Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ট্রেনে কাটা পড়ে বাড়ছে হতাহতের ঘটনা

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ২০ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

রাজধানীসহ দেশে ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। আইনের কড়াকড়ি ও নাগরিকদের সচেতন করতে নানা কার্যক্রম নেওয়া হলেও সচেতন হয়নি জনসাধারণ। গত পাঁচ বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন আরও অনেকে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, রেল লাইনের দু’পাশে বস্তি ও বাজার স্থাপন, অনিরাপদ ক্রসিং ব্যবস্থা, ট্রেন লাইনের মধ্য দিয়ে মানুষের অসতর্ক চলাচল, চলন্ত ট্রেনে সেলফি তোলা, কানে হেডফোন লাগিয়ে রাস্তা পাড়াপাড়, ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা এবং যথাযথ মনিটরিং না থাকায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়ে চলছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে ও ট্রেন দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৪৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে রেললাইনে হত্যা করা হয়েছে ১৩৪ জনকে। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসেই ট্রেনে কাটা পড়ে ও দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৪৬৬ জন।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি প্রাণহাটি ঘটছে কানে হেডফোন লাগিয়ে এবং অসতর্ক অবস্থায় দ্রæত ক্রসিং পার হতে গিয়ে। সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, ক্রসিং পাড় হতে গিয়ে ৫ বছরে মৃত্যু ঘটেছে ১ হাজার ৭১৫ জন। কানে হেডফোন ও মোবাইলে কথা বলা অবস্থায় ৩২২ জন। রেললাইনের ওপর বসা বা চলাচলের কারণে ১ হাজার ৯৭৬ জন, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ১৪৬ জন। এ ছাড়া অন্যান্য কারণে আরও ২৯৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল পুরুষ নয়, দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অনেক নারীরও প্রাণহানি ও অঙ্গহানি ঘটছে। পরিসংখ্যান মতে, নিহতদের মধ্যে পুরুষ তিন হাজার ৪৬৭ এবং নারী ৯৮৭ জন। এসব দুর্ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৪০৬টি। শুধু চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে অপমৃত্যু মামলার সংখ্যা ৪৪২টি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ আগস্ট দ্রæত ক্রসিং পাড় হতে গিয়ে যশোরে কাটা পড়ে মারা যায় জসিম উদ্দিন নামের এক যুবক। ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে তেজগাঁওয়ে কাটা পড়ে মৃত্যু ঘটে পাঁচ বছর বয়সী পলকের। তার নানী শিশুটিকে রেললাইনের পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে বাজার করতে গেলে কাটা পড়ে সে। ২০ সেপ্টেম্বর বনানীতে মোবাইলে কথা বলা অবস্থায় রেললাইন পাড় হতে গিয়ে কাটা পড়ে মারা যায় ব্যবসায়ী বাজন আলী। একইদিন পাবনার ঈশ্বরদী স্টেশনে কাটা পড়ে মারা যায় আল আমিন সরদার। ট্রেনের গতি কম দেখে রাস্তা পাড় হওয়ার সময় ট্রেনটি দ্রæতগতিতে ছুটলে নিচে কাটা পড়ে মারা যায় সে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক কাজী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, অসচেতনতার পাশাপাশি রেললাইনের দু’পাশে বস্তি ও মানুষের আনাগোনা থাকায় এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, সচেতনতা সৃষ্টিতে নানা পদক্ষেপ নিয়েও আশানুরূপ ফল মিলছে না। লিফলেট বিতরণ, উঠান বৈঠক ও মাইকিং করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, রেললাইনের দু’পাশে ১০ ফুট করে ২০ ফুট এলাকায় যে কোনো মানুষ প্রবেশ আইনত দÐনীয় অপরাধ। এমন কী, ২০ ফুটের মধ্যে কোনো গবাদিপশু প্রবেশ করলেও তা আটক করে বিক্রির নিয়ম রয়েছে। তবে এই আইনের প্রয়োগ কখনো দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, দেশের অন্য জায়গার তুলনায় ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় মানুষজন বেশি থাকায় ট্রেন দুর্ঘটনাও বেশি। তার মতে, রেলক্রসিংয়ে যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকা, জনগণের অসচেতনতা, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধ্যান এবং জবাবদিহিতিা ও শাস্তি না হওয়ায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। রেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তা ও জনবল বৃদ্ধি এবং নাগরিকদের সচেতন করা গেলে দুর্ঘটনা অনেক কমবে।
এদিকে, অপমৃত্যুর পাশপাশি রেললাইনে হত্যার ঘটনাও অনেক। আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আড়ারে থাকার জন্য অনেক সময় রেললাইনে এনে হত্যা করা হয়। কখনোবা আলামত নষ্টে হত্যার পরে লাশ রেল লাইনে ফেলে রাখা হয়। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, রেললাইনে পাওয়া লাশের ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়া খুবই কঠিন। লাশের অবস্থা খুবই নাজুক থাকে। যার কারণে দুর্বৃত্তরা হত্যা বা আলামত ধ্বংশের জন্য রেললাইন নিরাপদ হিসেবে বেছে নেয়।
গত ১৪ জুন রাজধানীর খিলগাঁওয়ে রেললাইন থেকে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদের (৫২) দ্বিখন্ডিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মৃত্যুর কারণ জানা না গেলেও তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা। ৩০ মার্চ মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার লংলা রেলস্টেশনের পার্শ্ববর্তী ২৩১/১ মাইল খুঁটির কাছ থেকে জয় ও সন্ধ্যা নামে দুই কলেজ শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করা হয়। পরিবার দুটি একে পরিকল্পিত হত্যাকাÐ বলে দাবি করলেও পুলিশ এতদিনেও কোন তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, গত ৫ বছরে রেললাইনে হত্যাকাÐের ঘটনা ঘটেছে ১৩৪টি। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৩৮, ২০১৪ সালে ৩৩, ২০১৫ সালে ২৪, ২০১৬ সালে ২০ এবং গত বছরে ১৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। রেলওয়ে পুলিশ বলছে, রেললাইনে হত্যার ঘটনায় যতো মামলা হয়েছে তার মধ্যে মাত্র ১৬টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া পুলিশের কাছে তদন্তাধীন মূলতবী মামলা রয়েছে ১৯টি।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের ডিআইজি মো. শামসুদ্দিন বলেন, রেললাইন থেকে উদ্ধার হওয়া প্রতিটি লাশের ঘটনায় মামলা হয়। পুলিশ গুরুত্বসহকারে সেসব মামলার তদন্ত করে থাকে। তদন্তে হত্যাকাÐ হিসেবে মনে হলে নতুন করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ট্রেন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