Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভুল চিকিৎসার শেষ কোথায়?

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন | প্রকাশের সময় : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:১৩ এএম

হবিগঞ্জের ফুলতলীর এলাকার রুবেল মিয়া ও শিরিনা আক্তারের ৪০ দিন বয়সী শিশু ইসমত নাহার জিবা ঘন ঘন হেঁচকি দিচ্ছিল। এ কারণে গত ৩১ আগস্ট জিবাকে নিয়ে স্থানীয় আউশকান্দি বাজারের অরবিট হাসপাতালে ডা. খায়রুল বাশারের কাছে যান তার মা। পরদিন শিশুটির কোনও উন্নতি না হলে আবারও কথা বলেন চিকিৎসকের সঙ্গে। শিশুটির মায়ের এই উদ্বিগ্নতাকে ভালো চোখে নেননি ডা. খায়রুল বাশার। উল্টো তিনি শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক উল্লেখ করে দ্রুত মৌলভীবাজারের মামুন হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। সেখানকার ডা. বিশ্বজিৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুঝতে পারেন যে রোগী সুস্থ আছে। সুস্থ শিশুকে অসুস্থ উল্লেখ করে কেন তাদের মামুন হাসপাতালে পাঠানো হলো এটা মোবাইলে ডা. খায়রুল বাশারের কাছে জানতে চাইলেন শিশুটির মা। ডা. খায়রুল বাশার তখন মোবাইলটি ডা. বিশ্বজিতের কাছে দিতে বলেন। এ সময় ডা. খায়রুল বাশার মোবাইলে ডা. বিশ্বজিৎকে বলেন, ‘বাচ্চা সুস্থ আছে বলা যাবে না, চিকিৎসা চালিয়ে যা। বুচ্ছত (বুঝেছিস) বালা (ভালো) জীবনেও কইছ না, আমি তো জানি রোগী বালা (ভালো আছে)। ইনজেকশন- টিনজেকশন মার। বাচ্চার মাকে বল্, ইনজেকশন না মারলে জীবনেও শান্তি হইতো না।’ তাদের কথপোকথনের অডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর চিকিৎসকদের এই প্রতারণা নিয়ে তোলপাড় চলছে।
চিকিৎসা একটি মানবিক পেশা। এই পেশার গুরুত্ব লিখলে যেমন সমাপ্তি টানা যাবে না তেমনি অসংগতির কথা লিখলেও শেষ হবে না। মানুষ বিপদে পড়লে সাধারণত পুলিশ, আইনজীবী এবং ডাক্তারের কাছেই যায়। কিন্তু এই তিনটি পেশা যখন অসাধু ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তখনই সমাজ ও রাষ্ট্রের সন্তানতুল্য নাগরিকদের ভোগান্তী বেড়ে যায়। বাবা-মায়েরা সন্তানকে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্নে যতটা বিভোর থাকেন তার ছিটেফোটাও যদি সত্যিকারের ভালো মানুষ বানানোর জন্য চেষ্টা করতেন তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রে অবিচারের রাজত্ব চলতো না। একজন ডাক্তার সমাজের হাজারো মানুষের অসুখ সরানোর জাদুকর। রোগী আর ডাক্তার যখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় তখন হেরে যায় মানবতা, হেরে যায় জীবনের আলো। কাউকে পরাজিত করা অনেক সহজ কিন্তু জয় করা খুব কঠিন। সেবার ব্রত নিয়ে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা খুবই কঠিন কাজ। এটা সবাই পারে না। দুঃখজন হলেও এটা সত্যি যে, প্রতিনিয়ত মানুষ ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছে। ডাক্তাররা আমাদের মতোই মানুষ। ভুল হবে না এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে একশ্রেণির চিকিৎসকদের মধ্যে সেবার মনোভাব শূন্যের কোঠায়। তারা রোগীর জীবন বাঁচানোর চেয়ে নিজেদের পকেট ভারি করার কাজে সদা ব্যস্ত।
চিকিৎসা একটি স্পর্শকাতর বিষয়, সামান্য অবহেলা কিংবা ভুলের কারণে যে কারো জীবনের আলো নিভে যেতে পারে। চিকিৎসার নামে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারো নেই। অথচ একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি চিকিৎসার নামে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। তবে এ নির্মম ঘটনাগুলো এখন আর কাউকে আলোড়িত করে না। কারণ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে অনেকে তেড়ে আসে। শাসকেরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে যত ফন্দি করে তার ছিটে ফোটাও যদি ভুল চিকিৎসা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতো তাহলে মানুষের জীবন এতটা বিপন্ন হতো না। ভুল চিকিৎসার কারণে হাসপাতালে হামলা করা এবং চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেয়া দুটোই অপরাধ। গত ২৯ জুন চট্টগ্রাম নগরীর মেহেদিবাগের ম্যাক্স হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় শিশু রাইফার জীবন অকালেই ঝরে গেল। ঠান্ডাজনিত সামান্য সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল শিশুটি। কিন্তু ডাক্তার-নার্সের অবহেলায় ফুটফুটে শিশুটির প্রাণ অকালেই ঝরে গেল। রাইফাকে তার পরিবার আর ফিরে পাবে না এটা যেমন সত্য, তেমনি রাইফার স্মৃতিময় জীবনের কথাও স্বজনেরা ভুলতে পারবে না। কারণ শিশুরা ফুলের মতো। তাদের আকুতির সৌন্দর্যের চেয়ে সুন্দর কিছু এই পৃথিবীতে নেই। যে রাইফা প্রজাপতির মতো ঘরে বিচরণ করতো সে রাইফা এখন সাদা কাফনে মোড়ানো লাশ। রাইফার সমান একটি বাচ্চা আমার ঘরেও আছে। রাইফার বাবাকে সান্ত¦না দেয়ার ভাষা আমাদের কারো নেই। কারণ কলিজার টুকরা শিশু সন্তানের লাশ বাবার কাঁধে বহন করা কত যে কষ্টের তা ভুক্তভোগী ব্যতীত অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারে না। শিশু রাইফার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা প্রসঙ্গে হাই কোর্ট বলেছেন, কতিপয় দুর্বৃত্তের কারণে চিকিৎসাসেবার সুনাম নষ্ট হচ্ছে। দেশে স্বনামধন্য অনেক চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু ভালোমানের চিকিৎসাসেবার সুযোগ থাকলেও ভুল চিকিৎসার ভয়ে রোগীরা পাশের দেশে চলে যাচ্ছে। এতে দেশীয় মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। একটি রুলের শুনানিতে হাইকোর্ট এই নির্মোহ সত্য উচ্চারণ করেছেন।