মোস্তফা-হাকিম ফাউন্ডেশনের মাহফিল সম্পন্ন
মোস্তফা-হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনায় ১০ মহররম পবিত্র আশুরা উপলক্ষে দশদিনব্যাপী শোহাদায়ে কারবালা মাহফিল গত মঙ্গলবার সম্পন্ন হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে ছিল আহলে বায়তের স্মরণে খতমে কোরআন,
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে শুরু হওয়া প্রায় আড়াই-তিন মাসের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির শেষে এক অগ্নিগর্ভ মুহূর্তে, জিয়াউর রহমান বীর উত্তম সেনাবাহিনীর দায়িত্বের অতিরিক্ত, কিন্তু অবশ্যই পরোক্ষভাবে, পুরো দেশ ও জাতির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। বিভক্ত জাতিকে সংহত করার কঠিন প্রক্রিয়া শুরু করেন। ৭ নভেম্বরের বিকাল বেলা থেকেই পরবর্তী দেড়-দুদিনের চ্যালেঞ্জ ছিল, সৈনিকদের হাতে হাতে ঘুরছিল যেই অস্ত্র, সেই অস্ত্রকে অস্ত্রাগারে ফেরত আনা; পথে পথে ঘুরছিল যেই সৈনিক, সেই সৈনিকগণকে নিজেদের ব্যারাকে ফেরত আনা। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত শান্ত কিন্তু দৃঢ় মনোভাব ও বক্তব্যের মাধ্যমে, সৈনিকদের ওপর অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃস্থাপনের কাজটি শুরু করেন। সৈনিকরা যেন অস্ত্র জমা দেয় সেটি নিশ্চিত করেন। সৈনিকদের মনের ভেতরে পুঞ্জিভূত কষ্টগুলো দূর করার জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দুই দিনের পুরানো একজন প্রেসিডেন্ট ছিল যথা ৫ নভেম্বর তারিখ সকালে নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। কোনো মন্ত্রীসভা ছিল না। ওই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট সায়েম বাংলাদেশ কীভাবে পরিচালনা করতেন সেটা একটি গবেষণার বিষয়। সেই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট সায়েম, জিয়াউর রহমান এবং অন্য তিনজন বাহিনী প্রধানের সহায়তা গ্রহণ করেন এবং বাস্তবসম্মত এবং যৌক্তিক কারণেই বৃহত্তম বাহিনী তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যিনি প্রধান, সেই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সহায়তা তিনি সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করেন। অনেকদিন ধরে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট তথা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সায়েম এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ মোট তিনজন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মিলেই, সরকারের নীতি নির্ধারণী দায়িত্ব পালন করেন। একটি কঠোর ও গভীর গভর্নান্সে ক্রাইসিস থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করেছিলেন জিয়াউর রহমান ও তার সহকর্মীরা। উদারভাবে মূল্যায়ন করলে, এটা বলাই যায় যে, একান্তভাবেই হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করেছিল বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব। সেই কারণে অভিনন্দন পাবেন জিয়াউর রহমান এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এই অনুচ্ছেদে আমি বীর উত্তম জিয়াউর রহমান এবং ৭ নভেম্বর প্রসঙ্গে যেই মূল্যায়ন আমার ভাষায় প্রকাশ করলাম, সেটার সমর্থনে, পেছনের কিছু কথা এবং পরিস্থিতিরও বর্ণনা তথা মূল্যায়ন প্রয়োজন; আলবৎ অতি সংক্ষিপ্তভাবে।
পঁচাত্তরের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনাবলির উৎপত্তি বা শিকড়, নভেম্বরেই নিহিত নয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বাকশাল কায়েম হয়েছিল। কাজটা অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল। এর পরের সপ্তাহ এবং মাসগুলো আপাত দৃষ্টিতে বা ওপরে ওপরে ভালো ছিল বা শান্ত ছিল; কিন্তু গভীরে ভালো ছিল না। এখন পেছনের দিকে তাকিয়ে পরিণত বয়সে জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি যে, ওই আমলের বাংলাদেশের রাজনীতির স্রোত, জনমতের স্রোত ও প্রশাসনের আনুগত্যের স্রোত দুটি ভিন্ন দিকে যাচ্ছিল। দৃশ্যমান উপরের অংশ সরকারের অনুক‚লে বহমান ছিল; অদৃশ্যমান