চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
পৃথিবী মানবজাতির ‘পরীক্ষার হল’। পরীক্ষার খাতায় যেমন যা ইচ্ছা লেখা যায় ঠিক তেমনি পৃথিবীতেও মানুষ যা ইচ্ছা করতে পারে। আল্লাহ এ ক্ষমতা সবাইকে দিয়েছেন। কেউ ইচ্ছে করলে সৃষ্টিকর্তার হুকুম পালন করবে, ইচ্ছে করলে করবে না। তবে সব পরীক্ষারই একটা ফলাফল থাকে। দুনিয়া নামক পরীক্ষারও ফলাফল থাকবে। গোলাম মালিকের কাজ করলে মালিক তাকে পুরস্কার দেন, কাজ না করলে দেন শাস্তি। আল্লাাহও তার বান্দাদের পুরস্কার এবং শাস্তি দিবেন। দুনিয়াতে তার হুকুম-আহকাম পালন করলে পুরস্কার স্বরূপ জান্নাত দিবেন। না করলে শাস্তি হিসেবে জাহান্নাম দিবেন। আর সেই পুরস্কার এবং শাস্তি নির্ধারণের জন্য একটি আদালত কায়েম করা হবে। সেদিন মানুষের আমলের সুষ্ঠু বিচার করা হবে। প্রত্যেককে নিজেদের কৃত কর্মের পুরস্কার ও শাস্তি দেয়া হবে। সেই বিচারিক আদালতকে বলা হয় ‘হাশরের ময়দান’। যার একমাত্র এবং চূড়ান্ত বিচারপতি ও অধিপতি হবেন মহান আল্লাহ।
হাশরের ময়দানের প্রেক্ষাপট: মহানবী (সাঃ) বলতেন, কিভাবে আমি আনন্দ উল্লাস করবো, অথচ ইস্রাফিল (আঃ) মুখে শিঙ্গা লাগিয়ে শির অবনত করে গভীর মনযোগে কান পেতে অপেক্ষা করছেন - কখন শিঙ্গায় ফুক দানের হুকুম আসে । “ হযরত মুকাতিল (রহঃ) বলেন, শিঙ্গাটা শিং এর মত । শিঙ্গার গোলাকার মুখটি সাত আসমান ও যমীনের সমান । তিনি অপলক নেত্রে আরশের দিকে তাকিয়ে প্রতীক্ষা করছেন যে, কখন আদেশ করা হয় । প্রথববার যখন শিঙ্গায় ফুক দিবেন, তখন আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত বাসিন্দারা বেহুশ হয়ে মারা যাবে শুধু কয়েকজন ব্যতিত । তারা হলো- জীব্রাঈল, মীকাঈল, ইস্রাফিল ও মৃত্যুর ফেরেশ্তা আজরাঈল (আঃ) । অতঃপর আল্লাহ মৃত্যুর ফেরেশ্তাকে তাদের জান কবয করার হুকুম দিবেন । তারপর আল্লাহর হুকুমে মৃত্যুর ফেরেশ্তার মৃত্যু হবে । তারপর চল্লিশ বছর যাবত আল্লাহর কুদরতে সমস্ত রুহ আলমে বরযখে থাকবে । তারপর আল্লাহর হুকুমে ই¯্রাফিল (আঃ) জীবিত হবেন ও দ্বিতীয়বার ফুক দিলে সবাই জীবিত হয়ে হাশরের মাঠে একত্রিত হবে । এ কথাই আল্লাহ পাক কুরআনে বলেছেন, অতঃপর দ্বিতীয়বার শিঙ্গায় ফুক দেওয়া হবে। তৎক্ষণাত তারা (জীবিত) হয়ে দাড়িয়ে (পুনরুত্থানের ভয়ংকর দৃশ্য) অবলোকন করতে থাকবে । (যুমার -৬৮) মানুষ অস্থির হয়ে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করবে। সেদিন কারও পরনে কোনো বস্ত্র থাকবে না। কেউ কারও দিকে তাকাবেও না।
হজরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘মহানবী সা. কে বলতে শুনেছি যে, কিয়ামতের দিন মানুষকে উলঙ্গ দেহে ও খাতনাহীন অবস্থায় কবর থেকে হাশরের ময়দানে জমায়েত করা হবে। একথা শুনে আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! নারী পুরুষ সকলেই কি উলঙ্গ হবে? তারা কি একে অপরের প্রতি তাকাবে? (এরূপ হলে তো খুবই লজ্জার বিষয়)। উত্তরে তিনি বললেন, হে আয়েশা! কিয়ামতের দিনটি এত কঠিন ও বিপদময় হবে যে, মানুষের মনে একে অপরের প্রতি তাকাবারও খেয়াল হবে না।’ (বুখারি-মুসলিম)
