Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চিকিৎসা ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৯ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এটা অত্যন্ত দু:খজনক।’ কী দু:খজনক? দু:খজনক এই যে, উপজেলা পর্যায়ে সরকারি ডাক্তাররা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। এমন কি অনেকে নিয়মিত উপস্থিতও থাকেন না। তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে মানুষের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য। তাদের দায়িত্বে অবহেলা ও অনুপস্থিতির কারণে মানুষ সেই চিকিৎসাসেবা পায় না। গত রোববার গণভবনে বাংলাদেশ মেডিকেল সম্মেলন-২০১৮ ও বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে এই দু:খের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এত ডাক্তার নিয়োগ দিচ্ছি, ডাক্তারদের জন্য এত সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি, তারপরও উপজেলায় ডাক্তার পাইনা। তারা উপজেলার হাসপাতালে থাকতে চান না। যে উপজেলার ১০জন ডাক্তার থাকার কথা সেখানে ডাক্তার পাওয়া যায় চার-পাঁচজন।’ এর আগে প্রধানমন্ত্রী রীতিমত ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন এ নিয়ে। বলেছেন, যারা নিয়োগপ্রাপ্ত তারা যদি উপজেলা হাসপাতালগুলোতে থাকতে না চান, ঠিকমত দায়িত্ব পালন না করেন, তাদের উচিৎ চাকরি ছেড়ে দেয়া। এটা নৈতিকতার দাবি। কিন্তু এই নৈতিকতা কতজন ডাক্তারের আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মানুষের চিকিৎসাসেবা দেয়া যে ডাক্তারদের পেশাগত দায়িত্ব ও কর্তব্য, একথা কোনো ডাক্তারেরই না জানার কথা নয়। অথচ অনেক ডাক্তারেরই এই দায়িত্ব-কর্তব্যে মনোযোগ নেই। তাদের মনোযোগ অর্থ উপার্জনে। এহেন বাণিজ্যিক মনোভাবই তাদের দায়িত্বে অবহেলা ও কর্তব্যপালনে গাফিলতির কারণ। তারা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে থাকতে চান না এ জন্য যে, সেখানে চাকরির বাইরে অর্থ কামানোর সুযোগ কম। এ সুযোগ আছে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে। তাই তাদের প্রথম পছন্দ রাজধানী, দ্বিতীয় পছন্দ বড় কোনো শহর। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে প্রাইভেট প্রাকটিসের সুযোগ বেশি। এই সঙ্গে কমিশন বাণিজ্যের সুযোগ বিদ্যমান। যাদের নৈতিক মান এতটাই অবনমিত তাদের পক্ষে চাকরি ছেড়ে দেয়া অসম্ভব।