গভীর জলের অংশ সরকারের প্রতিকূলে ছিল তথা উল্টো দিকে ছিল। তৎকালীন অনুগত মিডিয়ায় এবং মিডিয়ার বাইরে ব্যক্তি ও সমষ্টিগত পর্যায়ে সরকারের বন্দনার প্রতিযোগিতা চলতো। সরকারের কর্মকান্ডের সমালোচনার অবকাশ বা সুযোগ খুবই সীমিত ছিল। আমরা ১৯৭৫ সালের কথা বলছি। এরকম একটা পরিস্থিতিতে আগস্ট মাস এসে গিয়েছিল। দেশের ভেতরের কিছু অপ্রীতিকর কারণ, দেশের বাইরের কিছু ষড়যন্ত্রমূলক কারণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। সবকিছুর ফলশ্রুতিতে ঘটেছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড। ১৫ আগস্ট দিনটি শোকাবহ। এর পরবর্তী দিন-সপ্তাহ-মাসগুলো ইতিহাসের নিরিখে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা একটি দিন নিয়ে এখানে আলোচনা করছি। সেটি হলো ৭ নভেম্বর ১৯৭৫।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের আঙ্গিকে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তারিখের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫; সিপাহী জনতার বিপ্লব দিবস। আজকের কলামটি, এই প্রসঙ্গে। সঠিক ইতিহাস জানার স্বার্থে এবং সেই ইতিহাস থেকে উপযুক্ত শিক্ষা (ইংরেজি পরিভাষায় : লেসন) আহরণের স্বার্থে আমাদের ৭ নভেম্বর প্রসঙ্গে জানা প্রয়োজন। জানার জন্য উৎস হচ্ছে ওই আমলে জড়িত ব্যক্তিদের বা সাক্ষীদের মুখের বক্তব্য অথবা লিখিত বই অথবা কলাম। ইতোমধ্যে অনেক কলাম ও বই প্রকাশিত হয়েছে। একটি মাত্র কলামে যেহেতু পূর্ণ ধারণা দিতে পারবো না, এবং কোনো পাঠক যেন এই তাৎপর্যপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়টিতে আমাকে ভুল না বোঝেন, সেহেতু আমি আমার নিজের লেখা বইয়ের রেফারেন্স এখানে দিচ্ছি। ‘মিশ্র কথন’-এর পঞ্চম অধ্যায়টির নাম ‘১৯৭৫ : রাজনৈতিক ইতিহাসে বিভাজন রেখা’ পুস্তকের ১৪৬ থেকে ১৯৩ পৃষ্ঠায় নভেম্বরের ঘটনাবলি নিয়েই আলোচনা আছে।
১৫ আগস্টের ঘটনার নায়ক একজন নয়; সংখ্যায় একাধিক এবং একাধিক অঙ্গনের। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যম ও কনিষ্ঠ সারির কিছু অফিসার একটা আঙ্গিকের ও একটি অঙ্গনের নায়ক। দুই একটা উদাহরণ দেই। তৎকালীন ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সংগঠনভুক্ত তথা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রমের কমান্ডের অধীনে থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি, ঘটনাবলিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। অর্থাৎ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলের অগোচরে, আর্টিলারি রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ, তলে তলে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং বাস্তবেও বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেনাবাহিনী সদর দফতর বা আর্মি হেড কোয়ার্টারের চিফ অব দি জেনারেল স্টাফ (সংক্ষেপে সিজিএস)-এর কমান্ডের অধীনে থাকা অবস্থায় বা সিজিএসের সরাসরি অধীনস্থ থাকা অবস্থায়, তৎকালীন সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের অগোচরে বা গোপনে গোপনে বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিয়েছিল ও বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল একটি সঁাঁজোয়া ইউনিট বা আর্মাড কোরের রেজিমেন্ট যেটির নাম ছিল : প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সার। অর্থাৎ সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অগোচরে এবং গোয়েন্দাদের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে তলে তলে ল্যান্সারের অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছিলেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অন্যান্য চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। এটা গেল একটা আঙ্গিকের ও একটি অঙ্গনের কথা। এখন অন্য একটি আঙ্গিকের কথা বলি। স্বাধীনতার পূর্বেকার পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই দশকের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও সহচর ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধকালীন বঙ্গবন্ধুর নামের ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী সরকারের মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন কেবিনেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। এই খন্দকার মোশতাকের সঙ্গী ২০০ এর অধিক আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য ছিলেন আরেকটি আঙ্গিকের নায়ক বা নায়কমন্ডলী। দেশের বাইরের নায়কদের নামও এতদিনে সকলের প্রায় জানা হয়ে গিয়েছে। তবে সেনাবাহিনী থেকে যারা জড়িত ছিলেন- তাদের নিয়ে যত কথাবার্তা হয়েছে এবং বিদেশি নায়ক বা নায়কমন্ডলী নিয়ে যত কথাবার্তা হয়েছে, তার থেকে বহু অংশে কম আলোচনা-সমালোচনা পর্যালোচনা হয়েছে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন বঙ্গবন্ধুবিরোধী ১৫ আগস্ট পরবর্তী আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের নিয়ে।
আমরা ১৯৭৫-এর কথা বলছি। ওই আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও, অর্থাৎ ৭৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ অংশ, বা সেনাবাহিনীর উচ্চতম পর্যায়ের অফিসাররা ব্যস্ত এবং তৎপর ছিল তাদের ওইসব সদস্যদেরে নিয়ে, যারা ১৫ আগস্টের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ওই আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ এবং মধ্যম সারির বেশির ভাগ কর্মকর্তার চিন্তা ছিল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারদের ভেঙে যাওয়া চেইন-অব-কমান্ডকে জোড়া লাগানো বা পুনস্থাপন করা। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, কেন? যেহেতু ১৫ আগস্টের ঘটনায় জড়িত অফিসাররা, তাদের উপরোস্থ জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের অনুমতি ছাড়াই গিয়েছিলেন, তাদের কী হবে, এটাই ছিল বিবেচ্য বিষয়। আগস্টের ২৪ তারিখ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। সেনাবাহিনী অত্যন্ত ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছিল। ১৯৭২ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি হওয়া জাতীয় রক্ষীবাহিনী বা জেআরবি নামক সংগঠনটিকে ভেঙে দেয়া হয়নি বা বাতিল করা হয়নি কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যেই বা সেনাবাহিনীর ভেতরে একীভ‚ত বা আত্মীকৃত করে ফেলা হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, জাতীয় রক্ষীবাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য রণাঙ্গণের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সিদ্ধান্ত প্রদানকারী ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের সাথে যে সকল স্টাফ অফিসার কাজ করছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছিলাম আমি। ওই সুবাদে বলছি যে, সময় খুব ব্যস্ত ছিল এবং ঝঞ্ছা-বিক্ষুব্ধ ছিল। এর মধ্যে চাপা অবস্থায় বিরাজমান ছিল ওই দ্ব›দ্ব। দ্ব›দ্বটি কী? দ্ব›দ্বটি হলো- যারা ১৫ আগস্ট সংঘটিত করে ফেলেছে তারা কোথায় যাবে কোন অবস্থায় থাকবে, কোন দায়িত্বে থাকবে? নাকি, তাদের দ্বারা কৃত কর্মটিকে শৃঙ্খলা ভঙ্গ বিবেচনা করত সেটার বিহীত করা হবে? সমাধান পাওয়া যাচ্ছিল না; ঐক্যমত সৃষ্টিতে বিলম্ব হচ্ছিল।
এইরূপ পরিস্থিতিতেই, ওই আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরে কর্মরত, সুনামধারী, মেধাবী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সাহসী সেক্টর কমান্ডার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম মহোদয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিবাদী কর্মকান্ড (অথবা কারো কারো দৃষ্টিতে সংশোধনমূলক কর্মকান্ড) সংঘটিত হয়। সামরিক পরিভাষায় বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় এটি ছিল একটি কু-দ্যতা। বাংলায় বলা যেতে পারে সামরিক অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থানের অংশ হিসেবে, খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম তার উপরোস্থ কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেছিলেন। অভ্যুত্থানের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়, ১৫ আগস্টের সশস্ত্র নায়কেরা, ঢাকা মহানগরের কেন্দ্রীয় জেলখানায় বন্দি অবস্থায় থাকা চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করেন অথবা হত্যা করান। অভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ.এস.এম. সায়েম-কে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়েছিল; মোশতাক কর্তৃক জারি করা সামরিক শাসন অব্যাহত ছিল। কিন্তু কিছু লক্ষণ (ইংরেজি পরিভাষায় সিমটম)-এর কারণে, খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানটি রাজনৈতিক অঙ্গনে, সচেতন জনগণের এবং সৈনিকগণের মনের ভেতরে, একটি ভারতপন্থি অভ্যুত্থান হিসেবে রং পায়। সচেতন জনগণ ও সৈনিকগণ এটা পছন্দ করেনি। পরবর্তীতে বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট হয়েছিল; কিন্তু ততদিনে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা, লে. কর্নেল এটিএম হায়দার বীর উত্তমের মতো মুক্তিযোদ্ধারা বিগত হয়ে গিয়েছেন।
৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ঘটনার পর, আরেকটা গোপন গোষ্ঠী সক্রিয় হয়। তৎকালীন জাসদের অনুপ্রেরণায়, পৃষ্ঠপোষকতায়, আগ্রহে এবং প্রয়োজনে (১৯৭৩-এর শেষাংশ থেকে) তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে একটি গোপন সংগঠন কাজ করতো। সংগঠনটির নাম ছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। এই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সেনাবাহিনীর বাইরের একটি সংগঠন, সেটি ছিল জাসদ নামক রাজনৈতিক দলের গোপন অঙ্গ সংগঠন, যার নাম ছিল গণবাহিনী। জাসদ নামক রাজনৈতিক দলের আনুষ্ঠানিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও আরও একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন জাসদের গণবাহিনীর প্রধান, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, অন্যতম মেধাবী সাহসী সেনা কর্মকর্তা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম এ তাহের বীর উত্তম। জাসদ, জাসদের গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা চাচ্ছিল একটা বড় রকমের বিপ্লব সাধন হোক। এই লক্ষ্যে তারা কাজ করছিল অনেকদিন ধরেই। ৩ নভেম্বরের ঘটনা ঘটে যাওয়ায় তারা সকলেই অস্থির হয়ে পড়লো এবং মনে করলো ‘আবার কোনো অপরিকল্পিত ঘটনা হঠাৎ এসে তাদের বিপ্লবের পক্ষে বাধার সৃষ্টি করে। তাই, তারা স্থির করলো ৭ নভেম্বর তারিখে তাদের কাজটি করে ফেলবে। তাদের মধ্যে যারা চরমপন্থি ছিল বা উগ্রপন্থি ছিল তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে, সেনাবাহিনী হতে হবে অফিসারমুক্ত। তারা ঘোষণা দিল ‘সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই।’
ঠিক একই সময়ে, অর্থাৎ ৩ নভেম্বরের পরপর দিনগুলোতে অন্যান্য স্তরে প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে আলোচনা ও চিন্তা চলছিল, জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে বন্দি দশা থেকে মুক্ত করতে হবে। জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয়েছিল, এই কাজটিকে সাধারণ সৈনিকরা কোনোমতেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি; সাধারণ সৈনিকরা বেদনাহত হয়েছিলেন। ইংরেজি পরিভাষায় বলা যেতে পারে, রাইটলি অর রংলি, অর্থাৎ সঠিক হোক বা বেঠিক হোক, ৪ ও ৫ নভেম্বর তারিখের মধ্যেই ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে, যদি জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা না যায়, তাহলে দেশ বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। অতএব জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতেই হবে। বলাই বাহুল্য, জিয়াউর রহমান দেশবাসীর নিকট সুপরিচিত ছিলেন, প্রথমে নিজের নামে ও পরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার কারণে। জিয়াউর রহমান সুপরিচিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের অন্যতম জ্যেষ্ঠ সেনাপতি হিসেবে এবং সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন একজন ডায়নামিক ও ক্যারিশমেটিক সেনাবাহিনী উপ-প্রধান এবং পরবর্তীতে প্রধান হিসেবে। ১৯৭২ এর এপ্রিলে সকলেই আশা করেছিল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান হবেন। কিন্তু যে কোনো কারণেই তখনকার সরকার তাকে সেনাবাহিনী প্রধান বানাননি। বানিয়েছিলেন তারই ব্যাচমেট বা কোর্সমেট কিন্তু জ্যেষ্ঠতার তালিকায় জুনিয়র, তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত ও তুলনামূলকভাবে কম ক্যারিশমেটিক তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার কে এম সফিউল্লাহ কে। জিয়াউর রহমানকে বানানো হয়েছিল উপ-সেনাবাহিনী প্রধান। যথাক্রমে সেনাবাহিনী প্রধান বা উপ-প্রধান নিযুক্ত হওয়ার কিছুদিন পর, সফিউল্লাহ এবং জিয়াউর রহমান উভয়েই মেজর জেনারেল হন। সৈনিকগণের এইরূপ মানসিক প্রেক্ষাপটে, ৩ নভেম্বরের পর থেকেই নিজ বাসভবনে গৃহবন্দি জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার কাজটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছিলেন সাধারণ সৈনিকরা।
খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের নিয়ম মোতাবেক, ৬ নভেম্বর দিনের শেষে রাত ১২টায় তারিখ বদলে যায়; এবং নতুন দিন তথা ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ শুরু হয়। সৈনিকদের বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই সৈনিকদের বিপ্লবটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। বড় অংশ ছিল অরাজনৈতিক মনোভাবসম্পন্ন নিখাদ বাংলাদেশ প্রেমিক, জিয়া-প্রেমিক সৈনিকরা। ছোট অংশ ছিল জাসদের প্রভাবান্বিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যগণ ও অনুসারীগণ। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই ঢাকা মহানগরের জনগণ জড়িত হতে থাকেন। সূর্য উদয়ের ঘণ্টা দুয়েকের আগে থেকেই, ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈনিকেরা মহানগরে ছড়িয়ে পড়ে। রাতের মধ্যেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন অংশে, একাধিক অফিসার ও অফিসারের পত্মী বিদ্রোহী বা বিপ্লবী সৈনিকদের হাতে নিহত হন। তবে কেউ কাউকে চিহ্নিত করতে পারেননি। আমি ব্যক্তিগতভাবে, এই পর্যায়ে আমার মুক্তিযুদ্ধকালীন ব্যাটালিয়ন, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত থেকে ঘটনাবলির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকগণ কোনো কিছুর সাথে-পাঁচে ছিলেন না, কিন্তু ৭ তারিখের প্রথম প্রহর তথা রাত একটা-দেড়টা থেকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাপন্থি অর্থাৎ বিপ্লবী সৈনিকগণ, শান্তিপ্রিয় শৃঙ্খলাপন্থি দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনদিক থেকে বৈরী প্রচারণা এবং আক্রমণাত্মক কর্র্মকান্ড প্রকাশ্যে শুরু করে। উপস্থিত জ্যেষ্ঠতম অফিসার হিসেবে, আমি পুরো ব্যাটালিয়নকে নিয়ন্ত্রণে রাখি। জাসদপন্থি বিপ্লবী সৈনিকরা যেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সীমানার ভেতর অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করি। কোনো অবস্থাতেই যেন, যে যেই পন্থিই হোক না কেন, সৈনিকে-সৈনিকে পারস্পরিক গোলাগুলি বিনিময় না হয়, সেটা নিশ্চত করার জন্য পন্থা আবিষ্কার করি। অতঃপর দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকগণকে সিপাহী-জনতার বিপ্লবে যোগদানে সহায়তা করি। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫। জাসদপন্থি সৈনিকদের ও জাসদ কর্মীদের বিপ্লব সূর্য উদয়ের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই, পানিতে যেমন চিনি গলে যায় ওইরকমভাবে বিলীন হয়ে যায়। জীবিত থাকে এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে জিয়া অনুরাগী হাজার হাজার সৈনিকের এবং হাজার হাজার জনগণের সম্মিলিত বিপ্লব। সেই অবধি এই দিনের নাম হয়েছে সৈনিক জনতার বিপ্লব বা সিপাহী জনতার বিপ্লব তথা বিপ্লব ও সংহতি দিবস।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ইমেইল : [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।