলত ‘সাহেব, বিবি গোলামের বাক্স’। তবে নানা রকম নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিবন্ধকতা সত্তে¡ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় সংবাদপত্রগুলো তখনো অনেকটা স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে সচেষ্ট ছিল। আজকের বাস্তবতা সম্পুর্ন ভিন্ন। দেশে অনেকগুলো বেসরকারী টিভি চ্যানেল সক্রিয় থাকলেও বিরোধি মতের টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের মালিকানাধীন টিভি চ্যানেলগুলো রাতদিন সরকারীদলের উন্নয়নের ফিরিস্তি এবং এর ধারবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা রক্ষার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। জনগণের বড় অংশের ধারণা, দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়ে পড়েছে। বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদকে সরকারের কার্যক্রমের একটি জবাবদিহিতার জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে গত ৫ বছর অকার্যকর সংসদীয় ব্যবস্থায় গণমাধ্যম সে শুন্যতা পুরণে এগিয়ে আসেনি। উপরন্তু সরকার বিরোধি মতে টিভি বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিলেও নাগরিক সমাজ ও সক্রিয় গণমাধ্যমগুলোর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তোলা হয়নি। গুম,খুন ও বিচারহীন হত্যাকান্ডের প্রশ্নে গণমাধ্যম শক্ত ভ’মিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই, মানুষের মানবিক মর্যাদা, সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধের উন্মেষ দেখতে চাই। তাহলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ক্ষীন দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্পোরেট স্বার্থের বাইরে গিয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক ও মানবিক দায়বদ্ধতাকে মূল্য দিতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।