মোস্তফা-হাকিম ফাউন্ডেশনের মাহফিল সম্পন্ন
মোস্তফা-হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনায় ১০ মহররম পবিত্র আশুরা উপলক্ষে দশদিনব্যাপী শোহাদায়ে কারবালা মাহফিল গত মঙ্গলবার সম্পন্ন হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে ছিল আহলে বায়তের স্মরণে খতমে কোরআন,
প্রথমেই বিষয়টির স্পর্শকাতরতা আলোচনা করি। ৭ নভেম্বর আসলেই আলোচনা এবং সমালোচনা হয়। তিনজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা যথা জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, ব্রিগেডিয়ার (অথবা মেজর জেনারেল) খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম এবং কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম আলোচনার কেন্দ্রে আসেন। গলায় জোর বেশি, প্রচারে জোর বেশি, বাস্তবতায় দুর্বল এমন যারা তারা জিয়াউর রহমানকে হেয় করে কথা বলেন। আমি এর প্রতিবাদ করি। তিনজনই আমাদের সম্মানিত ব্যক্তি; সম্মান নিয়েই আলোচনা করতে হবে। প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে এই অনুচ্ছেদটি দিচ্ছি। অতঃপর মূল ঘটনায় যাবো। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখে অনেক অফিসার নিহত হয়েছিলেন, তাদের হত্যাকারী কে? বেশিরভাগের হত্যাকারী জাসদপন্থী সৈনিক সংস্থা বা জাসদের গণবাহিনী? হত্যাকারীদের নির্দেশদাতা কে? উত্তর, এই কলামে আমি বিস্তারিত আলোচনা করতে না পারলেও পাঠক বুঝে নেবেন। ৭ নভেম্বর তারিখে ব্যর্থ হয়ে, পুনরায় সৈনিক বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন জাসদ। পুনরায় সেনানিবাসের অভ্যন্তরে সৈনিকগণকে সংগঠিত করা শুরু করেছিলেন, জিয়াউর রহমানকে উৎখাত করার নিমিত্তে। সৈনিকগণের মধ্যে রাজনীতি ঢুকিয়েছিল তৎকালীন জাসদ। ৭ নভেম্বরের আগে এবং ৭ নভেম্বরের পরে দুই কিস্তিতে সেনাবাহিনীর সৈনিকদের মধ্যে রাজনীতি ঢোকানোর কাজটি, রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ ছিল। ৭ নভেম্বরের পরের চেষ্টা, আগের চেষ্টা থেকে বেশি বিপজ্জনক বিবেচিত হয়েছিল। জাসদের ঐ সকল কাজের কুফল পরবর্তী পাঁচ বছরতো বটেই, তিরিশ-চল্লিশ বছর পর্যন্ত লক্ষ্যণীয় ছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে যে কয়টি ব্যর্থ সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান বা বিমান বাহিনীর অভ্যুত্থান হয়, প্রত্যেকটির সঙ্গে জাসদ কর্তৃক শিক্ষা দেয়া শ্রেণীবিহীন সমাজ ব্যবস্থা ও অফিসারবিহীন সামরিক ব্যবস্থার কু-মন্ত্র কাজ করেছে। অফিসারগণকে হত্যা করার যে রেওয়াজ ৭ নভেম্বর তারিখে স্থাপিত হয়েছে, তার কুফল ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা মহানগরের পিলখানা পর্যন্ত এসেছে। ১৯৭৭-এ বগুড়ায় ব্যর্থ বিদ্রোহে, সেনাবহিনীর অফিসার হত্যা করা হয়। ১৯৭৭-এ ঢাকায় ব্যর্থ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সৈনিকগণের বিদ্রোহে, অনেক বিমান বাহিনীর অফিসারকে হত্যা করা হয়। প্রত্যেকটি ব্যর্থ বিদ্রোহ দমন করার কাজে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকেই দায়িত্ব পালন করতে হয়, আদেশপ্রাপ্ত হয়ে। ১৯৭৫ এরপর, পরবর্তী পাঁচ বছরের রক্তাক্ত ইতিহাসের পিছনে ইন্ধন যুগিয়েছে ১৯৭৫। পিলখানায় নিহত ৫৭ জন অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে, যার রহস্য সন্তোষজনকভাবে উদঘাটিত এখনও হয়নি। