Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

চিকিৎসকদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

চিকিৎসকদের মূল লক্ষ্য মানবসেবা হলেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখন আত্মসেবার রূপ লাভ করেছে। মানবসেবার পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ চিকিৎসকদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে কীভাবে অধিক অর্থ উপার্জন করা যায়। একটা ব্যবসায়িক মনোভাব তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীদের জিম্মি করে অর্থ উপার্জনের অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। বাণিজ্যিক মনোভাব তো বটেই, ভুল চিকিৎসার ঘটনাও অহরহ ঘটছে। মানুষের পঙ্গু হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে মৃত্যুর মতো ঘটনা অনেকটাই নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে সাধারণ রোগীরা প্রতিবাদ করলেও কোনো কাজ হয় না। বলা যায়, চিকিৎসা ক্ষেত্রে এক ধরনের অরাজকতা জেঁকে বসেছে এবং রোগীরা জিম্মি হয়ে আছে। অধিক অর্থ ছাড়া ভালো চিকিৎসক এবং চিকিৎসা পাওয়া দুষ্কর। এর সবচেয়ে বড় ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, সাধারণ মানুষ। গত বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও কনভেনশন সেন্টার, ডায়াগনস্টিক ও অনকোলজি ভবন এবং ডক্টরস ডরমেটরির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে চিকিৎসকদের এ ধরনের আচরণ নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ করে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে বের হওয়া চিকিৎসকদের ব্যাপারে তিনি বলেছেন, সেগুলোতে পড়াশোনা কেমন হচ্ছে তা আমাদের দেখতে হবে। সেখানে প্রকৃত ডাক্তার গড়ে উঠছে কিনা দেখা দরকার। তিনি বলেন, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে কি পড়াশোনা হচ্ছে, আদৌ সেখানে কোন পড়াশোনা হচ্ছে কিনা, সত্যিকার ডাক্তার তৈরি হচ্ছে নাকি রোগী মারা ডাক্তার হচ্ছে সেটা আমাদের দেখা দরকার। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য যথাযথ এবং অভিনন্দনযোগ্য। তিনি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তব বিষয়টি উপলব্ধি করে কথা বলায় তাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।
দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসকদের অবহেলা, নিজ কর্মস্থলের চেয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বেশি মনোযোগী হওয়া, বাণিজ্যিক মনোবৃত্তি, কখনো কখনো রোগীদের সাথে দুর্ব্যবহারের চিত্রটি নতুন নয়। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। চিকিৎসা একটি মহান পেশা হলেও একশ্রেণীর চিকিৎসক তা বাণিজ্যে রূপান্তরিত করেছেনা। অর্থ রোজগারের হাতিয়ারে পরিণত করেছেন। এই শ্রেণীর চিকিৎসকদের টার্গেট করে রাজধানীসহ দেশের এমন কোনো উপজেলা নেই যেখানে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক, নামমাত্র হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। আবার ডাক্তারি পড়াশোনাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী অসংখ্য প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ গড়ে উঠেছে। এসবের বেশিরভাগেরই মালিক প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তোলা দোষের কিছু নয়। তবে একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে মানসম্পন্ন চিকিৎসক গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় শিক্ষক, ক্যাম্পাস, ল্যাবরেটরিসহ যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন অধিকাংশ বেসরকারি মেডেকেল কলেজে তা নেই। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও তার কোনো প্রতিকার হয়নি। এমনও মেডিক্যাল কলেজও রয়েছে, যেখানে ক্লাসও ঠিক মতো হয় না। খন্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে মাসে এক-দুই দিন ক্লাস নেয়া হয়। প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস হয় না বললেই চলে। অথচ কোর্স শেষে শিক্ষার্থীদের হাতে ঠিকই চিকিৎসকের সনদ তুলে দেয়া হচ্ছে। আবার এমনও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে যেখানে শুধু সনদ বাণিজ্য চলে। অর্থ দিলেই চিকিৎসকের সনদ পাওয়া যায়। এ এক ভয়াবহ চিত্র। এ পরিস্থিতি বছরের পর বছর ধরে চলছে। এতে আর নামমাত্র চিকিৎকের সংখ্যা বাড়ছে বটে তবে এসব চিকিৎসক যখন রোগীর চিকিৎসা করেন, তখন রোগীর রোগ ভালো হওয়া দূরে থাক, রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। যেখানে অনেক সময় প্রকৃত চিকিৎসক কর্তৃকও ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, সেখানে শুধু সার্টিফিকেটধারী চিকিৎসক কর্তৃক রোগীর মৃত্যু হওয়া অবধারিত হয়ে উঠা স্বাভাবিক। দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে অধিকাংশ চিকিৎসককে তাদের চিকিৎসা সেবার মহান দয়িত্ব ভুলে বাণিজ্যিক মনোভাব পোষণ করার বিষয়টি এখন অতি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এতে রোগীরাও চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। সাধারণ রোগীরা এ পরিস্থিতি মেনে নিয়েই চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হচ্ছে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্যে চিকিৎসা নিচ্ছেন কিংবা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক মনোভাবসম্পন্ন চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালের পরিবর্তে তাদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দেন। ফলে বাধ্যহয়ে অনেকে সহায় সম্বল বিক্রি করে হলেও তাদের পরামর্শে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যায়। রোগীর অসহায়ত্বের সুযোগ কাজে লাগিয়ে একশ্রেণীর চিকিৎসক তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এভাবেই অর্থ উপার্জন করে চলেছেন।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসার কারণে কারো মৃত্যু হলে স্বজনরা প্রতিবাদ করলে চিকিৎসকরাও আন্দোলনে নামে। অনেকটা পরিবহন শ্রমিকদের মতো। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে ভুল চিকিৎসায় এক শিশুর মৃত্যু নিয়ে কী তুলকালাম কান্ড ঘটে গেল ভুল চিকিৎসায় শিশুর মৃত্যু হলে স্বজনদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে চিকিৎসকরা ধর্মঘটের মতো কর্মসূচি দিয়ে চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। চিকিৎসকদের এ ধরনের মনোভাব তাদের মহান পেশাকে শুধু কলুষিতই করছেন না, এ পেশার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ মানবসেবা,এটা তার পরিপন্থী। চিকিৎসকদের এ ধরনের অমানবিক আচরণ এবং অবহেলা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। তাদের মনে রাখা দরকার, তারা যে পেশায় যুক্ত হয়েছেন, তার মূল লক্ষ্যই মানুষের সেবা দেয়া। এ লক্ষ্যকে কোনোভাবেই ব্যবসায় পরিণত করা উচিত নয়। আমরা মনে করি, চিকিৎসকদের উচিত রোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে চিকিৎসা দেয়া। রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজেদের উপার্জন বৃদ্ধি করা এবং রোগী ও তার স্বজনদের নিঃস্ব করে দেয়ার মনোবৃত্তি পরিহার করা জরুরি। মানবিক পেশাকে মানবিকভাবেই তাদের দেখতে হবে। রোগীর সেবাই একমাত্র লক্ষ্য-এ মানসিকতা ধারণ করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চিকিৎসক

১৩ আগস্ট, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন