চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ইসলাম মানব জাতির জন্য আলাহ প্রদত্ত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাই মানুষের জৈবিক কার্যক্রমের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনাও এতে পাওয়া যায়। একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী সুন্দর সমাজ গড়তে ইসলামে কিছু জিনিসকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেগুলো দৃশ্যত মানব জাতির জন্য কল্যাণকর মনে হলেও আসলে তা মানবসমাজে বিশৃঙ্খলা বিস্তারের শক্ত হাতিয়ার। মানব জাতিকে আর্থিক ও চারিত্রিক ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা করতে ইসলাম যে ক’টি জিনিসকে নিষিদ্ধ করেছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে সুদ। প্রাথমিক অবস্থায় মানুষ অভাবের তাড়নায় সুদি লেনদেনে জড়িয়ে পড়লেও এখন তা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। যার ফলে এখন আর একে অপরাধ মনে করা হয় না।
অথচ মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন এ সুদ না খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেয়ো না। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণ অর্জন করতে পার। এবং তোমরা সেই আগুন থেকে বেঁচে থাক, যা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তোমরা আনুগত্য কর আলাহ ও তাঁর রাসূলের, যাতে তোমাদেরকে দয়া করা হয়।” (সূরা ইমরান : ১৩০-১৩২)
সুদ সম্পর্কিত বিষয়টি অত্যন্ত ভয়ানক। যা প্রকাশ্যে আলাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.)-এর বিরোধিতা ও তাঁদের নাফরমানী। আল্লাহ তা‘য়ালা সুদ দাতা, গ্রহিতা, লেখক ও স্বাক্ষীদের হুশিয়ারী পূর্বক স্মরণ করে দিয়ে ইরশাদ করেন, “যারা তাঁর নির্দেশের বিরোধিতা করে তারা যেন সতর্ক হয়ে যায় যে, তারা ফেতনায় পতিত হবে অথবা তারা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির সম্মুখীন হবে।” (সূরা নূর : ৩৬)
এই ভয়ানক সুদ কাবীরা গোনাহের অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় অর্থ-সম্পদের বরকতকে মিটিয়ে দেয় এবং আল্লাহর ক্রোধ বাড়িয়ে দেয়। সুদের কারণে আমল কবুল হয় না। রাসূলুলাহ (সা.) সেই ব্যক্তির কথা উলেখ করেন, যে দীর্ঘ সফর করে এলায়িত কেশ ও ধুলায়মান পোশাক নিয়ে অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে ডাকতে থাকে, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার রব! অথচ সে ব্যক্তির পানাহার সামগ্রী হারাম উপার্জনের, পোশাক-পরিচ্ছেদ হারাম পয়সায় সংগৃহীত, এমতাবস্থায় কী করে তার দু’আ কবুল হতে পারে? (সহিহ মুসলিম)
শুধু তাই নয়, নবী করিম (সা.) সুদের পাপের ভয়াবহতার পাশাপাশি লজ্জাজনক কবিরা গোনাহ বলে হাদিস শরীফে ইরশাদও করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, “সুদের মধ্যে সত্তরটির মত পাপ রয়েছে। তম্মধ্যে সবচেয়ে সহজ পাপটি হচ্ছে নিজ মায়ের সাথে ব্যভিচার করা।” (সহিহ ইবনে মাজাহ) অন্যত্র ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জেনে-শুনে এক দিরহাম পরিমাণ সুদ খায়, সে ব্যক্তির আমলনামায় আল্লাহ তা’য়ালার নিকট ৩৬ জন নারীর সাথে ব্যভিচারের চাইতে অধিক গুনাহ লিপিবদ্ধ করা হয়ে থাকে। (আহমাদ, সিলসিলায়ে সহিহা)
জাহান্নামের মধ্যে সুদখোরের শাস্তি সম্পর্কে একটি দীর্ঘ হাদিসে বলা হয়েছে। নবী করিম (সা.) স্বপ্নে দু’জন ফেরেশতার সাথে জান্নাত-জাহান্নাম দেখেছেন, জাহান্নামে বিভিন্ন অপরাধীদের শাস্তির ধরণ অবলোকন করেছেন। তিনি দেখেছেন, জনৈক ব্যক্তি একটি রক্তের নদীতে সাঁতার কাটছে। নদীর তীরে পাথর হাতে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন ব্যক্তি। লোকটি সাঁতার কাটতে কাটতে যখনই কিনারে আসছে তখন তীরে দণ্ডায়মান লোকটি পাথরটি তার মুখে নিক্ষেপ করছে, তখন সে পূর্বের স্থানে নদীর মধ্যে চলে যাচ্ছে। এভাবে যখনই সে নদী থেকে বের হতে চাচ্ছে, তখনই তাকে পাথর মেরে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে তার শাস্তি চলছেই। নদীর মধ্যের লোকটি হচ্ছে সুদখোর। (সহিহ বোখারী ও মুসলিম)