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এর জাসদপন্থী বিপ্লবীগণ, সৈনিক হোক বা সাধারণ নাগরিক হোক, যদি বিপ্লবে সফল হতেন, তাহলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কী হতো, বাংলাদেশ সরকারের কী হতো এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার কী হতো? আলোচনা কঠিন, উত্তর ততোধিক কঠিন। আমি নিজে সবজান্তা নই, আমি জানতে আগ্রহী, অন্যদেরকেও জানতে আহ্বান জানাই। এই প্রেক্ষাপটেই নিচের কয়েকটি অনুচ্ছেদ পড়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
১৯৭৫ এর নভেম্বরের ৭ তারিখে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিকগণ একটি বিপ্লব সাধন করেন; সেই বিপ্লবে ঢাকা মহানগরের জনগণ ব্যাপকভাবে যোগ দিয়েছিলেন। অতি স্বাভাবিক প্রশ্ন, এই ৭ তারিখে কেন বিপ্লবটি সাধন হলো? ৭ তারিখের বিপ্লবের কারণ পিছনের দিকে মাত্র চারদিন বা মাত্র চার মাসের ঘটনাবলীর মধ্যে লুকায়িত নেই; বরং ৭ তারিখের বিপ্লবের কারণগুলো ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে পিছনের দিকে ৩ বছর ১০ মাসের ঘটনাবলীর মধ্যে লুকায়িত। গত আট-নয় বছর যাবত পত্র-পত্রিকায় এবং টেলিভিশন টকশোতে এমনভাবে কথাগুলো লেখা হয় বা বলা হয় যে... “জিয়াউর রহমান বীর উত্তম বিদ্রোহ করেই ক্ষমতা দখল করেন এবং তার আগে বাংলাদেশে আর কোনো কিছু ঘটেনি!” এইরূপ বর্ণনা বা ধারণা প্রচার করা ইতিহাসের সঙ্গে ইচ্ছাকৃত বৈরিতা। আমি সবাইকে আহ্বান জানাই, ১৯৭২ থেকে ৭৫ এই সময়কালে বাংলাদেশের অবস্থা কেমন ছিল, শাসনে ও রাজনীতিতে কী কী সুবিধা-অসুবিধা ছিল, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র কী ছিল ইত্যাদি জানতে? তাহলেই মাত্র ৭ নভেম্বরের তাৎপর্য বোঝা যাবে।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য, সন্দেহাতীতভাবে, প্রধান স্থপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান। ২৫ মার্চ ১৯৭১ দিনের শেষে মধ্যরাত্রে তিনি গ্রেফতার হন। তার প্রকাশ্য ভূমিকার সেখানেই ক্ষান্তি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নামে---এটাই বাস্তবতা। কারণ, বঙ্গবন্ধুর কোনো বিকল্প ছিল না। ১০ জানুয়ারির পর সেই বঙ্গবন্ধুর সামনে অনেকগুলো কঠিন প্রশ্ন ছিল। একটি কঠিন প্রশ্ন ছিল এই: নতুন বাংলাদেশের নতুন সরকার কি শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ দলীয় হবে নাকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে হবে? বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারীগণ রাজনীতির ময়দানে থেকেই যায় এবং তাঁরাই জাসদ সৃষ্টি করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের চারটি নীতিমালার একটি ছিল সমাজতন্ত্র; জাসদ এটিকে পরিমার্জিত করে তাদের নীতিমালা বানায়: ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’। জাসদের জন্ম ও নেতৃত্ব নিয়ে বই হয়েছে; আগ্রহী পাঠককে পড়ার আবেদন রাখছি। আমার নিজের লেখা বই ‘মিশ্র কথন’ এর মধ্যেও একটি দীর্ঘ অধ্যায় আছে ১৯৭৫-এর নভেম্বর নিয়ে।
