Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সঠিক চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার উপায়

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৪ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

আজ ১৪ নভেম্বর। বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। বর্তমানে পৃথিবীতে ৫০ কোটিরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। সব থেকে চিন্তার বিষয় হলো, এদের মধ্যে ৫০ শতাংশ জানেনও না, যে তাঁরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তথ্য বলছে, ১৯৮০ সালে যেখানে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৮ কোটি, ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয় ৪২ কোটি ২০ লক্ষ, ২০১৫ সালে ৪৫, ২০১৬ সালে ৪৬ এবং ২০১৭ সালে ৫০ কোটির উপর। ডায়াবেটিসের ফলে বাড়ছে অন্ধত্ব, কিডনি ফেলিওর, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা শরীরে নি¤œাংশে প্রত্যঙ্গহানির মতো ঘটনা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দাবি, ২০৩০ সালের মধ্যে এই অসুখ বিশ্বে ও প্রধানতম মরণব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবে। তবে এইসব পরিসংখ্যান দেখে অযথা ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ডায়াবেটিসকে পরাস্ত করতে, তার প্রভাব আয়ত্তে আনতে সক্ষম। তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু হওয়াটা বাঞ্চনীয়। বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের বাড়াবাড়ি লক্ষ করেই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইন্টান্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন যৌথভাবে ১৯৯১ সালের ১৪ নভেম্বর দিনটিকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল, ডায়াবেটিস সম্পর্কে গোটা পৃথিবীর মানুষকে সচেতন করা। এক্ষেত্রে, প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল দু‘টি। প্রথমত, ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং দ্বিতীয়ত, এই ব্যাধি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের বইয়ের পাতার মধ্যে আবদ্ধ না- রেখে জনসমক্ষে তুলে ধরা।
ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের স্বার্থে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী ও বিভিন্ন পেশায় যুক্ত মানুষ একজোট হয়ে কাজ করে। এইদিনে এই রোগ নিয়ে লাগাতার প্রচার, সম্মেলন, কর্মশালা, স্বাস্থ্য শিবির প্রভৃতি আয়োজন করা হয়। তাতে স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মী ও কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করে থাকেন। এই কর্মসূচিতে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সংবাদপত্র, টেলিভিশন প্রভৃতির মাধ্যমে এই সংক্রান্ত খবর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়। বিভিন্ন জায়গায় সচেতনতামূলক প্রচার, রক্তে শর্করা মাত্রা জানার জন্য স্বাস্থ্য শিবির, সম্মেলন প্রভৃতির আয়োজন করা হয়। তবে বিশ্বব্যাপি ডায়াবেটিসের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে প্রচার কর্মসূচিও আর্ন্তজাতিক স্তরে সংগঠিত হওয়া দরকার। এর জন্য প্রয়োজন হলো: ১. ডায়াবেটিস মোকাবিলায় প্রত্যেক সরকারের নির্দিষ্ট নীতি ও কৌশল থাকা দরকার। ২. যাঁরা এই রোগে আক্রান্ত, তাঁদের প্রত্যেককে ডায়াবেটিস সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সরবরাহ করতে হবে। ৩. ডায়াবেটিসের লক্ষণ, একে আটকানোর উপায় এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের হাত থেকে বাঁচার পন্থা সবাইকে জানাতে হবে। ৪. প্রত্যেক দেশেই বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালন করা উচিৎ।
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ১৪ নভেম্বরকেই বেছে নেওয়া হলো কেন? ১৪ নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ইনসুলিনের অনত্যম আবিষ্কারক ফ্রেডরিক ব্যানটিং। ১৯২২ সালে চার্লস বেস্টের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি এই ওষুধের আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁদের উদ্যোগে প্রথমবার টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ১৪ বছরের এক কিশোরের উপর সফলভাবে ইনসুলিন প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছিল। এই আবিষ্কার গোটা বিশ্বের ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের জীবন বদলে দিয়েছিল। তাঁদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেকটা বেড়ে গিয়েছে।
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের লোগো, একটা লোগো তৈরির পেছনে নানা কারণ থাকে। তবে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের লোগো বা প্রতীক হলো, নীল রংয়ের একটা বৃত্ত। আইডিএফ-এর সদস্য ক্যারি রোসফিল্ডের মস্তিষ্কপ্রসূত এই লোগোটি ২০০৬ সালে প্রকাশ্যে আনা হয়। লোগোর নীল রং খোলা আকাশ ও জাতিসংঘের পতাকার প্রতীক। জাতিসংঘ এমন একটা আর্ন্তজাতিক সংগঠন যা বিভিন্ন দেশ বা রাষ্ট্রের সরকারের মৈত্রী স্থাপন করে। এক্ষেত্রে লোগোয় নীল রং ব্যবহারে অর্থ হলো, বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রকে ডায়বেটিসের মোকাবিলায় একজোট হয়ে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করা। অন্যদিকে, লোগো হিসেবে বৃত্তকে বেছে নেওয়ার কারণ হল, বহু দেশেই বৃত্ত জীবন, সুস্বাস্থ্যের চিহ্ন। তাছাড়া বৃত্ত একতাকেও চিহ্নিত করে। ডায়াবেটিসের মতো মরণব্যাধির মোকাবিলায় এই একতা ভীষণ জরুরি। বর্তমানে এই একটা লোগোই বিশ্বের সর্বত্রই ডায়াবেটিস মোকাবিলায় দৃঢ় বার্তা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। বস্তুত, এই লোগোই বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষকে একটা নিদিষ্ট পরিচয় দিতে পেরেছে। যার লক্ষ্য হলো- ১. ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে যাবতীয় সম্ভাব্য সহযোগিতা করা। ২. ডায়াবেটিস সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন করে তুলতে নিত্যনতুন কর্মসূচির আয়োজন করা। ৩. ডায়াবেটিস মোকাবিলায় আক্রান্তদের দিকে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলাদের সংখ্যা প্রায় ২০ কোটির কাছাকাছি। ২০৪০ সাল নাগাদ তা ৩১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। মহিলাদের মৃত্যুর কারণ হিসাবে এই রোগের স্থান নবম।
সমস্যা হলো, মূলত আর্থসামাজিক কারণেই মহিলারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে তারা তাঁদের প্রাপ্য চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হন। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই বৈষম্য সব থেকে বেশি যা তাঁদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। পুষ্টিকর খাবারের অভাব, কায়িক শ্রমের অভাব, মদ্যপান ও তামাক সেবনের অভ্যাস সমস্যা আরও বাড়ায়। বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালনের লক্ষ্য হলো, মহিলাদের এই অসুখ সম্পর্কে সচেতন করা। যাতে তাঁরা সহজেই এই রোগের মোকাবিলা করার মতো স্বাস্থ্য পরিষেবার নাগাল পান এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারেন। তথ্য বলছে প্রত্যেক পাঁচজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মহিলার মধ্যে দু‘জনই অল্প বয়সি হন, যাঁদের বয়স সন্তান ধারণের উপযোগী। কিন্তু ডায়াবেটিস তাঁদের গর্ভধারণের পক্ষে নানা বাধা তৈরি করে। এক্ষেত্রে আগে ভাগে সতর্ক না-হলে এবং উপযুক্ত ব্যব¯থা নানিলে মা এবং সন্তান দু‘জনেরই ক্ষতি হতে পারে। এমনকি, গর্ভস্থ ভ্রæণ বা সদ্যোজাতের মৃত্যু হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রায় সাতটি শিশুর মধ্যে একটি শিশুর জন্মের সময় এই ধরনের সমস্যা তৈরি করে গেস্টাশনাল ডায়াবেটিস। গর্ভাবস্থায় এই ধরনের ডায়াবেটিস শনাক্তকরণ হয়। বহু ক্ষেত্রেই রোগী এই ঘটনার আগে জানতে পারেন না যে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অথচ অত্যন্ত গুরুতর এই অসুখকে আজও অধিকাংশ মানুষ পাত্তা দেন না যাঁরা এই রোগে আক্রান্ত হন, তাঁদের অনেকেরই গর্ভধারণের পর রক্তচাপ বেড়ে যায়। গর্ভস্থ ভ্রণের ওজন মাত্রাতিরিক্ত হয়। প্রসবের সময়েও নানা জটিলতা দেখা দেয়। গেস্টাশনাল ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেকে আবার প্রসবের পর টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। অথচ স্্েরফ সামাজিক বৈষম্যের কারণেই তাঁরা উপযুক্ত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন।
পরিশেষে বলা যায়, ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের সঙ্গে বাকীদের একটা স্পষ্ট বিভেদ আছে। এই সম্পর্কে সর্ব সাধারণকে সচেতন করলে তবেই একমাত্র এই রোগের মোকাবিলা করা সম্ভব। এই কাজে সর্বস্তরের মানুষকে শামিল করতে হবে। চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে দূরত্ব ঘোচাতে হবে। আক্রান্তদের কাছে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতে হবে। তাহলে এই মরণ ব্যাধিকে ঠেকানো সম্ভব।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ডায়াবেটিস


আরও
আরও পড়ুন