চাকরি এবং প্রাইভেট প্রাকটিস ও কমিশন বাণিজ্য-সব কিছুই ঠিক রাখতে চান যেসব ডাক্তার, তাদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের কাঙ্খিত চিকিৎসাসেবা পাওয়া কিভাবে সম্ভব? সম্ভব নয়। একারণেই দেশে চিকিৎসাসেবার মান সর্ব নিম্ন পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। সরকার যখন মেডিকেল শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে, একের পর এক মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করছে, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলোতে যাতে যথাযথ মানের শিক্ষা হয়, সে জন্য নজরদারি বাড়াচ্ছে, উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে উন্নত করছে, বেড সংখ্যা ও চিকিৎসা সুবিধা বাড়াচ্ছে, যন্ত্রপাতিসহ নার্স যোগান দিচ্ছে তখন চিকিৎসাসেবার শোচনীয় মানাবনতিকে দুর্ভাগ্যজনক বললেও কম বলা হয়। সুশাসন ছাড়া কোনো ক্ষেত্রেই নাগরিকসেবা নিশ্চিত হতে পারে না। অত্যন্ত তিক্ত হলেও বলতে হচ্ছে, অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো চিকিৎসাক্ষেত্রেও কোনো সুশাসন নেই। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এ ক্ষেত্রেও দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দায়িত্বপালন না করেও চাকরি ঠিক থাকে এবং দায়িত্বে ফাঁকি দিয়েও প্রাইভেট প্রাকটিস করা যায়। এ জন্য কোনো জবাবদিহি করতে হয়না, শাস্তির সম্মুখীন হতে হয় না। এক ধরনের যথেচ্ছাচারিতা এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চিকিৎসাসেবার মান নিয়ে প্রশ্নের অবধি নেই। ডাক্তারের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় রোগীর শারীরিক বিপর্যয়, এমন কি মৃত্যুও অতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত জুন পর্যন্ত দু’বছরে ভুল চিকিৎসা ও ভুয়া ডাক্তারের খপ্পরে পড়ে চার শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতেই মৃত্যু হয়েছে ৬৭ জনের। কিছুদিন আগে চিকিৎসাশিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মহিলা রোগীর এক কিডনির স্থলে দুই কিডনিই ফেলা দেয়া হয়েছে। এ ধরনের অসর্তকতা ও ভুল চিকিৎসায় এর আগেও বিভিন্ন হাসপাতালে কিডনি হারানোর ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া এক অঙ্গ ফেলতে গিয়ে অন্য অঙ্গ ফেলে দেয়া, জমজ সন্তানের একজনকে ভুমিষ্ট করিয়ে অন্যজনকে পেটেই রেখে দেয়া, রোগীর পেটে গজ-ব্যান্ডেজ রেখে পেট সেলাই করে দেয়া ইত্যাদি ধরনের অসম্ভব-অস্বাভাবিক ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। অবহেলা, ভুল চিকিৎসা বা অপচিকিৎসার প্রতিবাদ করায় ডাক্তাররা চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দিয়েছেন, এরূপ ঘটনাও বিরল নয়।

চিকিৎসা মানুষের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার বটে এবং এ জন্য চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা ও মানে মোটামুটি একটা সমতা দেশের সর্বই থাকা উচিৎ। সেটা নেই। গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা অপর্যাপ্ত ও নাজুক। সুযোগ-সুবিধা যতটা আছে তারও ব্যবহার হচ্ছে না। গুরুতর রোগ তো বটেই, সাধারণ রোগের চিকিৎসার জন্যও মানুষকে প্রধানত রাজধানীমুখী হতে বাধ্য হয়। চিকিৎসার সুসাঞ্জস্য বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়াই এর কারণ। সেই রাজধানীতেও যে সব সময় সুচিকিৎসা পাওয়া যায়, এমন কথা বলা যায় না। এখানে চিকিৎসা উচ্চমূল্যে কিনতে হয়, যার সমর্থ সবার থাকে না। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দেখা পেতে মাসের পর মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাদেরও ব্যস্ততা এমন যে, একদিনে ৫০-৬০ জন রোগী দেখতে হয়। তার ওপর তাদের অনেকে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার হওয়ায় সেখানেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। দেখা যায়, তারা কোনো ক্ষেত্রেই সুচারুরূপে দায়িত ¡পালন করতে পারেন না। চিকিৎসার সুষম বিকেন্দ্রীকরণ হলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। রাজধানীতে যানজট, জনচলাচল ও জনঅবস্থানের অধিক্যের একটা উল্লেখযোগ্য কারণ চিকিৎসাপ্রার্থীদের ব্যাপক সংখ্যায় রাজধানীতে আসা। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই যে বিবিধ অনিয়ম, অব্যবস্থা, বিশৃংখলা, স্বেচ্ছাচারিতা বিরাজ করছে তার অবসান হওয়া একান্তভাবেই কাম্য। সুশাসন, শৃংখলা, জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা প্রতিষ্ঠিত না হলে এ অবস্থার নিরসন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। ক্ষোভ বা দু:খ প্রকাশ করে কিছু হবে না। যথোপযুক্ত ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নিতে হবে, মনে রাখতে হবে। স্বাস্থ্যবান জাতির জন্য উন্নত চিকিৎসাসেবার বিকল্প নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চিকিৎসা


আরও
আরও পড়ুন