রাজনৈতিক দল জাসদ এবং গোপন সৈনিক সংস্থার মধ্যে যোগসূত্রের বিষয়টি আলোচনা করছি। ১৯৭২ এর শেষাংশ এবং ১৯৭৩ জাসদ তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরে প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে লিপ্ত থাকে। অপরপক্ষে সরকারের পুলিশ এবং জাতীয় রক্ষীবাহিনী ব্যস্ত থাকে জাসদের কর্মী ও সমর্থকগণের বিরুদ্ধে কঠোর অপারেশন চালায়। এইরূপ প্রেক্ষাপটে জাসদ আত্মসমালোচনায় লিপ্ত হয়েছিল। জাসদ চিন্তা করলো সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে বা কিছু সংখ্যক সৈন্যগণ অনানুষ্ঠানিকভাবে জাসদকে সহযোগিতা না করলে, বঙ্গবন্ধু সরকারকে হটানো যাবে না। সুতরাং সিদ্ধান্ত হলো, ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বন্ধু খোঁজ করো। ১৯৭২-৭৩-৭৪ এর কথা। নতুন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পাকিস্তান থেকে যারা ফেরত এসেছেন তাঁরা এবং যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তাঁরা, সম্মিলিতভাবে একতাবদ্ধভাবে সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন এই কথা যেমন সত্য, তেমনই সত্য যে, উভয়ের মধ্যে প্রচন্ড মতপার্থক্য ও মানসিক দমন নিপীড়নের প্রক্রিয়াও ছিল। কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা সৈনিক, দেশ পরিচালনার নিয়ম, বিদ্যমান পরিস্থিতি বিশেষত দুর্র্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি প্রসঙ্গে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিল। তারা বিদ্যমান আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবর্তন চায়। তারা সমাজতান্ত্রিক এবং মেহনতি মানুষের সরকার চায়। তারা অফিসারবিহীন সামরিক বাহিনী চায় এবং শ্রেণীবিহীন সমাজ চায়। তারা নিজেদেরকে গোপনে গোপনে সংগঠিত করলো। নাম দিল গোপন সৈনিক সংস্থা। সুবেদার-নায়েব সুবেদার-হাবিলদার-নায়েক-সৈনিক ইত্যাদি বিভিন্ন র্যাংকের সাধারণ সৈনিক গোপনে নিজেদের তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকলো। অবসর নিয়েছে এমন সমমনা কিছু সৈনিক সাহায্য সহযোগিতা করতো। কিছুদিন পর, মনে করুন বছর খানেক পর, গোপন সৈনিক সংস্থা মনে করলো যে, তাদের দ্বারা একা একা সরকার পরিবর্তনের কাজ সম্ভব নয়। তাদের রাজনৈতিক বন্ধু প্রয়োজন। অতএব ক্যান্টনমেন্টের বাইরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অ্গংনে বন্ধু খোঁজা শুরু হলো। এইভাবেই জাসদ এবং গোপন সৈনিক সংস্থার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন এবং বন্ধুত্ব সৃষ্টি হলো।
সম্মানিত এবং প্রখ্যাত, আলোচিত ও সমালোচিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কর্নেল তাহের প্রসঙ্গে দু’চারটি লাইন বলছি। অমিত সাহসে মুক্তিযুদ্ধ করা একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম; যুদ্ধের ময়দানেই তিনি তাঁর একটি পা হারিয়েছিলেন। ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার ব্যক্তি ছিলেন এবং যুদ্ধের পরে বঙ্গবন্ধু সরকারের সমালোচনা করেছিলেন প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে। চাকরি চলে গেল তাহেরের। তাহের যোগদান করলেন বাঘের মতো তেজদীপ্ত জাসদে। আবু তাহের বীর উত্তমকে পেয়ে, জাসদের সংগ্রামী চিন্তায়, ব্যতিক্রমী চিন্তায় জোয়ার এলো। সিদ্ধান্ত হলো, গণবাহিনী সৃষ্টি করা হবে। সামরিক বাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর বিকল্প বা সমান্তরাল। জাসদ ক্ষমতায় যাওয়ার পথে এবং ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই যেন মাঠে ময়দানে শক্তি পায়, সেজন্যই গণবাহিনীর সৃষ্টি। সার্বিক জাসদের অতি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এবং গণবাহিনীর বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত হন কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম। হাসানুল হক ইনু ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও জ্যেষ্ঠ নেতা। গণবাহিনী এবং গোপন সৈনিক সংস্থার মধ্যে বন্ধুত্ব জোরদার হলো। উভয়ের লক্ষ্য মাত্র একটি, আওয়ামী লীগ তথা বাকশাল সরকারকে হটাও। যেহেতু সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের কোনো রাস্তা তারা খুঁজে পাচ্ছিল না তাই জাসদ, জাসদের গণবাহিনী এবং গোপন সৈনিক সংস্থা সিদ্ধান্ত নিল যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের একটিই মাত্র রাস্তা খোলা আছে, সেটাই অবলম্বন করতে হবে, যদিও রে রাস্তাটির নাম বিপ্লব বা রক্তাক্ত বিপ্লব।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এবং ৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এর ঘটনাবলীর মধ্যে যোগসূত্র ছিল কি ছিল না সেটি আলোচ্য বিষয়। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর ঘটনার জন্য জাসদ প্রস্তুত ছিল না। ঘটনা ঘটাবার মূল নায়ক খন্দকার মোশতাক এবং কয়েকজন মেজর বা লেফটেনেন্ট কর্নেল। মেজরগণ ১৫ আগস্টের সাফল্যের পর, বঙ্গভবনে স্থান করে নিলেন এবং সেখান থেকে বের হয়ে সেনানিবাসে ফেরত এসে মূল দায়িত্বে যোগদান করতে চাইলেন না। তাদের থেকে যারা জ্যেষ্ঠ অফিসার ছিলেন, তারা মনে করলেন এটা তো সাংঘাতিক বিশৃংখলা। যে কোনো নিয়মেই হোক না কেন বিদ্রোহী মেজরগণকে সেনানিবাসে ফেরত আনতে হবে। ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে নতুন সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। জিয়ার কাছে এসব বক্তব্য যখন উপস্থাপিত হতো, তিনি ধৈর্য ধরে শুনতেন কিন্তু সমাধান দিতে সময় নিচ্ছিলেন। অন্যান্য জ্যেষ্ঠ অফিসারগণ অস্থির এবং অধৈর্য হয়ে উঠলেন। অস্থির এবং অধৈর্য হয়ে তাঁরা তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম এর নেতৃত্বে একগুচ্ছ হলেন। তৎকালীন ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম খালেদের সহায়তায় এগিয়ে আসলেন। জিয়াউর রহমান যেমন ক্যারিশমেটিক যোদ্ধা ও নেতা ছিলেন, তেমনই খালেদ মোশাররফেরও একটি নিজস্ব ক্যারিশমা ছিল, যদিও উভয়ের মধ্যে দারুণ পার্থক্য। সম্মানিত খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সঙ্গীগণ ঠিক করলেন একটি ক্যু-দ্য-তা বা সেনাবিপ্লব ঘটাবেন। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এ, ১৫ আগস্টের বিপরীতে প্রতি বিপ্লব (কাউন্টার ক্যু) ঘটে গেল। জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হলো সেনানিবাসের বাসায়, সেনাপ্রধানের পদ থেকে পদচ্যুত করা হলো। দুইদিন পর, খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম নিজে প্রমোশন নিয়ে মেজর জেনারেল হলেন এবং সেনাবাহিনী প্রধান হলেন। ৬ তারিখ সন্ধ্যায় নতুন প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সায়েম।
এই প্রসঙ্গের যে কোনো আলোচনায় চারটি পয়েন্ট উল্লেখযোগ্য। প্রথম. খালেদ মোশাররফ মহোদয়ের ভাই এবং মা ঢাকা মহানগরে মিছিল করলেন এবং এমন কিছু কথাবার্তা বললেন যে, সকলেই ধরে নিল ৩ তারিখের সেনাবিপ্লব ভারতপন্থী; আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় স্থাপনের জন্য করা হয়েছে। ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে, অফিসার ও সৈনিকগণের মধ্যে এই ধারণা ব্যাপক প্রচার পেল যে, সম্মানিত খালেদ মোশাররফ এবং তাঁর সঙ্গীগণ ভারতপন্থী এবং ভারত তাঁদের কর্মকে স্বাগতম জানায়। দ্বিতীয়. ৩ তারিখেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঐ সময় বন্দী বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী স্তরের চারজন জাতীয় নেতা, মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি নিহত হলেন। তাৎক্ষণিক চিন্তা শুরু হলো কে হত্যা করালো, কে সহযোগিতা করলো হত্যাকান্ডে, কে উপকার পেল এই হত্যাকান্ডের পরে? তৃতীয়. সর্বস্তরের সাধারণ সৈনিকগণ বললেন, জিয়াউর রহমানকে পদচ্যুত করা বন্দী করা অত্যন্ত অন্যায় কাজ এবং এর বিহিত চাই। তারা তাদের মাসনিক বিক্ষুব্ধতা প্রকাশ করতে থাকলেন। চতুর্থ এবং শেষ। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখের ঘটনায়, জাসদ ও গোপন সৈনিক সংস্থা নিজেরাই রাজনৈতিকভাবে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। জাসদ দেখলো যে, দুই দুইবার সরকার পরিবর্তন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু, বুর্জুয়া পুঁজিবাদী শক্তির প্রতিনিধিরাই ক্ষমতায় থাকছে। অতএব, আরও নতুন কিছু ঘটার আগে, কিছু একটা করতেই হবে।
সেই বিপ্লব এবং বিভীষিকাময় রাতের কথা বলতেই হবে। তড়িৎ গতিতে জাসদ এবং গোপন সৈনিক সংস্থা সিদ্ধান্ত নিল, বিপ্লব করার। প্রচার করলো, অফিসার মারতে হবে কারণ অফিসারগণ প্রথাগত শৃঙ্খলা ও নিয়মকানুনে বিশ্বাস করে। এদিকে, বন্দী অবস্থায় জিয়াউর রহমান চিন্তা-ভাবনা করলেন যে, বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে, প্রথম কাজ হলো বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হওয়া। একই সময় জাসদ অনুভব করল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে হবে এবং জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তিকে কাজে লাগাতে হবে। ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ দিনের শেষে, আন্তর্জাতিক নিয়ম মোতাবেক ৭ তারিখ শুরু হওয়া মাত্রই, তথা মধ্যরাত্রি ১২:০১ মিনিটে বিপ্লব শুরু হলো। অফিসারগণের বাসায় বাসায়, অফিসে অফিসে হামলা হলো। হত্যা করা হলো অনেককেই। নারী (ডাক্তার) অফিসারগণকে হত্যা বা অপদস্থ করা হলো। অফিসারদের অমান্য করার জন্য, বন্দী করার জন্য বা হত্যা করার জন্য প্রকাশ্যে মাইকে আহ্বান জানানো হলো। অফিসারদের বিরুদ্ধে সৈনিকদের বিক্ষুব্ধ হওয়ার জন্য, জাসদের উত্তেজনামূলক প্রচারণা ছাড়াও আরও কিছু সংশোধনযোগ্য কারণ ছিল, যেগুলো আমি এখানে লিখছি না।