হাশরের ময়দান কোথায় হবে? শামে হাশরের ময়দান হবে মর্মে ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। আর তৎকালীন শাম বর্তমানে সিরিয়া, জর্দান, লেবানন, ফিলিস্তিন ও ইসরাঈলের পুরো ভূখন্ড এবং ইরাক, তুরস্ক, মিসর ও সঊদী আরবের কিছু অংশকে শামিল করে (উইকিপিডিয়া) । আবু যর গিফারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল স. বলেন, ‘শাম হ’ল একত্রিত হওয়ার ও পুনরুত্থিত হওয়ার স্থান’ (সহীহুল জামে‘ হা/৩৭২৬) । অন্য বর্ণনায় তিনি হাশরের স্থান হিসাবে শামের দিকে ইশারা করেছেন (আহমাদ হা/২০০৪৩, সহীহুল জামে‘ হা/২৩০২) । মনে রাখতে হবে যে, ক্বিয়ামতের দিন বর্তমান পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবীতে পরিণত হবে (ইবরাহীম ৪৮) এবং পাহাড়-পর্বত সব একাকার হয়ে সমতল হয়ে যাবে (ত্বোয়াহা ২০/১০৬) । যেটা মানুষের কল্পনার বাইরে।
ভয়াবহ হাশরের ময়দানরে চিত্র : হাশরের মাঠের চিত্র হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। সেদিন পৃথিবী সৃষ্টি থেকে শুরু করে ধ্বংস হওয়ার পর্যন্ত সমস্ত মানুষকে জমায়েত করা হবে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘সেদিন পরিবর্তিত করা হবে এ পৃথিবীকে অন্য পৃথিবীতে এবং পরিবর্তিত করা হবে আসমান সমূহকে এবং লোকেরা পরাক্রমশালী এক আল্লাহর সামনে হাজির হবে। (সুরা ইবরাহিম : ৪৮)। রাসুল সা. বলেন- ‘কিয়ামতের দিন সাদা ময়দার রুটির মতো চকচকে একটি মাঠের উপর সমস্ত মানুষকে একত্রিত করা হবে। সেখানে কারও কোনো নিশানা থাকবে না। (বুখারি : কিতাবুত রিকাক)
হাশরের ময়দানে আপনজনদের ভুলে যাবে : হাশরের ময়দানে মানুষ তার আপনজনদের ভুলে যাবে। সবাই নিজের চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত থাকবে। হজরত রাসুল সা. বললেন- ‘তিনটি স্থানে কেউ কারও কথা স্মরণ রাখবে না। ১. মিযানের নিকট। সেখানে প্রত্যেকেই চরম উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইবে যে, তার নেকির পাল্লা হালকা হয়, নাকি ভারী হয়! ২. আমলনামা প্রদানের সময়, যখন প্রত্যেককে বলা হবে- ‘তোমাদের নিজ নিজ আমলনামা পাঠ কর।’ তখন প্রত্যেকেই ভীষণভাবে অধীর হয়ে জানতে চাইবে যে, তার আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে নাকি পেছন দিক দিয়ে বাম হাতে দেওয়া হবে। ৩. পুলসিরাতের নিকট, যখন তা জাহান্নামের উভয় পাড় ঘেঁষে ওপরে বসানো হবে (এবং তার ওপর দিয়ে অতিক্রমের নির্দেশ দেওয়া হবে)। এই তিনটি স্থানে কেউ কাউকে স্মরণ রাখবে না।’ (আবু দাউদ)
