পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশের বিভিন্ন জেলায় স¤প্রতি উন্নয়ন-মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে সরকারিভাবে। দেশের বাইরে বিভিন্ন দূতাবাসেও অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের দশ বছরে দেশে যে উন্নয়ন হয়েছে তা দেখাতেই এ মেলার আয়োজন করা হয়। এছাড়া, কতিপয় মিডিয়া খাতভিত্তিক উন্নয়নের চিত্র প্রচার রেছে। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী ১১ অক্টোবর বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মতো এত দ্রæত বিশ্বের অন্য কোনো দেশ উন্নয়ন করতে পারেনি। বাংলাদেশ গত দশ বছরে উন্নয়নের মহাসড়কে যে পথ পাড়ি দিয়েছে, তা অসাধ্য সাধন।’ বিভিন্ন তথ্য মতে, গত এক দশকে দেশের বিভিন্ন খাতের অনেক উন্নতি হয়েছে। যেমন: ধান, সবজী, মাছ, মাংস ও ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় স্বয়ংভর হয়েছে। রফতানি, রেমিটেন্স, প্রবৃদ্ধি, জিডিপি, জিএনপি, মাথাপিছু গড় আয়, গড় আয়ু, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি বেড়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০০৬-০৭ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত যথাক্রমে ৬.৪৬%, ৭.০৬%, ৫.৫৭%, ৬.৪৬%, ৬.৫২%, ৬.১%, ৬.৬%, ৬.৫৫%, ৭.১১%, ৭.২৮%, ৭.৬৫%। তাই দেশ নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। উপরন্তু মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছে। আর দুই ধাপ অতিক্রম করতে পারলেই মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পাবে ২০২৪ সালে। এইচএসবিসি স¤প্রতি বলেছে, বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল ও উদীয়মান ৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি সবচেয়ে বেশি হারে বাড়বে। জিডিপির আকার বিবেচনায় বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৪২তম। ২০৩০ সালে ২৬তম হবে। আর পরিকল্পনামন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.৮৬%, জিডিপির আকার ২৭৪ বিলিয়ন ডলার, মাথাপিছু গড় আয় ১৭৫১ ডলার, দারিদ্র্যের হার ২১.৮% ও অতি দারিদ্র্য ১১.৩%, জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ ৩১.২৩% (সরকারি ৭.৯৭% ও বেসরকারি ২৩.২৬%) ও সঞ্চয়ের হার ২৭.৪২%। অন্য এক তথ্য মতে, বর্তমানে জাতীয় বাজেটের রাজস্ব ব্যয় আত্মনির্ভর হয়ে উদ্বৃত্ত হয়েছে। অবশ্য এডিপিতে বিদেশ নির্ভরতা ৩৪% রয়েছে এখনও। তাই বিদেশি ঋণ ও অনুদান ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর এর সুদ ও কিস্তি পরিশোধ করতে হয় মোট বৈদেশিক ঋণের ৩৬%।
সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে, দেশে উন্নতি হয়েছে, কিন্তু এর সুফল ভোগ করছে কারা? বিবিএস’র হিসাব-২০১৬ অনুসারে, সবচেয়ে গরিব ৫% মানুষের আয় ২০১০ সালের ০.৭৮% থেকে কমে ০.২৩%, সবচেয়ে ধনী ৫% মানুষের আয় ২০১০ সালে ২৪.৬১% থেকে বেড়ে ২৭.৮৯%, শীর্ষ ১০% মানুষের আয় ৩৫.৮৪% থেকে বেড়ে ৩৮.১৬% হয়েছে। অন্যদিকে, সবচেয়ে গরিবের আয়ের ভাগ ২% থেকে কমে ১.০১% হয়েছে। অর্থাৎ জনসংখ্যার ৯০% মানুষের আয় কমেছে বা এক জায়গাতেই থমকে আছে। আর ১০% মানুষের আয় অনেক বেড়েছে। ফলে আয় বৈষম্য ব্যাপক হয়েছে ক্রমান্বয়ে, যার নজির বিশ্বে খুব কম! অক্সফামের দ্বিতীয় ‘কমিটমেন্ট টু রিডিউসিং ইন-ইকুয়ালিটি সূচকে ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮তম (গত বছরেও অবস্থান একই ছিল)। আর দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৭ নম্বরে। অক্সফাম বলেছে, জাতিসংঘের সদস্য ১৯৩টি দেশ ২০১৫ সালে এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে কাজ করার অঙ্গীকার করে। তবে আয় ও সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে আনতে না পারলে এসডিজির প্রথম লক্ষ্য অনুযায়ী দারিদ্র্য দূর করা অসম্ভব। অপরদিকে, এসডিজি বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশকে নিয়মিত বিনিয়োগের অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে হবে ৯২৮.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সে মতে, প্রতি বছর গড়ে ৬৬.৩২ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন, যার ৮৫% ব্যয় করতে হবে নিজস্ব অর্থে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এসডিজির বেশিরভাগই পূরণ করা সম্ভব হবে না। আর টিআইবির অভিমত, এসডিজি পূরণের প্রধান বাধা দুর্নীতি। যা’হোক, ইউনেস্কো প্রতিবেদন-২০১৭-১৮ মতে, দৈনিক ২,১২২ কিলো-ক্যালরির নিচে খাদ্যগ্রহণ অনপেক্ষ দারিদ্র্য ও ১,৮০৫ কিলো-ক্যালরি খাদ্যগ্রহণ অতি-দারিদ্র্য। বাংলাদেশে জনপ্রতি দৈনিক ২,১২২ কিলো-ক্যালরি খাদ্যগ্রহণের মাত্রা ঠিক রেখে এর ক্রয় ব্যয় ও খাদ্য-বহির্ভূত ভোগ-ব্যয়কে একত্র করে মাসিক জনপ্রতি ১,৬০০ টাকার নিচের আয়কে অনপেক্ষ দারিদ্র্য, আর ১,৩০০ টাকার নিচের আয়কে অতি-দারিদ্র্য হিসেবে গণ্য করে বিবিএসর খানা জরিপ-২০১৬ অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার ২৪.৩%, আর অতি-দরিদ্রের হার ১২.৯%। বর্তমানে তা ২২% হয়েছে। উল্লেখ্য যে, বিবিএসর এই হিসেব মতে, দারিদ্র্যের হার ছিল ২০০৫ সালে ৪০% ও ২০১০ সালে ৩১%। দেশের দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের অবদান সবচেয় বেশি বলে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের অভিমত। ইউনিসেফের হিসাব মতে, দারিদ্র্য নির্ণয় করা হলে দেশে দারিদ্র্যের হার অনেক বেশি হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. বারকাতের অভিমত স্মরণীয়। তিনি কয়েক মাস আগে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘সরকারি পরিসংখ্যানিক অর্থনীতি যাই বলুক না কেন, গবেষণা মতে, আমাদের দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে দারিদ্র্যের বহুমুখী মানদন্ডে ১০.৫৫ কোটি মানুষই দারিদ্র্য-বঞ্চিত, ৫.০১ কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত, আর অবশিষ্ট ৪৪ লাখ মানুষ ধনী। বিগত ৩০ বছরে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪.৫৫ কোটি। অন্যদিকে, ২০১৭ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের তথ্য মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। আরও জানা গেছে, দেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু-শ্রমিকের সংখ্যা কমলেও এখনো শিশু-শ্রমিকের সংখ্যা কমেনি। ১৮টি খাতে এখনো দেশে ৩৪.৪৫ লাখ শিশু কর্মরত, যাদের মধ্যে ১২.৮০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত আছে। এরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সা¤প্রতিক তথ্য মতে, ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে কোটিপতি ব্যাংক আমানতকারীর সংখ্যা ৭০,৪৬৩ জন। তন্মধ্যে ৫০ কোটিটাকার বেশি ৯৪১ জন, ৪০ কোটি টাকার বেশি ৩৬০ জন, ৩৫ কোটি টাকার বেশি ২০৬ জন, ৩০ কোটি টাকার বেশি ২৮৪ জন, ২৫ কোটি টাকার বেশি ৫১০ জন, ২০ কোটি টাকার বেশি ৮২০ জন, ১৫ কোটি টাকার বেশি ১,৩১৯ জন, ১০ কোটি টাকার বেশি ২,৯২৬ জন, ৫ কোটি টাকার বেশি ৮,১২৭ জন ও এক কোটি টাকা আমানতকারী ৫৪,৯৭০ জন। ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ৯ লাখ ৯২ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। তন্মধ্যে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশিকোটিপতিদের। উক্ত পরিসংখ্যান মতে, দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ১৯৭২ সালে ৫ জন, ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে ৪৭ জন, ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে ৯৮ জন, ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ৯৪৩ জন, ১৯৯৬ সালের জুনে ২৫৯৪ জন, ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে ৫১৬২ জন, ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ৮,৮৮৭ জন, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ১৯,১৬৩ জন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত ৭০,৪৬৩ জন। স্মরণীয় যে, বর্তমান সরকারের প্রায় ১০ বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৫১,৩০০ জন। যা গড় করলে দাঁড়ায় বছর প্রতি ৫ হাজারের বেশি। এ ব্যাপারে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলামের অভিমত হচ্ছে, কোটিপতি আমানতকারী বাড়ার ফলে সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। সমাজে একটি বিশেষ শ্রেণি ধনী হয়ে যাচ্ছে। অন্য শ্রেণি পেছনে পড়ে যাচ্ছে। কোটিপতিদের একটা বড় অংশ কালো টাকার মালিক। দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো না থাকার কারণেও কোটিপতিদের আমানত বাড়ছে। ওয়েলথএক্সের ওয়ার্ল্ডআলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মতে, ধনীদের দ্রæত সম্পদ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করছে। উল্লেখ্য যে, শুধু মানুষের মধ্যেই আয় বৈষম্য নেই, অঞ্চলের মধ্যেও ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। বিবিএস’র প্রতিবেদন-২০১৬ মতে, কুড়িগ্রাম জেলায় দারিদ্র্যের হার ৭০%। আর অন্য ৬টি জেলায় এর চেয়ে কিছু কম। অনেক জেলায় দারিদ্র্য বেড়েছে!
ব্যক্তি ও অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য সংঘটিত হয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে। তাই দেশের পুরাতন ও নব্য কোটিপতিরা কারা এবং কিভাবে এই অর্থের মালিক হয়েছে তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া আবশ্যক। জানা মতে, এই ধনীদের বেশিরভাগই রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও আমলা। অর্থমন্ত্রী এক বাজেট বক্ততায় বলেছেন, জাতীয় অর্থনীতির ৬০% কালো টাকা। আর বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক সভায় বলা হয়েছে, ‘দেশে পুঞ্জিভূত কালো টাকার পরিমাণ প্রায় ৫-৭ লাখ কোটি টাকা।’ এই সম্পদ তারা সংগ্রহ করেছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ, শেয়ারকেলেঙ্কারি, দখল, রাজস্ব ফাঁকি, দুর্নীতি, মজুদদারি, লুটপাট, অবৈধ ব্যবসাসহ নানাভাবে। কারণ, দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। দুর্নীতি নেই এমন স্থান এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন! আর এই দুর্নীতির কারণে বছরে ৩-৪% প্রবৃদ্ধি কম হচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক দেউলিয়া হতে চলেছে। দেশ ঋণ খেলাপির দিক দিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট ঋণের ১০.৪%। ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মোট ঋণের ৪৮ শতাংশই খেলাপি ঋণ। এছাড়া, ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকের বড় অংশই খেলাপি ঋণ বলে জানা গেছে। ‘ইকোনোমিক অ্যান্ড সোশ্যাল সার্ভে অব এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোট জিডিপির সঙ্গে আয়কর ঘাটতিতে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। পার্থক্য ৭.৫%। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ঘাটতি ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। টিআই দুর্নীতির ধারণা সূচক-২০১৭ মতে, ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭তম। গত বছর ছিল ১৫তম। বাংলাদেশের স্কোর ১০০’র মধ্যে ২৮। আগের বছর ছিল ২৬। উল্লেখ্য যে, দেশের ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা এবং বিনিয়োগ ছাড়াও বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে। জিএফআই রিপোর্ট অনুসারে, ‘২০০৪-২০১৪ সাল পর্যন্ত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর পর আরও ৩টি বছর পার হয়েছে। এ সময়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে বলে অনুমেয়। অর্থ পাচারকারীদের অনেকেই কানাডায় বেগম পাড়া তৈরি এবং মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করেছে। সুইচ ব্যাংকে টাকা রাখার পরিমাণও বিপুল। এসবের কিছু তথ্য ইতোমধ্যেই কতিপয় আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। সুইচ ব্যাংক সেপ্টেম্বর, ১৮ থেকে তাদের হিসাব ওপেন করে দিয়েছে। সেখান থেকে হিসাব সংগ্রহ করা হলেই দেখা যাবে কার কত টাকা আছে এবং তারা কারা। এসব তথ্য প্রকাশিত হওয়া আবশ্যক। কারণ, এই অবৈধ উপার্জনকারীরা জাতীয় শত্রু। এদের দমন ও দুর্নীতির অর্থ উদ্ধার করতে না পারলে দেশের কাক্সিক্ষত উন্নতি হবে না। রাজনীতিও কলুষমুক্ত হবে না। তাই অর্থ পাচার, ঋণ খেলাপি ও দুর্নীতি সংক্রান্ত পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা আবশ্যক এবং তা অবিলম্বে। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। কারণ, দেশের এই উন্নতিতে তাদের তেমন অবদান নেই। দেশের উন্নতি হচ্ছে কৃষক, শ্রমিক ও প্রবাসীদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে। কিন্তু তার সুফল পাচ্ছে না তারা। তাই এই অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি।
দেশের উন্নতি অনুযায়ী কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বেকারের সংখ্যা সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এর মধ্যে শিক্ষিতরাই বেশি, যা অদূর ভবিষ্যতে কমবে না। কারণ, বিনিয়োগ প্রবাহ আশাব্যঞ্জক নয়। কয়েক বছর যাবত জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগের হার প্রায় ২২% আর সরকারি প্রায় ৭%। অন্যদিকে, এফডিআইও হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগের প্রত্যাশা ছিল ৫৮৭ কোটি ডলার; কিন্তু এসেছে ২৭৯ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের বছর ছিল ৩০৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ মোট বিনিয়োগ জিডিপির প্রায় ২৮%। কিন্তু কাঙক্ষিত উন্নতির জন্য দরকার ৩৪%। অর্থাৎ বিনিয়োগ ঘাটতি চলছে। তাই কর্মসংস্থান বাড়ছে না। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ সিডার ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ সমীক্ষা মতে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। যার শিক্ষাগত যোগ্যতা যত বেশি, তার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তত কম। যারা দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে, তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭.৫%। আর যারা অনার্স-মাস্টার্স পাস করেছে, তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬.৪%। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের বেকারত্বের হার বেড়ে ২০% পেরিয়ে যাবে। অপরদিকে, যাদের কর্মসংস্থান আছে, তাদের আয় ব্যয় অনুপাতে নয়। যেমন: জাতীয় নিম্নতম মজুরী মার্কিন ডলারে বাংলাদেশে ৭১,পাকিস্তানে ৯০, ভারতে ১০০, ভিয়েতনামে ১৩০ ও চীনে ২৪০। স¤প্রতি কম্বোডিয়ায় ১৮২ ডলার করা হয়েছে। অর্থাৎ এই অঞ্চলে মধ্যে শ্রমিকের মজুরী সবচেয়ে কম বাংলাদেশে। অন্যদিকে জীবন যাত্রার ব্যয় বেশি। তাই সিপিডি একে আয়-হীন কর্মসংস্থান হিসেবে অভিহিত করেছে। অবশ্য সরকারি কর্মচারীদের বেতন খুব ভালো। তাদের সংখ্যা নগণ্য। মোট ১৪ লাখের মতো। নারীর শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে কিন্তু সে অনুসারে কর্মসংস্থান বাড়েনি। সরকারি চাকরিতে এখনও নারীর সংখ্যা ৮% এর বেশি নয় বলে প্রাক্তন এক সচিব স¤প্রতি টকশোতে বলেছেন। ব্যাংক-বীমাতেও তদ্রæপ। নারীর কর্মসংস্থান বেড়েছে শুধুমাত্র গার্মেন্টে। অন্য খাতে তেমন বৃদ্ধি পায়নি। আর নারী-পুরুষের মজুরী বৈষম্য আকাশ-পাতাল! বাল্যবিবাহ এখনও ৫৯% বলে ইউনিসেফের সা¤প্রতিক প্রতিবেদনে প্রকাশ। এটা অব্যাহত থাকলে নারীর শিক্ষার হার ও ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি এবং মাতৃ মৃত্যুর হার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পাবে না। এসডিজিও অর্জিত হবে না। অপরদিকে, উন্নয়ন অন্বেষণ ২০১৭ সালের বার্ষিক অর্থনৈতিক পর্যালোচনায় উল্লেখ করেছে, (১) গত পাঁচ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ শতাংশের উপর থাকলেও দরিদ্র্য দূরীকরণের হার হ্রাস পেয়েছে এবং আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ এই ত্বরিত প্রবৃদ্ধি নিম্ন আয়ের মানুষের কাক্সিক্ষত সুফল বয়ে আনতে পারেনি। (২) দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বার্ষিক হার ২০০৩- ২০১০ সাল পর্যন্ত ৩.১% আর ২০১১-২০১৬ সাল পর্যন্ত ১.৮%। (৩) ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি গড়ে এক শতাংশেরও কম। বর্তমান অর্থবছর শেষে এই স্থবিরতা দীর্ঘায়িত হতে পারে যা ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে আরও ব্যাহত করতে পারে। (৪) দেশে রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা জিডিপির ২২% পর্যন্ত হলেও বস্তুত রাজস্ব আদায়ের গড় প্রবৃদ্ধি গত পাঁচ বছরে ১৩.৯৬%। যা এর আগের পাঁচ বছরে (২০০৭-১২) ১৮.৪% ছিল। (৫) দেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়ছে। যেমন: ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি এবং ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ডলার। (৬) জিডিপির অন্যতম খাত কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার কমছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৫০%। এরপর ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ৩.৪% হয়েছে। তবে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়লেও সেবাখাত স্থবির। অপরদিকে, গত ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সানেম আয়োজিত কর্মশালায় বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনে তেমন অগ্রগতি হয়নি। যে কারণে সামগ্রিক উন্নয়ন-চিত্র এক রকম; আর প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের চিত্র আরেক রকম। মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি এসব সূচকে দেশ অনেক এগোচ্ছে। কিন্তু সুশাসন, জবাবদিহি ও সহজে ব্যবসা করার সূচকে আবার পেছনে হাঁটছে। রাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন বলা হলেও সেগুলো প্রকৃত অর্থে স্বাধীনভাবে কাজ করে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং আমলাতন্ত্রে সমন্বয়ের ঘাটতি এ জন্য দায়ী। এর ফলে অনেক উন্নয়ন কর্মকান্ড সময়মত শেষ হচ্ছে না। আবার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সুফল সবাই সমানভাবে পাচ্ছে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।