ঐ বিভিষীকাময় রাতে আমি ব্যক্তিগতভাবে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম? আমি মানে ১৯৭৫-এর নভেম্বরের মেজর ইবরাহিম। বহু অফিসার যে যেদিক পারে, সেদিকে দৌড় দিয়ে নিরাপত্তা খুঁজলেন; ক্যান্টনমেন্ট এর চারিদিকে বহির্মুখী গ্রাম, ধানক্ষেত, কলোনি ইত্যাদিতে। আমি নিজে, বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেই ব্যাটালিয়নে ১৯৭০ সালে জন্ম নিয়েছিলাম এবং যাদের সাথে ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, সেই দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট-ই যোগদান করলাম রাত্রি ১২:৩০ মিনিটে। দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকগণ আমাকে হত্যা করেনি, অপমান করেনি বরং তাদের আহ্বানেই তাদেরকে নেতৃত্ব দিলাম এবং সৈনিক বিপ্লবের উজ্জ্বল পথে তাদেরকে নিরাপদ দিক নির্দেশনা দিলাম। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকগণ জিয়াউর রহমানকে ভালোবাসতেন। তাদের নেতৃত্ব দিলাম সকাল ৬:৩০ পর্যন্ত। আমার সাথে ছিলেন আর মাত্র দুইজন অফিসার যথা তৎকালীন ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম চৌধুরী এবং ক্যাপ্টেন এনামুল হক; তাঁরা উভয়েই পাকিস্তান থেকে ফেরত আসার পর দ্বিতীয় বেঙ্গলে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
অন্ধকার রাতের আলোকিত ঘটনা। ঢাকা সেনানিবাসের অনেকগুলো ইউনিট বা রেজিমেন্ট বা ব্যাটালিয়ন যেখানে যেখানে গোপন সৈনিক সংস্থা সক্রিয় ছিল, তারা অন্ধকার রাত্রে সেনানিবাসের রাজপথে নেমে আসলো। হাজার হাজার অস্ত্র থেকে বের হওয়া গুলির আওয়াজ কত প্রকট ছিল সেটা বাংলায় কোনো শব্দ দিয়ে বোঝাতে পারবো না। জাসদপন্থী সৈনিকদের সঙ্গে হাজার হাজার সাধারণ সৈনিকও বের হয়ে পড়লো। অনেক সৈনিক জেনারেল জিয়ার বাসায় গিয়ে তাঁকে মুক্ত করলেন। জিয়া পুনরায় দায়িত্ব নিলেন সেনাবাহিনীর। জাসদপন্থী সৈনিকগণ এবং সাধারণ সৈনিকগণ সেনানিবাসের বিভিন্ন জায়গায় মুখোমুখি হয়ে গেলেন। বিদ্যুৎবিহীন সেনানিবাসে অকল্পনীয় ভীতিকর পরিস্থিতি ছিল। এখন ২০১৭ সালের পরিবেশে, বর্ণনার অসাধ্য যে, ১৯৭৫-এর ঐ রাত্রি কেমন ছিল?
ঐ রাতে বঙ্গভবনের পরিস্থিতি। সাধারণ সৈনিকগণের একটি বড় দল বঙ্গভবন ঘেরাও করলো। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর থেকে যে সকল সৈনিক বঙ্গভবন পাহারা দিয়েছিল, তারাও আনুগত্য বদলিয়ে ফেলল সাধারণ সৈনিকগণের অনুকূলে। বঙ্গভবনে অবস্থানকারী খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম মহোদয় এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ সঙ্গীগণ, গোপনে বা ছদ্মবেশে বঙ্গভবন ত্যাগ করলেন, জীবন বাঁচানোর জন্য। কর্নেল শাফায়াত জামিল রওনা দিলেন মুন্সিগঞ্জের দিকে, জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা এবং লেফটেনেন্ট কর্নেল এটিএম হায়দার তিনজন এক গাড়িতে ঢাকা থেকে দূরে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পথে অশনি সংকেত। বিদ্যুৎ গতিতে গাড়ি ঘুরিয়ে, দ্রæত গতিতে