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নয়ন হওয়া সত্তে¡ও যখন দেখি ভুল চিকিৎসায় মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে তখন হৃদয়টা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। দেশের প্রতিটি মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। একের পর এক ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হওয়ার ঘটনার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর চিকিৎসা সেবার মান এমনিতেই প্রশ্নবিদ্ধ। অপরদিকে চিকিৎসকদের অনভিজ্ঞতা ও অবহেলা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতার কারণে রোগীদের ক্ষতি ও মৃত্যুর ঘটনা মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তবে চিকিৎসকের অবহেলা কিংবা ভুল চিকিৎসায় রোগীর ক্ষতি বা মৃত্যু হলে দায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে। কিন্তু দুভার্গ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে এ দায় নেয়ার নজির নেই। বরং দায় অস্বীকার করার সংস্কৃতি রয়েছে।
ডাক্তারী এক মহান পেশা ইচ্ছে করলেই সেবার দরজা বন্ধ করে দেয়া যায় নাÑ এটা ডাক্তারদের মনে রাখা প্রয়োজন। প্রতিনিয়ত ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হওয়ার সংবাদ পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হলেও লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। গত ৪ জুলাই বাংলাদেশ প্রতিদিনে মুদ্রিত হয়েছে, দেশজুড়ে ভুয়া ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। গত জুন পর্যন্ত দুই বছরে সারা দেশে ভুল চিকিৎসা ও ভুয়া ডাক্তারের শিকার হয়ে চার শতাধিক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে চিকিৎসকের ভুল ও গাফিলতিতে ৬৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪০০ রোগী মারা গেছে। ২ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক হাসপাতালে চোখের ছানি অপারেশন করতে গিয়ে ২০ জন রোগী চোখ হারানোর ঘটনা ঘটেছে। ৫ জুলাই ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মালীগ্রাম বাজার সংলগ্ন মাহামুদা জেনারেল হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসকের অবহেলায় এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। ৪ জুলাই কুমিল্লার দেবিদ্বারে বাঁশ দিয়ে হাঁড় ভাঙ্গা রোগীর চিকিৎসা করায় পা হারাতে বসেছে সোহাগ নামের এক শিক্ষার্থী। গত ৩০ নভেম্বর ২০১৭ সালে মিরপুর ডেল্টা হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। গত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে মাগুরা শহরের ভায়নার মোড় এলাকায় ভুল চিকিৎসায় এক প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে অস্ত্রোপচারে যমজ সন্তানের একজনকে ভূমিষ্ঠ করিয়ে আরেকজনকে পেটে রেখেই অস্ত্রোপচারের কাজ শেষ করেছিলেন কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার মালিগাঁও সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. হোসনে আরা বেগম। একটি মারাত্মক ভুল চিকিৎসার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৬ নভেম্বর ২০১৭ সালে উচ্চ আদালতের দুজন বিচারপতির সমন্বয়ে বেঞ্চ গঠিত হয়েছিল। তারপরও ভুল চিকিৎসায় দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে না। তবে ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যু হওয়ার ঘটনা প্রতিরোধে সবার আগে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্র যদি সব জায়গাতে জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে তাহলেই কেবল ভুল চিকিৎসা প্রতিরোধ করা সম্ভব। একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে যখন আইনের সুশাসন থাকে না তখনই সেখানে অন্যায় অবিচার উপর্সগ হিসেবে দেখা দেয়। আইনকে যখন ক্ষমতার পেশীশক্তি দিয়ে উল্টোপথে পরিচালিত করা হয় তখনই সমাজ ও রাষ্ট্রের মানবিক মূল্যবোধ অজানা গন্তব্যের দিকে পাড়ি দেয়। নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেমন সরকারের দায়িত্ব, তেমনি চিকিৎসাসেবার নামে বাণিজ্যকীকরণ বন্ধ করাটাও সরকারের দায়িত্ব। সরকারি হাসপাতালে যদি মানসম্মত চিকিৎসা সেবা পাওয়া যেত তাহলে বেসরকারি হাসপাতালের প্রয়োজন হতো না। বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো দেশের নিরীহ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার নামে জিম্মি করে নিজেদের পকেট ভারি করছে। আমরা আশা করব, সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে দেশের ১৭ কোটি মানুষের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভুল চিকিৎসা


আরও
আরও পড়ুন