Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠন ও নিরাপত্তাহীনতা ঠেকাতে জাতীয়-আঞ্চলিক ঐক্য জরুরি

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৭ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

হেজিমনি ও যুদ্ধবাদি অর্থনৈতিক থিউরীর বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কনল্ফিক্টস রেজ্যুলেশন বা সংঘাত নিরসন বিশ্ববিদ্যালয় ও কুটনৈতিক কোরে একটি বড় আলোচ্য বিষয়। প্রত্যক্ষ সংঘাত ও বিভাজন এড়িয়ে নিরবে ধীরস্থিরভাবে পথচলার মধ্য দিয়ে যে কোন রাষ্ট্রশক্তি তার সম্ভাবনার লক্ষ্যে পৌছাতে সক্ষম হতে পারে। পশ্চিম ইউরোপ, সাম্প্রতিক চীন ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো তার জ্বলন্ত প্রমান। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে সব যুদ্ধ ও কৌশলগত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দ্বন্দ রয়েছে তা’ কোন মানদন্ডেই চিরস্থায়ী নয়। কোন কোন বিশেষ দল বা গোষ্ঠিকে নিধন বা নির্মূলের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কোনকালেই সাধারণ মানুষের সমর্থন পায়নি। হিটলারের হুহুদি নির্মূল বা মার্কিনীদের কমিউনিস্ট নির্মূলের ফর্মূলা অথবা সাম্প্রতিক সময়ের ইসলামোফোবিয়া ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের নামে মসলমানদের উপর নিপীড়নের ফলাফল বিশ্বকে আরো অস্থিতিশীল ও অনিরাপদ করে তুলেছে। দুই হাজার এক সালের এগার সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্ক ও পেন্টাগনে সন্ত্রাসী বিমান হামলা কারা কিভাবে ঘটিয়েছিল তা নিয়ে ব্যাপক মত পাথর্ক্য ও থিসিস, এন্টি-থিসিস রয়েছে। তথাকথিত আল-কায়েদার উপর দোষ চাপিয়ে মুসলিম বিশ্বের উপর সন্ত্রাসবাদি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার কৌশল ইতিমধ্যে ধরা পড়ে গেছে। বাহ্যিক আলামতে আমরা যদি মেনে নেই যে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার পেছনে আল-কায়েদার হাত ছিল, তার পেছনের সত্যটি হচ্ছে, আল কায়েদা গঠন এবং শক্তিশালী করে তুলেছিল সিআইএসহ পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সেটি ছিল স্নায়ুযুদ্ধকাল, যখন সোভিয়েত সেনারা আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল, প্রতিরোধে রুখে দাঁড়িয়েছিল আফগান তালেবানরা। শত্রুর শত্রুকে মিত্র বানিয়ে মূল শত্রুকে পরাজিত করার কৌশল হিসেবে সামরিক, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা। ওসামা বিন লাদেন পরিবারের সাথে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ পরিবারের বাণিজ্যিক লেনদেনের সম্পর্কও সুবিদিত। তালেবান ও আল-কায়েদার সমন্বিত প্রতিরোধ যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনী পরাস্ত হয়ে বিদায় নেয়ার মধ্য দিয়েই মূলত: সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের ঘন্টা বেজে যায়। আশির দশকের শেষে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক পতনের পর তালেবান ও আল কায়েদা ইসরাইল ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু আল-কায়েদা বা তালেবান নয়, মধ্যপ্রাচ্যের সম্ভাবনাময় আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে আবিভর্র্‚ত হয়ে ইসরাইলের জন্য হুমকি হয়ে দাড়াঁয়, এমন যে কোন সম্ভাবনাকে সমূলে ধ্বংস করাই ছিল ওয়ার অন টেররিজমের নামে নাইন-ইলেভেন পরবর্তি মধ্যপ্রাচ্যে সব সামরিক আগ্রাসনের মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের সর্বশেষ ধাপে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ উস্কে দেয়ার পাশাপাশি ইসরাইল ও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আইএস জুজু সৃষ্টি করেছে। আইএস জুজু দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বাদশা-আমীরদের কাছে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে এবং ইসরাইলী ও মার্কিন কোম্পানিগুলো প্রায় বিনামূল্যে কোটি কোটি ব্যারেল পেট্রোলিয়াম চুরি করেছে। ইরাণ ও রাশিয়ার সহায়তা নিয়ে সিরীয় বাহিনী পশ্চিমা মদদপুষ্ট বিদ্রোহী ও আইএস দমনে সফল হওয়ার মধ্য দিয়ে ইসরাইল ও মার্কিনীদের নীলনকশা ভেস্তে যেতে বসেছে। তবে গত দেড় দশক ধরে চলা এই সা¤্রাজ্যবাদি যুদ্ধ বিশ্বমানবতা ও ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপর যে রক্তাক্ত, দগদগে ক্ষত সৃষ্টি করেছে তা সহজে মুছে যাবেনা।
ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের অভ্যুত্থানে ২০১৪ সালের শেষদিকে সউদি সমর্থিত আব্দুল্লাহ সালেহ গদিচ্যুত হয়ে সউদি আরবে পালিয়ে যাওয়ার পর ইয়েমেনি বিদ্রোহীদের পরাস্ত করতে বিশাল সামরিক জোট গঠন করে সউদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে দরিদ্র ও দুর্বল অর্থনীতির দেশ ইয়েমেনে সউদি জোটের বোমা বর্ষণ শুরুর আগে একে একটি সীমিত পরিসরের যুদ্ধ হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল দুই সপ্তাহের মধ্যেই তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে। ইতিমধ্যে প্রায় ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও সউদি জোট কোন সামরিক বা রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। তবে ইসলামি সভ্যতা ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রাচীন পাদপীঠ ইয়েমেনের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যমন্ডিত স্থাপত্য নির্দশন ও জনপদগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই সাথে ইয়েমেনের প্রায় আড়াইকোটি মানুষ ইতিহাসের বর্বরতম সামরিক হামলার লক্ষবস্তুতে পরিনত হয়ে মানবিক অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। ঠিক কত সংখ্যক ইয়েমেনি এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে তার সঠিক হিসাব খুঁজে পাওয়া হয়তো সম্ভব নয়। তবে অন্তত তিরিশ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিনত হয়েছে। জাতিসংঘের ত্রাণ ও মানবাধিকা বিষয় সংস্থার তরফ থেকে বলা হয়েছে, ইয়েমেনের জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ মানুষ বর্তমানে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা. জীবনের নিরাপত্তা এবং শিশুসহ সব মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নুন্যতম খাদ্য ও ত্রান সহায়তার নিশ্চয়তা সেখানে নেই। বিমান হামলা ও যুদ্ধের টার্গেট হিসেবে তো বটেই, দুর্ভীক্ষ ও কলেরায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। ব্যাপক আন্তজার্তিক সমালোচনার মুখে গত জানুয়ারীর শেষদিকে সউদি আরব ইয়েমেনে ‘কমপ্রিহেনসিভ হিউমেনিটারিয়ান অপারেশন’ নাম দিয়ে সাড়ে তিনশ কোটি টলারের যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল তা মানবিক বিপর্যয় রোধে কোন ভ‚মিকা রাখতে পারেনি। ইয়েমেনে সউদি ঘোষিত ত্রাণ কর্মসূচি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক রেসকিও কমিটির(আইআরসি) সিনিয়র ডিরেক্টর আমান্ডা ক্যাটানজানো এই সহায়তা প্যাকেজকে কমপ্রিহেনসিভ বা হিউম্যানিটারিয়ান বলে মানতে নারাজ। তার মতে, সহায়তার নামে ওয়ার টেকটিক বলে অভিহিত করেছেন। কথিত কমপ্রিহেনসিভ মানবিক সহায়তার প্যাকেজ ঘোষিত হওয়ার পর গত ন মাসে ইয়েমেনে কঙ্কালসার, মূমূর্ষূ মানুষের সংখ্যা আরো বেড়েছে।