কাফেররা অন্ধ ও চেহারার উপর ভর করে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে : আল্লাহ তাআলা বলেন:
আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন? তিনি বলবেন, এমনিভাবেই তোমার নিকট আমার নিদর্শনাবলী এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল। (সূরা ত্বা-হা- ১২৪-১২৬) তিনি আরো বলেন:
আর আমি কিয়ামতের দিনে তাদেরকে একত্র করব উপুড় করে, অন্ধ, মূক ও বধির অবস্থায়। তাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম; যখনই তা নিস্তেজ হবে তখনই আমি তাদের জন্য আগুন বাড়িয়ে দেব। (সূরা বানী ইসরাইল- ৯৭) হাদীসে এসেছে:
আনাস রা. থেকে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিয়ামতের দিন কাফেরদের কিভাবে চেহারার উপর উপুর করে উঠানো হবে? তিনি বললেন: যে মহান সত্ত¡া দুনিয়াতে দু পা দিয়ে চলাচল করিয়েছেন, তিনি কি কিয়ামতের দিন মুখ-মন্ডল দিয়ে চলাচল করাতে পারবেন না? কাতাদা বললেন : অবশ্যই তিনি পারবেন, মহান রবের সম্মানের কসম করে বলছি। (বুখারী ও মুসলিম)
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন: কেয়ামতের দিন মানুষ ঘর্মক্ত হবে। এমনকি যমীনের সত্তর হাত ঘামে ডুবে যাবে। তাদের ঘামে তারা কান পর্যন্ত ডুবে যাবে। (বুখারী ও মুসলিম)
হাশরের ময়দানে সূর্যের দূরত্ব ও প্রখরতা:
মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ স. কে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন: কিয়ামত দিবসে সূর্য মানুষের খুব নিকটবর্তী হবে। এমনকি এর দুরত্ব এক মাইল পরিমাণ হবে। এ সম্পর্কে সুলাইম ইবনে আমের বলেন, আল্লাহর শপথ! মাইল বলতে এখানে কোন মাইল তিনি বুঝিয়েছেন আমি তা জানি না। জমির দূরত্ব পরিমাপের মাইল বুঝিয়েছেন, না সুরমা দানির মাইল (শলাকা) বুঝিয়েছেন? মানুষ তার আমল অনুযায়ী ঘামের মধ্যে থাকবে। কারো ঘাম হবে পায়ের গিরা বরাবর। কারো ঘামের পরিমাণ হবে হাটু বরাবর। কারো ঘামের পরিমাণ হবে কোমর বরাবর। আবার কারো ঘামের পরিমাণ হবে তার মুখ বরাবর। (সহীহ মুসলিম ২১৯৬)
হযরত উকবা ইবনে আমের (রাঃ)বলেন, মহানবী (সাঃ) বলেছেন, কিয়ামত দিবসে সূর্য্য যমীনের নিকটবর্তী হবে ; ফলে মানুষ ঘর্মাক্ত হতে থাকবে । কারো ঘাম গোড়ালী পর্যন্ত, কারো অর্ধহাটু , কারো উরু, কারো কোমর , কারো মুখ পর্যন্ত পৈাছবে। কারো মাথা পর্যন্ত ঘামের মধ্যে ডুবে যাবে ।
হযরত ইবনে উমর (রাঃ) বলেন,রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যেদিন মানুষ রাব্বূল আলামিনের সম্মুখে হিসাবের জন্য দন্ডায়মান হবে , সেদিন অনেকেই নিজের ঘামে কান পর্যন্ত ডুবে যাবে। আর এক হাদিসে এসেছে, মানুষ দন্ডায়মান অবস্থায় চল্লিশ বছর পর্যন্ত আসমানের দিকে তাকিয়ে থাকবে এবং সীমাহীন কস্টের দরুণ ঘাম ঝরে ঝরে গলা পর্যন্ত পৈাছবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।