Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ইলিশ প্রজনন মৌসুমে মা মাছ রক্ষায় আরো কঠোর হতে হবে

অলিউর রহমান ফিরোজ | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

দেশে চলছে এখন ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা সময়। নিষেধজ্ঞা চলবে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত। এ সময় কোনো জেলে যাতে নদীতে জাল ফেলতে না পারে তার জন্য অনেক মৎস্য কর্মকর্তার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এক শ্রেণির লোভী জেলে রাতে আধারে ইলিশ শিকারে বের হয়। আর শিকারকৃত মাছ কোনো হাট-বাজারে বিক্রি না করে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে বিক্রি করে। তাই এতো আয়োজন এবং নিষেধাজ্ঞা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর হয় না। ইতোমধ্যে কয়েকজন জেলে আইন অমান্য করে মাছ শিকারের দায়ে জেল জরিমানার মুখে পড়েছে। তবে জেলেদের কিছু মৌলিক দাবি সরকার মেনে নিলেও তাতে আছে অনিয়ম। ইলিশ মৌসুমে প্রত্যেক জেলের জন্য রয়েছে ২০ কেজি করে চালের ব্যবস্থা। জেলেদের অভিযোগ তারা তা ঠিক মতো পান না। কেউ পেলেও আবার ২০ কেজির পরিবর্তে পেয়ে থাকে ১০ কেজি। আর ১০ কেজি স্থানীয় রাক্ষসদের পেটে যায়। তাই অনেক গরীব জেলে অভাবের দায়েও নদীতে মাছ শিকার করে থাকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে। জেলেদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার এ বছর ২৯ জেলার ১১২ উপজেলার ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৭শত ৯ জন জেলে পরিবারকে ২০ কেজি চাল দেয়ার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এতে মোট ৭ হাজার ৯ শত ১৪ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হবে। ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকবে ৭ হাজার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। বিশেষ করে শাহেরখালী হতে হাইতকান্দী পয়েন্ট, উত্তর তজুমদ্দিন হতে পশ্চিম সৈয়দ আওলিয়া পয়েন্ট, লতাচাপালী পয়েন্ট এবং উত্তর কুতুবদিয়া পয়েন্ট। তাছাড়া গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, গাইবান্দা, কুড়িগ্রাম, পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, খুলনা, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, জামালপুর, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, ঢাকা, শরিয়তপুর, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষীপুর এবং চাঁদপুরের নদীতে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। নিষেধাজ্ঞার আগে জেলেদের জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়েছে। তখন গ্রাম ও শহর জুড়ে ইলিশ ছিল চোখের পড়ার মতো। অতীতে এতো ইলিশ মানুষ দেখেনি। তাই সাধারণ মানুষের পাতেও এবার ইলিশ পড়েছে। গেলো কয়েক বছর আগে ইলিশ মাছ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছিল। নদী শূণ্য হয়ে পড়েছিল আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ। জেলেরা নদীতে জাল ফেললেও তাদের জালে তেমন একটা মাছ ধরা পড়তো না। তখন সারা বছরই ইলিশ নিধন চলতো। তাই মাছ বেড়ে ওঠার তেমন একটা সুযাগ পেতো না। সরকারে নানামুখী পদক্ষেপ ইলিশ রক্ষায় বড় ধরনের ভ‚মিকা কাজ করছে। তাই বর্তমানে এ মাছ অনেকটাই সাধারণ মানুষের নাগালে। ২০০৭ সালে সামান্য ছোট একটা ৫০০ গ্রামের মাছ ১৫শ’ থেকে ২ হাজার টাকার নিচে কেনা যায়নি। কিন্তু এখন তা ৩ থেকে ৪শ টাকায় মিলছে। তাহলে মাঝখানে কেন ইলিশ পাওয়া যাযনি? মাছ কি কোথায় বেড়াতে গিয়েছিল? বিষয়টি তেমন নয়। তার কারণ, তখন জাটকা মাছ রক্ষায় নেয়া হতো না কোন ধরনের পদক্ষেপ। একদিকে চলতো মা মাছ নিধন অপরদিকে জেলেদের এড়িয়ে যদি কোন মা মাছ ডিম ছাড়তে পারতো তাও বেড়ে ওঠার কোনো সুযোগ পেতো না। নির্বিচারে জাটকা ধরা চলতো। কিন্তু সরকারের প্রচেষ্টায় এখন নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যাচ্ছে। মাছ রক্ষায় বড় ধরনের ভ‚মিকা রেখেছে নদীর জেলেরা। তবে অসাধু কিছু জেলের কারণে মাঝে মাঝে জাটকা ও মা মাছসহ তাদের গ্রেফতারের খবর চোখে পড়ে। তবে দেশের অধিকাংশ জেলে নির্দিষ্ট মৌসুমে নদীতে মাছ আহরণ করতে যায় না। তার কারণ, যখন মা মাছে ডিম পাড়ার সময় হয় তখন জেলেদের মাছ ধরা কিছুদিন বন্ধ রাখা হয় সরকারি নির্দেশে। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে তাদের চাল দেয়ায় হয়। ইলিশ মাছ মূলত সমুদ্রের গভীর লাল পানির মাছ। সমুদ্রের লাল পানিতে এ মাছ বিরচরণ করে থাকে। জেলেরা সমুদ্রে মাছ ধরার সময় লাল পানির সন্ধান করে তখন সেখানে জাল ফেলে মাছ আহরণ করে থাকে। তবে ডিম ছাড়ার সময় শুধু মিঠা পানিতে চলে আসে এ মাছ। একটা পূর্ণ বয়স্ক মা মাছ ৫ লক্ষ ডিম দেয়। দেশের কারেন্ট জাল এ মাছের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে। যে বছর মৎস্য অধিদপ্তর জাটকা রক্ষায় সফল হতে পারে সে বছর মাছের উৎপাদন হয় অনেক বেশি। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসেব মতে, গত বছর ৫ লাখ টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছিল। এ বছর তা ৬ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। সমুদ্রে যে মাছ পাওয়া যায় তার চেয়ে নদীর মাছ খেতে অনেক বেশি সুস্বাধু, তাই বিশেষ করে পদ্মা নদীর মিঠা পানির মাছের আমাদের দেশ ছাড়া পাশের দেশ ভারতেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাদের জামাই আপ্যায়নে ইলিশের কদর খুবই ব্যাপক। পদ্মার ইলিশ খাওয়ার জন্য তারা সারা বছর মুখিয়ে থাকে। কারণ, পদ্মার ইলিশের অমৃত স্বাদ আর কোনো নদীর সাথে মেলে না। নিষেধাজ্ঞার আগে জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়েছে। তখন একেকটি নৌকায় ২শ’ থেকে ২শ ৫০ মণ মাছ ধরে ফিরেছে জেলেরা। এ মাছের একেকটি নৌকা বিক্রি হয়েছে ৪০-৫০ লাখ টাকায়। এতে জেলে পাড়ায় তখন উৎসবমুখর অবস্থা বিরাজ করছিল। নিষেধাজ্ঞার আগে জেলেদের জালে ব্যাপক ইলিশ ধরা পড়ায় সামনের মৌসুমটা তাদের ভালো যাবে। তার কারণ, অভাব-অনটনের কারণে জেলেরা অনেক সময় সরকারের মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময় মানতে পারে না। কিন্তু এবার নদী থেকে তারা অনেক মাছ পাওয়ায় তাদের অভাবজনিত সমস্যা অনেকটা কেটে যাবে বলে মনে হয়। ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে দেশজুড়ে ইলিশ আহরণ, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন, মজুদ এবং বিনিময় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ আদেশ অমান্য করলে কারাদন্ড, অর্থদন্ড এমনকি উভয় দন্ডের বিধান রেখেছে মৎস্য অধিদপ্তর। এ সময় সমুদ্র থেকে মা মাছ ডিম ছাড়তে মিঠা পানির নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসবে। আশা করা হচ্ছে, চলতি বছর ইলিশের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। দেশের উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আসে শুধু ইলিশ থেকে। জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১ শতাংশেরও বেশি। গত ৯ বছরের