‘বিশ্বে প্রতিদিন ৩২ হাজার শিশু (না খেয়ে) মারা যায়’। ইয়েমেনে মানবিক সংকট এতটা তীব্র হওয়ার আগে ২০১৫ সালে কানাডিয়ান কলামিস্ট ও সমাজত্বাত্তি¡ক লোথিয়ান হার্ভে তার লেখা একটি নিবন্ধের এই শিরোনাম দিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কান গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের শুরুতেই ৭৮ বছর(বর্তমানে ৮১) বয়েসী প্রাজ্ঞ লেখক ও সমাজচিন্তক হার্ভে লোথিয়ান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাদীসের উদ্ধৃতি তুলে ধরেছিলেন, “Anyone of you who sees wrong, let him undo it with his hand; and if he cannot, then let him speak against it with his tongue, and if he cannot do this either, then (let him abhor it) with his heart, and this is the least of faith.” Prophet Muhammad (PBUH) অর্থাৎ “তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কাউকে কোন অন্যায় করতে দেখে, তবে সে যেন নিজের হাত দিয়ে তা প্রতিরোধ করে; যদি সে তা না পারে তবে সে যেন মুখ দিয়ে সে কাজের­ প্রতিবাদ করে, যদি এ দু’টির কোনটাই না পারে তবে সে যেন অন্তর থেকে তা ঘৃণা করে, এটা হচ্ছে ইমানের ন্যুনতম দায়িত্ব”। আজকের দুনিয়ার প্রায় ২শ কোটি মুসলমান যদি এই ন্যুনতম ইমানি দায়িত্ব পালন করতো তাহলে মুসলমান বিশ্বে তো বটেই বিশ্বের কোথাও এমন হাহাকার ও মানবিক বিপর্যয় ঘটত না। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কারণে প্রতিদিন ৩২ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়, এ হিসেবে বছরে ১ কোটি ১৬ লক্ষের বেশী শিশু মারা যায়। অথচ বিশ্বে যে পরিমান খাদ্য উৎপাদিত হয় তা সব মানুষের ক্ষুধা নিবারণের জন্য যথেষ্ট। ক্ষুধা দারিদ্র্য ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বর্তমানে বছরে যত মানবশিশু মারা যাচ্ছে, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কালের যুদ্ধ ও স্বাভাবিক মৃত্যুর সম্মিলিত অংকের চেয়ে বেশী। বিশ্বে মানুষের এই মানবিক সংকট ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের অতৃপ্ত ধনলিপ্সা ও বাকি দুনিয়ার সম্পদ লুণ্ঠনকে দায়ী করেন হার্ভে লোথিয়ান। পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিকপালদের কাছে তাদের ক্ষমতা ও বিত্ত-বৈভবের অবস্থান কোটি কোটি নিস্পাপ, অসহায় মানবশিশুর জীবনের মূল্যের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নিরপরাধ-নিস্পাপ শিশুদের জীবনের চেয়ে ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার প্রতিপত্তিকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে করা পশ্চিমা নেতারা নিশ্চিতভাবে মানসিক বিকারগ্রস্ত। পশ্চিমারা ভোট দিয়ে মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষদেরকে নেতা হিসেবে নির্বাচিত করছে। বলাবাহুল্য, হার্ভে লোথিয়ানের এই নিবন্ধটি প্রকাশের প্রায় একবছর পর ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সিরিয়া, ইয়েমেন যুদ্ধের সর্বশেষ মানবিক বিপর্যয় এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবাদী অনৈতিক ভ’মিকার পর পশ্চিমা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে হার্ভে লোথিয়ানের মূল্যায়ন আরো স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। হার্ভে পশ্চিমা বিশ্বের নেতাদের বিকারগ্রস্ত, অমানবিক লুণ্ঠন প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সব মানুষের প্রতিবাদী হয়ে উঠার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তার মতে কেউ যদি মনে করেন, যারা মারা যাচ্ছে ওরা আমাদের দেশের শিশু নয়, সাদা চামড়ার