উপরোন্ত ক্বিয়ামতের কঠিন মাঠে জবাবদিহিতা তো করতেই হবে। প্রত্যেক মুসলমানের জানা উচিত যে, ক্বিয়ামতের মাঠে আল্লাাহ তা’য়ালা তাকে তার সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। কিভাবে সম্পদ উপার্জন করেছে? আর কোথায় তা খরচ করেছে? নবী করিম (সা.) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, “ক্বিয়ামতের দিন কোন মানুষের পা চলবে না যতক্ষণ সে চারটি প্রশ্নের উত্তর না দিবে। প্রশ্ন করা হবে, তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কোন কাজের মাঝে এ বয়স অতিবাহিত করেছে? তার জীবন সম্পর্কে কিভাবে তার আয়ু শেষ করেছে? তার সম্পদ সম্পর্কে কিভাবে তা উপার্জন করেছে? কোথায় ব্যয় করেছে? এবং তার জ্ঞান সম্পর্কে কি আমল করেছে সেই জ্ঞান দ্বারা? (সহিহ তিরমিজি)
সুদের এত গোনাহ, আজাব, লজ্জাজনক শাস্তি থাকার পরেও কেউ যদি সুদ না ছাড়ে তাহলে তার সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা স্পষ্ট বর্ণনা করেন, “অতঃপর তোমরা যদি সুদ না ছাড়, তবে অল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে নিজেদের মূলধন ফেরত পেয়ে যাবে। তোমরা কারো উপর অত্যাচার করো না এবং কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করবে না।” (সূরা বাক্বারা : ২৭৮-২৭৯)
সর্বোপরি সুদকে শুধুমাত্র ইসলামী নীতিতে জঘন্য পাপ হিসেবে আখ্যায়িত করে নাই। বরং সামাজিকভাবেও রয়েছে এর মারাত্মক পরিণতি। যা পত্র-পত্রিকার ভাষায় উলেখ করেছি।
সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় রাজশাহীর বাঘায় ব্যবসায়ীর জমি দখল করে ঘর নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে। (দৈনিক সমকাল ১৬ জুন ২০১৫)
কিছু এনজিও সংস্থা দাবি করে, তারা ঋণ দিয়ে হতদরিদ্রদের উপকার করছে। তাদের মুখোশ উম্মোচন করা হয়েছে পত্র-পত্রিকায়। চৌগাছায় সুদের টাকা দিতে না পারায় অনেকেই গ্রাম ছাড়া হয়েছে। এনজিওগুলোর ঋণের ফাঁদে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে চৌগাছার মানুষ। দরিদ্রপীড়িত এসব মানুষ এনজিওগুলোর ঋণের চড়া সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে জমি, হালের বলদ, টিনের ঘর, হাড়ি-পাতিল পর্যন্ত বিক্রি করে দিচ্ছে। তারপরও সেই দুর্ভেদ্য ফাঁদ থেকে বের হতে পারছে না ভুক্তভোগী হতদরিদ্র্ররা। (দৈনিক সংগ্রাম ৩০ অক্টোবর ২০১১)
সমাজে ব্যাঙের ছাতার ন্যায় আরেকটি সংগঠন গড়ে উঠছে সমিতি নামে। যা থেকে ঋণ প্রদানের নাম করে হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অসহায় মানুষের স্বাবলম্বী জীবন। রাজশাহীর তানোরে কামারগাঁ আদশর্ গ্রাম উন্নয়ন সমিতির আড়ালে দাদন (সুদ) ব্যবসার অভিযোগ উঠেছে। কথিত ওই সমিতি থেকে উচ্চ সুদে (দাদন) ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার পরিবর্তে অধিকাংশক্ষেত্রে সুদসহ ঋণ (দাদন) পরিশোধ করতে গিয়ে গ্রহিতারা সর্বস্বান্ত হচ্ছে। যে কারণে সমিতি থেকে (দাদন) ঋণ গ্রহিতা অধিকাংশ পরিবারে নেমে আসছে অশান্তি ও সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিরতা। (দৈনিক ইনকিলাব ১০ জুলাই, ২০১৬)
সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় সুদ গ্রহিতারা হচ্ছে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার। সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ঢাকা জেলার সাভারে আব্বাস আলী (৪৬) নামে এক ব্যক্তিকে শেকল বেঁধে ৩ দিন নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। (দৈনিক সমকাল ১৮ জানুয়ারি ২০১৬)
চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার লতরদী গ্রামে সুদের টাকা দিতে না পারায় বসতঘর ভেঙে নিয়েছে ওই গ্রামের মৃত মোখলেছুর রহমান মুফতীর ছেলে সুদী ব্যবসায়ী মোঃ সিরাজ। (দৈনিক আমাদের সময় ২৪ অক্টোবর ২০১৬)
সুদের টাকা না পেয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে এক ব্যক্তির গবাদিপশু ও ঘরের মালামাল লুট করে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে ওই পরিবারের চিংড়িঘর থেকে মাছ লুট করা হয়েছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। (দৈনিক প্রথম আলো ২৯ অক্টোবর ২০১৫)
সর্বোপরি সুন্দর সুস্থ্য জীবন ত্যাগ করে সুদ গ্রহিতারা করে নিচ্ছে আত্মহত্যা নামক মারাত্মক গোনাহের কাজ। বাগেরহাটের চিতলমারীতে ছোট ভাইয়ের সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় সুদ ব্যবসায়ীর হুমকিতে বড় ভাই গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে পারিবারিক সূত্রে দাবি করা হয়েছে। (দৈনিক ইত্তেফাক ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫)
লেখকঃ নির্বাহী পরিচালক
পানাহার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, করিমগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।