এসে, ঢাকা মহানগরের শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আশ্রয় নেন। এই তিনজন অফিসার এবং দশম বেঙ্গলের মধ্যে আন্তরিকতা ও হৃদ্যতার কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু ব্যাটালিয়নে সৈনিক মহলে এই তিনজন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে বৈরী প্রচারণা ইতোমধ্যেই হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর, এই ব্যাটালিয়নেই তাঁরা তিনজন নিহত হন। এই মর্মান্তিক হত্যা ঘটনার রহস্য এখন পর্যন্ত পূর্ণভাবে উদঘাটিত হয়নি।
এই কলামের উপসংহারে আমরা, আভ্যন্তরীণ সংকট উত্তরণ প্রসঙ্গে জিয়ার ভূমিকা আলোচনা করবো। ঢাকা সেনানিবাসের সীমিত পরিসর থেকে সৈনিকগণ ভোর ৪-৫টার মধ্যেই ঢাকা মহানগরীর রাজপথে ছড়িয়ে পড়ে। সূর্য-উদয়ের আগে-পরে হাজার হাজার সাধারণ নাগরিক সৈনিকগণের অনুকূলে, বাংলাদেশের অনুকূলে এবং জিয়াউর রহমানের অনুকূলে শ্লোগান দিতে দিতে, সৈনিকগণের গাড়িতে উঠে সৈনিকগণকে নিয়ে আবেগ প্রকাশের উৎফুল্লতায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং জিয়াউর রহমানের অনুকূলে তাদের ভালোবাসা ও আনুগত্য উজাড় করে দিয়ে ঢাকা মহানগরের রাজপথ দখল করে রাখে। জাসদ ঐ বিপ্লবের জন্য, প্রধান অস্ত্র বিবেচনা করেছিলেন, জিয়াউর রহমানকে। জিয়াউর রহমানকে নিজেদের আয়ত্তে বা নিয়ন্ত্রণে না পেয়ে, জাসদ হত বিহŸল হয়ে পড়েন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। কিন্তু ইতোমধ্যেই জাসদপন্থী সৈনিকগণ, যারা এতদিন গোপন ছিলেন, তারা চিহ্নিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ সৈনিকদের দৃষ্টিতে। বহু সংখ্যক অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে, অফিস আদালত তছনছ হয়েছে, গোলাগুলির আঘাতে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে-এর দায়-দায়িত্ব জাসদপন্থী সৈনিকগণের উপরেই বর্তিয়ে গেল। অপরপক্ষে জাসদপন্থী সৈনিকগণ, রাজনৈতিক দল জাসদের ব্যর্থতার জন্য যুগপৎ হতাশ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। যে সকল সাবেক সেনা কর্মকর্তা জাসদে জড়িত ছিলেন বা যেই গুটিকয়েক চাকরিরত সেনা কর্মকর্তা, জাসদের প্রতি সহমর্মি ছিলেন, তারা সাংঘাতিক বেকায়দায় পড়ে গেল। জাসদপন্থী, বামপন্থী বিপ্লব ব্যর্থ করেছে কারা? ব্যর্থ করে দিয়েছিলো সাধারণ সৈনিক ও সাধারণ নাগরিকগণ। সৈনিক ও নাগরিকের মধ্যে স্থাপিত বন্ধুত্ব ও সংহতি অভূতপূর্ব ছিল, মুক্তিযুদ্ধকালেই এর একমাত্র উদাহরণ ছিল। তাই ৭ নভেম্বরের একটি নাম জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা পেয়েছে। জিয়াউর রহমান পুনরায় সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ও চেইন অফ কমান্ড ফিরিয়ে এনেছেন। নৈরাজ্যবাদীগণ দমিত হয়, দেশের বাইরে থেকে ইন্টারভেনশন বা হস্তক্ষেপ রহিত হয়, স্বাধীনতা রক্ষা পায়। জিয়ার নেতৃত্বে সরকারি কাঠামো এবং জনগণ দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করেছে। তাই জিয়া ৭ নভেম্বরের জাসদপন্থী বিপ্লবীদের চরম শত্রæ। জিয়া আর পৃথিবীতে নেই, কিন্তু ৭ নভেম্বর বিপ্লবীদের অনেকেই আছেন।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।