ব্যবধানে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল যেখানে ২ লাখ ৯৮ হাজার টন। তা গত ৯ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ মেট্রিক টন, যা সামনের মৌসুমে বেড়ে ৬ লাখ টন ছাড়িযে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে, যার বাজার মূল্যে ১৮ হাজার কোটি টাকা। ইলিশ দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশে রপ্তানি ছাড়াও ইলিশের নডুলুস, স্যুপ ও পাউডার তৈরির প্রযুক্তি আবিষ্কার করে তা ইতোমধ্যে বাজারজাত শুরু করেছে। অধিদপ্তর পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক তৈরি করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আইনানুগ কার্যক্রম শেষে ইলিশের ভৌগোলিক, নিবন্ধন (জিআইসনদ) করেছে। ইলিশ একটি পরিযায়ী মাছ। অতিথি পাখির মতো এ মাছ শুধু ডিম পাড়ার জন্য নদীতে আসে। তাই তার জীবন বৃত্তান্ত জানাটা অত্যন্ত জরুরি। তাতে করেই এ মাছটি কীভাবে বেড়ে ওঠে এবং তার খাদ্য কি তা জানা সহজ হবে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দুই বছর ধরে ইলিশের ওপর গবেষণা চালিয়ে তার জীবন-বৃত্তান্ত উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে। ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ইলিশের জীবন রহস্য প্রস্তুতকরণ, জিনোসিক ডাটাবেজ স্থাপনে তাদের এ সাফল্যে মেলে। যেহেতু ইলিশের উৎপাদনের ৬০ শতাংশ আমাদের দেশে হয়। তাই সাগর এবং মেঘনা নদী থেকে পূর্ণবয়স্ক ইলিশ সংগ্রহ করে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিস জেনেটিক্স অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি এবং পোল্টি বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জিনোমি ল্যাবরেটরী থেকে সংগৃহীত ইলিশের উচ্চ গুণগত মানের জিনোমিক ডিএনএ প্রস্তুুুত করা হয়। চাঁদপুরে পুকুরে ইলিশ চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। তাতে তেমন একটা সুফল মেলেনি। ভারত পুকুরে মাছ চাষ করে সারা ফেলে দিয়েছে। সেখানকার গবেষকরা তাদের পুকুরের বিশেষ ব্যবস্থায় মাছ চাষ করছেন এবং সাধারণ মানুষকেও পুকুরে ইলিশ চাষের জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন। ইলিশ মাছের খাদ্য হিসেবে তারা পুকুরেই ন্যারাচাল খাদ্য তৈরি করছেন। তারা নদী থেকে পুকুরের ইলিশ খাওয়ায় আরো সুস্বাদু হবে বলে দাবি করেছেন। ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার বেশিরভাগই সফল হতে দেখা যায় না। তার কারণ হলো দেশের কারেন্ট জালের বিস্তার। দেশের মুন্সীগঞ্জের মুক্তার পুর এবং চট্টগ্রামে কারেন্ট জালের কারখানা রয়েছে। কারখানায় উৎপাদিত জাল বিশেষ ব্যবস্থায় দেশের সর্বত্র বিস্তার করা হয়ে থাকে। কোস্টগার্ড এবং পুলিশ মাঝে মাঝে হানা দিলেও জাল উৎপাদন বন্ধ করতে পারেনি। কারখানার মালিকরা এখন গ্রামের অঁজপাড়া গায়ে লোক চক্ষুর অন্তরালে জালের উৎপাদন বাড়াচ্ছে। তবে জটিলতার বিষয় হলো, মৎস্য অধিদপ্তরের এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারী এবং কর্মকর্তা প্রতিটি জালের মিল থেকে একেকটি মেশিনের জন্য মসোহারা নিচ্ছেন ৩ হাজার টাকা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই অভিযানের খবর আগেই কারখানার মালিক পেয়ে যাচ্ছে। সে কারণে অভিযানের খুব বেশি সফলতার মুখ দেখে না। কারেন্ট জালের মহামারি বন্ধ করা না গেলে ইলিশের জন্য তা সব সময়ই হুমকি হয়ে থাকবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইলিশ

২০ নভেম্বর, ২০২২
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন