পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মহান মুক্তিযুদ্ধ জাতির গৌরব ও অহংকার। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স (বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশের ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, পুলিশ-আনসার, কামার-কুমার, জেলে-মজুর থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ এ যুদ্ধে অংশ নেয়। পেশাগত পরিচয় ভুলে গিয়ে সবাই হয়ে যায় স্বাধীনতার সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৭০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরেও পাকিস্তানী স্বৈরশাসক আমাদের বিজয় মেনে না নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সাত কোটি মানুষ দেশের সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। শুরু করে প্রাণপণ মুক্তিযুদ্ধ। এ সময় প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করে। নিরীহ বাঙালির উপর পাকিস্তানী হানাদারদের বর্বরোচিত আক্রমণ শুরু হলে বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারত আমাদের দেশের এক কোটি লোককে আশ্রয় দেয়। শুধু আশ্রয়ই নয়, যুদ্ধাস্ত্র, খাবার, বাসস্থান, ওষুধ, চিকিৎসাসহ সবকিছু দিয়ে আমাদের সাহায্য করে।
দীর্ঘ ন’মাস বিভিন্ন রণাঙ্গণে যুদ্ধ করতে গিয়ে ত্রিশ লাখ লোক আত্মাহুতি দেয়। দু’লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের হাত রক্তাক্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি, এ গরিব দেশটির রাস্তাঘাট, দালান-কোঠা, ঘরবাড়ি, ব্রিজ-কালভার্ট সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। তারপরেও আমাদের সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা ওদের প্রতিরোধ করে ১৬ ডিসেম্বর কাক্সিক্ষত বিজয় ছিনিয়ে আনে। এরপর নতুন করে শুরু হয় নতুনভাবে পথচলা। যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশটি স্বাধীন করে তাদের দেয়া হয় বীরোচিত সংবর্ধনা। সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্তঋণ জাতি কোনোদিন ভুলেনি, ভুলবেও না।
১৯৭১ থেকে বর্তমান ২০১৮ পর্যন্ত যদি হিসাব করা যায়, তাহলে দেশটির বয়স দাঁড়ায় ৪৭ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে দেশের প্রভূত উন্নয়ন অর্জিত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রের কাছেও হিসাব নেই মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত চিত্র। কতজন মুক্তিযোদ্ধা মৃত, কতজন মুক্তিযোদ্ধা জীবিত সম্ভবত তারও সঠিক পরিসংখ্যানও নেই সরকারের হাতে। সময়ের পালা বদলে সরকার আসে, সরকার যায়। সেই সাথে বানের জলের মতো বাড়তে থাকে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা। সরকার তাদের পছন্দমতো মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন নতুন তালিকা তৈরি করে, আবার তালিকা থেকে বাদও দেয়।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের চালচিত্র। এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার ৪শ’ ৩৮ জন। এছাড়ও এর বাইরে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে ২৫ হাজার ৫শ’ জন যাদেরকে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভুয়া সনদ প্রমাণিত হওয়ার পরেও ৫ সচিব ও বিভিন্ন সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীসহ প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, বিএনপি সরকারের আমলে প্রায় ২২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ আমলে ২০০৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত গেজেটভুক্ত হয়েছে সাড়ে ১১ হাজার। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া দূরের কথা, তাদের চিহ্নিতই করতে পারেনি সরকার। অবশ্য মন্ত্রী বলেছেন, তাদের আমলে ৮ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল করেছেন। মন্ত্রীর এই হিসাব যদি সত্য হয়, তাহলে এখনও ২৫ হাজার ৫শ’ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। এদিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট বাতিলের জন্য নাম-ধাম উল্লেখ করে বেশ কিছু মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মামলা করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু এগুলোর ব্যাপারেও বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বার্থে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাদের সম্মানী ভাতা থেকে শুরু করে সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করেছেন। মুক্তিযোদ্ধার পরিবার বিশেষ করে তাদের সন্তান এবং নাতি-পুতিদের জন্যও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রেখেছেন। এখন আর কোনো মুক্তিযোদ্ধা দারিদ্র্য সীমার নিচে নেই। পত্রিকা খুলে এখন আর দেখি না কোনো মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করে, ঠেলাগাড়ি চালায়, দিনমজুরী ও হকারি করে, রাস্তায় ইট ভাঙে, অফিস বা বাসায় দারোয়ানের কাজ করে, সাহায্য লাভের আশায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু এগুলো এক সময় ছিলো। অসহায়, দরিদ্র ও কপর্দকহীন মুক্তিযোদ্ধাদের করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করলে চোখে পানি এসে যেতো। দেশ যখন ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থারও পরিবর্তন হচ্ছে।
আজকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাও রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমান সুযোগ-সুবিধা আদায় করছে। তারা রাষ্ট্রীয় ভাতা প্রাপ্তি থেকে শুরু করে অন্যান্য সুবিধাসহ ছেলেমেয়েদের চাকরি বাগিয়ে নিচ্ছে। কোনোভাবেই এই অন্যায় কার্যকলাপ ঠেকানো যাচ্ছে না। এতে করে একদিকে রাষ্ট্রের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষু্ণ্ন হচ্ছে, অন্যদিকে অপচয় হচ্ছে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা। মানুষ মনে করে, এসব ভুয়া বা ভেজাল মুক্তিযোদ্ধার প্রতিপালন করা রাষ্ট্রের উচিত নয়। এতে রাষ্ট্র আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সম্মানেরও হানি ঘটে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রের বোঝা। এ কথা সত্য যে, আমরা আজ ভুয়া বা ভেজালের যুগে বসবাস করছি। মানুষ থেকে শুরু করে সবখানেই ভেজালের ছড়াছড়ি। মাছ, মাংস, চাল, ডাল, তেল, দুধ, মসলা, শাক-সবজি, তরি-তরকারি, সাবান-সোডা, সুগন্ধি তেল, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, শিশুখাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সব জিসিসেই আজ ভেজালের মহোৎসব। এসব পণ্য ও খাদ্যসামগ্রী খেলে যেমন স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, তেমনি মানুষের জীবন নিয়েও শংকা ও উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। আজকে ভুয়া বা ভেজাল মুক্তিযোদ্ধারাও জাতির উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওরা যখন বীরদর্পে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে হাঁটে তখন আমাদের কষ্ট হয়। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তখন লজ্জায় আমাদের মাথা হেট হয়ে আসে। শুধু তাই নয়, যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তাদের নিয়েও করুণা হয় এই কারণে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরির পেছনে তাদেরও কমবেশি ভূমিকা রয়েছে। তাদের মুখ থেকেই শুনেছি, মুক্তিযোদ্ধা হতে আগ্রহী কোনো ব্যক্তিকে যখন যাচাই-বাছাই করে সিলেক্ট করা হয় তখন তিনজন মুক্তিযোদ্ধার সুপারিশ লাগে। তাদের অনেকেই লোভনীয় অর্থের বিনিময়ে এই অনৈতিক সুপারিশটি করে থাকেন। যিনি লোভের বশবর্তী হয়ে এই অন্যায় কাজটি করেন তিনিও তখন বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকেন না। আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তারা যদি এই অন্যায় সুপারিশটি না করতেন তাহলে দেশে ভুয়া বা ভেজাল মুক্তিযোদ্ধা তৈরি হতো না।
যারা আজকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করছে তারা কখনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, কীভাবে অস্ত্র চালাতে হয় তা-ও তারা জানে না। কীভাবে বন্দুকের ট্রিগার চেপে ফায়ার করতে হয় তা-ও ওদের অজানা। ওরা কিছু সুবিধাভোগী লোকের সহায়তায় জাল কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে নিজেদের বয়স ও জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে গিয়ে হাজির হয়। তারপর কমিটির কিছু লোককে ‘ম্যানেজ’ করে বীর মুক্তিযোদ্ধার খেতাব ছিনিয়ে নেয়। আর এভাবেই দিনের পর দিন বেড়ে চলছে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা। এখনও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অগণিত মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। নেই উপযুক্ত প্রমাণাদি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। অথবা অনেকের কাগজপত্র থাকলেও সেগুলো সংরক্ষণ করে রাখতে পারেননি। যতেœর অভাবে অনেকের কাগজপত্র হারিয়ে গেছে, আগেুন পুড়ে গেছে বা পোকায় খেয়ে ফেলেছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই হলো অশিক্ষিত, স্বশিক্ষিত, উদাসীন বা অসচেতন। মনে আছে, এক সময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘এ দেশে চার বছরের শিশু পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়। আর তারই পক্ষে রায় দেয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত।’ তিনি স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, ‘এতে আমাদের কী করার আছে? আমরাতো আর কোর্টের বাইরে যেতে পারি না।’ বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। কোর্টতো প্রমাণপত্র বা সত্যতা যাচাই করেই রায় দিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধকালীন সময় যারা চার বছরের শিশুকে তের-চৌদ্দ বছর দেখিয়েছে দোষতো তাদের। তারাতো মূর্খ না, শিক্ষিত ও বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ। তারা জেনেশুনে এই অন্যায় ও গর্হিত কাজটি কীভাবে করলেন, আমার প্রশ্নটাতো এখানেই।
তথাকথিত এসব মুক্তিযোদ্ধার কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাও আজ বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে ওদের (ভুয়াদের) সাথে দেখা হলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বিবেকে দংশন বোধ করেন। অনেকের লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যায়। সেদিন কথায় কথায় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘আমি এখন মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিই না। পরিচয় দিলেই অনেকে প্রশ্ন করে বসেন, আপনি প্রকৃত না ভুয়া! তখন উত্তর দিতে দিতে জান শেষ হয়ে যায়।’
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে যাদের আমরা জানি বা চিনি তারা কেনো বিতর্কিত হবেন? দেশে কেনোইবা ভুয়া বা ভেজাল মুক্তিযোদ্ধা থাকবে? কেনো সরকারের করা নতুন নতুন তালিকায় ভুয়ারা অন্তর্ভুক্ত হবে? এটাতো কেবল ব্যক্তির লজ্জা নয়, এ লজ্জা সমগ্র মানুষের, সমগ্র জাতির।
লেখক : সাংবাদিক, ছড়াকার ও সাংস্কৃতিক কর্মী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।