নয়, আমাদের প্রতিবেশী বা নিজেদের সন্তান নয়। তাহলে জেনে নিন, বিকারগ্রস্তরা নিজেদের সন্তানের জীবনের ব্যাপারেও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকেই তার এই বক্তব্যের সারবত্তা প্রমানিত হয়। এটা এখন শুধু পশ্চিমা দুনিয়ার চিত্র নয়, সারাবিশ্বেই এই ধারার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শোষণের চিত্র বিদ্যমান। বিশ্বনবী মোহাম্মদ(স.) এর হাদীস উদ্ধৃত করে নিবন্ধের সূচনা করেছিলেন, আর শেষ করেছেন অ্যাকুইনাস ও সেন্ট অগাস্টিনের উদ্ধৃতি দিয়ে। অ্যাকুইনাস বলেছেন, ‘যদি রাগান্বিত হওয়ার মত ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরও কেউ সংক্ষুব্ধ না হয় তা অনৈতিক, কারণ, রাগ হচ্ছে ন্যায় বিচারের অনুবর্তি। তুমি যদি অন্যায় অবিচারের মধ্যেও রাগান্বিত বা সংক্ষুব্ধ না হয়ে বসবাস করতে থাক, তা তোমার অনৈতিকতা ও বিচার-বোধহীনতাকেই প্রকাশ করে।’ আর সেইন্ট অগাস্টিন বলেছেন, প্রত্যাশার দুইটি সন্তান, একটি হচ্ছে রাগ বা সংক্ষোভ, অন্যটি হচ্ছে এ থেকে উত্তরণে কিছু একটা করার জন্য করেজ বা ইচ্ছাশক্তি। তবে বাস্তবতা ও প্রত্যাশার পুরো বিষয়টা উঠে এসেছে হার্ভে লোথিয়ানের উদ্ধৃত করা সহি হাদীসে। মুসলিম বিশ্ব যখন সবচেয়ে বেশী, অবিচার, শোষণ ও আগ্রাসনের শিকার তখন সবার্ধিক প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লুন্ঠণ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত শাসকশ্রেনী রাষ্ট্রযন্ত্রকে রাষ্ট্রের মালিক জনগনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে মূলত রাষ্ট্রঘাতি খেলায় মেতে ওঠে। এক সময় পুরো মধ্যপ্রাচ্য, আরববিশ্ব ও পশ্চিম আফ্রিকা ছিল উসমানীয় খেলাফতের শাসনাধীন। তখন আরব-অনারব এশীয়,আফ্রিকীয় মুসলমানদের মধ্যে উম্মাহ চেতনা ছিল। সেই চেতনা শত শত বছর ধরে বিশাল উসমানীয় সাম্রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছিল। রাসূল(স.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, সাদার উপর কালোর, আরবের উপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নাই। কোরানিক শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবোধ, ন্যায়পরায়ণতা, ত্যাগ, শান্তি ও সাম্যের বানী থেকে সরে গিয়ে মুসলমানদের মধ্যে আঞ্চলিক ও জাতিগত বিভাজনের মধ্য দিয়ে বিদ্বেষ, হানাহানি ও আধিপত্যবাদি রাষ্ট্রচিন্তার সুত্রপাত। তা না হলে পশ্চিমাদের বস্তুবাদি লুণ্ঠন প্রক্রিয়া মুসলমানদের এমন দেউলিয়া অবস্থায় ঠেলে দিতে পারত না। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্ববাস্তবতার সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় দিক হচ্ছে, আরব জাতীয়বাদ উস্কে দিয়ে উসমানীয় খেলাফত ভেঙ্গে অনেকগুলো রাজপরিবার সৃষ্টি করা। এর আগেই মধ্যপ্রাচ্যের ভ‚-গর্ভে বিপুল পরিমান পেট্টোলিয়াম মজুদের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছিল ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদীরা। গত একশ বছরে সেই ফসিল জ্বালানীর উপর ভর করে পশ্চিমাবিশ্বের পুঁজিবাদি শিল্পায়ণ চরম বিকাশ লাভ করার পাশাপাশি সারাবিশ্বের সম্পদ লুণ্ঠনের একচ্ছত্র ক্ষমতা নিজেদের হাতে অটুট রেখেছে। পেট্টোলিয়ামের রাজস্বে ধনী আরব রাষ্ট্রগুলো নিজেদের সম্পদকে নিজেদের ইচ্ছায় কাজে লাগানোর মত স্বাধীনতাও ভোগ করতে পারেনি। রাজতান্ত্রিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আরব জনগনের এই বঞ্চনাবোধের বহি:প্রকাশের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে আরব শাসকরা। পশ্চিমাদের বশ্যতা আরবদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি নয়, এটা গত দুই দশকে স্পষ্ট হয়ে গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই কঠিন সত্যটিকে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে কদাকারভাবে প্রকাশ করে দিয়েছেন। সম্প্রতি সউদি বাদশা সালমানের সাথে সাক্ষাৎকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, মার্কিন নিরাপত্তা ছাড়া সউদি আরব দুই সপ্তাহও টিকবেনা। বিশ্বের মুসলমানরা তাদের কেবলা ও মক্কা-মদিনার পূণ্যভ’মি হিসেবে সউদি আরবের পবিত্রতা স্বীকার করে। প্রতিবেশীদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা বা কোন সা¤্রাজ্যবাদী পরিকল্পনাও সউদি আরবের কখনো ছিলনা। তাহলে সউদি আরব কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের এক নম্বর ক্লায়েন্ট হয়ে গেল। আরব জনগনের জন্য আল্লাহর অন্যন্য উপহার তেলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত বছরে হাজার হাজার কোটি ডলার পশ্চিমারা নিয়ে যাচ্ছে মারনাস্ত্রের বিনিময়ে। অথচ ইসলামি দুনিয়ায় কোটি কোটি শিশু খাদ্য, পুষ্টি, বাসস্থান ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ইয়েমেনের দরিদ্র মানুষদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করতে যে পরিমান সমরাস্ত্র ও যুদ্ধব্যয় করা হচ্ছে তা দিয়ে ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধপীড়িত জনপদ ও শিশুদের শিক্ষা, নিরাপত্তা ও পূর্নবাসন সম্ভব। আরবদের তেণসম্পদের টাকায় এখন আরব জনপদগুলোকে ধ্বংস করা হচ্ছে। লাভবান হচ্ছে এমআইসি নির্ভর পশ্চিমা অর্থনীতি। অতএব নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের হুমকি টিকিয়ে রাখতে চাইবে এবং আলকায়েদা, তালেবান, আইএস, সাদ্দামের ডাব্লিউএমডি, ইরানের পরমাণু অস্ত্র এবং রিজিম চেঞ্জের নতুন নতুন জুজু সৃষ্টি করতেই থাকবে। এভাবে ধ্বংসের খেলা খেলতে খেলতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিজেই এখন আত্মঘাতি হয়ে উঠেছে। গত দুই দশকের ধারাবাহিকতার শেষ ধাপে এসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই আত্মঘাতি বাস্তবতার মুখোশ উন্মোচিত করে চলেছেন। শান্তি, নিরাপত্তা ও সংঘাত নিরসনে বিশ্বসম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার পাশাপাশি চীনের সাথে অপরিনামদর্শি বাণিজ্য যুদ্ধ এবং সউদি আরবের সাথে হুমকি ও অসৌজন্যমূলক আচরণ বিশ্বরাজনীতিতে একটি নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মেরুকরণ নিশ্চিত করতে চলেছে। বাদশাহ সালমানের সাম্প্রতিক রাশিয়া সফর এবং ইরাণের সাথে সউদি আরবের সন্ধি স্থাপনের যে সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে তা যদি সম্ভব হয়, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় মধ্যপ্রাচ্যের উপর পশ্চিমা আধিপত্যের দিন শেষ হতে চলেছে। আঞ্চলিক, জাতিগত ও রাজনৈতিক বিরোধকে কাজে লাগিয়ে দেশগুলোকে দুর্বল করে রাখার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদি লুণ্ঠন কায়েম রাখা হচ্ছে। তৃতীয়বিশ্বের দুর্বল শাসকশ্রেণী ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদী শক্তির সাথে আপস করে জনগনের সম্পদ ও নিরাপত্তা তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে। বিভাজনের রাজনীতি পরিহার করে ঐক্য ও সহাবস্থানের পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
[email protected]



 

Show all comments
  • Iqbal Ahmed ১৭ অক্টোবর, ২০১৮, ১০:৫৭ এএম says : 0
    People should help each other to come out from this type of problem.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিরাপত্তা


আরও
আরও পড়ুন