Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈদুল আজহা এবং মুসলিম বিশ্বের সর্বশেষ পরিস্থিতি

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

ঈদুল আজহার ছুটির পর আবার লিখতে বসেছি। আমাদের দেশের রাজধানী প্রবাসী প্রায় সবাই গ্রামের আপনজনদের সাথে ঈদের আনন্দে শরীক হতে দুই ঈদে গ্রামে ছুটে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গ্রামে যেতে এবং গ্রামে থেকে পুনরায় ঢাকায় ফিরতে তাদের যে ভোগান্তি তা অন্যান্য বারের চাইতে এবার কম হওয়ায় কথা নয়। হয়ওনি। তবুও তারা যে কয়েকদিনের জন্য হলেও গ্রামে ছুটে গেল এবং পুনরায় ফিরে এল এতে সেই পুরানো কথাই প্রমাণিত হয় : প্রকৃত বাংলাদেশ গ্রামে বাস করে।
বছরে আমাদের দু’টি বড় উৎসব : ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এই উপলক্ষে গ্রামের আপনজনদের সাথে মেলামেশা করতে না পারলে আমাদের যেন উৎসবটা পালন করাই হয় না। তবে এটা শুধু বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এর বিস্তৃতি ঘটে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বলতে যে দেশটির সাথে এই সেদিন পর্যন্ত আমরা এক রাষ্ট্র হিসাবে ছিলাম, সেই পাকিস্তানের কথাও এবার বিশেষভাবে মনে পড়ছে। পাকিস্তানে এখন রাষ্ট্র নেতা হয়েছেন এককালের বিশ্ববিখ্যাত খেলোয়াড় ইমরান খান। তিনি শুধু ক্রীড়া জগৎ থেকে রাজনৈতিক জগতে এসে চমক সৃষ্টিই করেননি, নিত্য নতুন এমন সকল সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছেন যাও নতুন চমক সৃষ্টির যোগ্য।
এর মধ্যে তাঁর দু’টি ঘোষণার কথা উল্লেখের লোভ কিছুতেই সামলাতে পারছিনা। এর একটি হচ্ছে দেশের শিক্ষা সিলেবাসে কোরআন শরীফ অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করা। আরেকটি হলো রাষ্ট্রীয় নেতাদের চলাফেরা যথাসাধ্য সাধারণ শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ করা। এসব সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবে কার্যকর করা সম্ভব হয়, তবে তা হবে একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার।
সংবাদপত্রের সচেতন পাঠকমহল জানেন, মুসলিম বিশ্বে সম্প্রতি একটা নতুন ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হতে চলেছে। বিশেষত সৌদী আরবে যে বিভিন্ন যুবরাজদের মধ্যে দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে বাদবিস্বাদ এবং তার পরিনতিতে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে, তা মুসলিম বিশ্বকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে নানা জাতীয় মূল্যবান খনিজ সম্পদ অবিষ্কারের পূর্বে সৌদী আরবের বাসিন্দারা যে অসহনীয় দারিদ্রের মধ্যে বাস করত, মূল্যবান খনিজ সম্পদ আবিষ্কারের পর তারা তা সম্ভবত ভুলেই গেছে। ফলে তাদের বাস্তব জীবন-যাপনে তারা বিলাস ব্যসনে গা এলিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের মত দরিদ্র মুসলিম দেশ থেকে সেসব দেশে যেসব লোক গেছে তাদের মারফৎ যা জানতে পারা যাচ্ছে, তা মোটেই আনন্দনায়ক নয়। এই পরিস্থিতি চলতে থাকবে তাদের অবস্থা পুনরায় খারাপ হতে বাধ্য। কারণ ইসলাম কখনও অপচয়ও বিলাসিতাকে অনুমোদন করে না। কোরআন শরীফে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে : সম্পদ অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। ইসলামের মতে, আসমান ও জমিনের মধ্যে যা কিছু রয়েছে তার একমাত্র মালিকানা আল্লাহতায়ালার, কোনো ব্যক্তি বা মানব-গোষ্ঠীর নয়। এ কথার প্রকৃত তাৎপর্য অবশ্য এই নয় যে, কোন মানুষে কোনো সম্পদ থাকবে না। তা নয়, মানুষের সম্পদ থাকবে, তবে তার উপর কারো চূড়ান্ত মালিকানা থাকবে না। ইংরেজিতে ও’নারশীপ বলে যে শব্দ রয়েছে, তার অর্থ হলো কোন সম্পদ ব্যবহার, অব্যবহার এবং অপব্যবহারের চূড়ান্ত অধিকার-আল্লাহ যা কোন ব্যক্তিকে বা কোন ব্যক্তিগোষ্ঠীকে দেননি। কোন মানুষ তার আয়তাধীন সম্পদ শুধু ততটাই ব্যবহার করতে পারবে, যতটা সাধারণ বিবেচনায় তার প্রয়োজন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ ব্যবহার অপচয় বা অপব্যবহারের সামিল এবং তা ইসলামে নিষিদ্ধ।
অর্থনীতি সম্পর্কিত এই ইসলামী নীতি যদি সমাজে প্রচলিত থাকত তা হলে সমাজের একটি অংশ বিলাস ব্যসনে গা ঢেলে দিতে পারতো না। এবং তার ফলে সমাজের আরেকটি বিশাল অংশ চরম দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হতো না। বর্তমানে পৃথিবীর গুটি কয়েক মানুষ বিলাস ব্যসনে বাস করলেও অধিকাংশ মানুষ যে চরম দারিদ্র্যে মধ্যে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে, তার প্রধান কারণ অর্থনীতি ক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শের অনুপস্থিতি। এর ফলে গোটা মানব সমাজের একটি অংশ বিলাসী জীবন যাপনের সুযোগ পাচ্ছে, অন্যদিকে সমাজের বিপুলসংখ্যক মানুষ সারাদিন পরিশ্রম করেও তাদের প্রয়োজনীয় আহার্য্য সমূহ করতে সক্ষম হচ্ছে না। এই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য আন্তরিক সচেষ্ট হওয়া সমাজের প্রতিটি শুভকামী মানুষের কর্তব্য।
মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা তার জীবনের অন্যান্য দিকের উপর প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের মত দরিদ্র দেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ মধ্যপ্রাচ্য ও তৎসন্নিহিত দেশে যায় শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সংকটের কারণে। তাদের সেসব দেশে নেয়ার ব্যাপারে এক শ্রেণীর দালাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এদেশের দরিদ্র মানুষদের বহু কষ্টে যোগাঢ় করা অর্থের বিনিময়ে এই সব দালাল সব সময় তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে না। অনেক সময়ই তারা আমাদের দেশের দরিদ্র মানুষদের বিদেশে নিয়ে গিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল জায়গায় পৌছেদিয়ে নিজেরা উধাও হয়ে যায়। ফলে বিদেশে বিভূঁয়ে তারা চরম অসহায় অবস্থায় পতিত হয়। বিদেশগামী দরিদ্র ব্যক্তিটি যদি নারী হয়, তবে তাদের অবস্থা হয় আরও শোচনীয়। অনেক ক্ষেত্রে এইসব অসহায় নারীদের গৃহ কর্মের কথা বলে চাকুরি দিয়ে তাদের উপর যৌন নির্যাতন পর্যন্ত চালানো হয়।
সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, বাংলাদেশের এক অসহায় নারীকে এভাবে মধ্যপ্রাচ্য চাকুরী দেয়ার নামে নিয়ে তার উপর শেষ পর্যন্ত যৌন নির্যাতন চালানো হয়। এভাবে যৌন নির্যাতন চালানোর ফলে তা এক পর্যায়ে সে সন্তান-সম্ভবা হয়ে পড়ে। তখন তাকে জোর করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অবাঞ্ছিত সন্তান গর্ভে ধারণ করে সে কীভাবে গ্রামবাসীর কাছে ধিক্কার কুড়াচ্ছে তাও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এই যেখানে আমাদের দেশের এক শ্রেণীর অসহায় নারীর অবস্থা সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে অনেকে নিয়মিত বেশ মোটা অংকের আয় করে চলেছেন।
এতো গেল মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের কথা। এবার একটি মুসলিম দেশ হিসাবে খোদ সৌদী আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের কথা। সৌদী আরবে বিপুল পরিমান তেল সম্পদ আবিষ্কারের পূর্বে বাংলাদেশের মত মুসলিম প্রধান দেশের থেকে হজ উপলক্ষে সৌদী যাওয়া হাজীদের কাছ থেকে পাওয়া টাকার উপর সৌদী আরবকে কীভাবে নির্ভর করতে হতে তা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার বাল্যকালে।
সৌদী আরবে বিপুল পরিমাণ তেল সম্পদ আবিষ্কারের পর বাংলাদেশের মত মুসলিম প্রধান দেশ থেকে যাওয়া হাজীদের কাছ থেকে পাওয়া টাকার উপর সৌদী আরবের নির্ভরশীলতা অনেকটা কমে গেলেও সেখানে পরিবর্তনের কারণে পুনরায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সম্প্রতি সৌদী যুবরাজদের মধ্যে দুর্নীতি ও অন্যান্য প্রশ্নে বিবাদ বিসংবাদ শুরু হওয়ার ফলে সমগ্র সৌদী রাজকীয় ব্যবস্থাই প্রবল হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে মুসলিম বিশ্বের এই মহা গুরুত্বপূর্ণ দেশীটর ভবিষ্যৎ কতটা শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ তা জোর করে বলা কঠিন। বিশেষ করে সৌদী পররাষ্ট্র নীতি ইসরাইলী মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবান্বিত হওয়ায় এ বিষয়ে আমরা বেশী আশাবাদী হওয়ার সুযোগ দেখিনা।
লেখার ইতি টানতে গিয়ে আমাদের যে কথাটি বলতে হচ্ছে, তা হলো, মুসলিম বিশ্বে আজ যে মহা দুর্দিন চলছে, তা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের যে কোন মূল্যে ঘরে-বাইরে ইসলাম নির্দেশিত নীতি মেনে চলতে হবে। পবিত্র কোরআন শরীফে এ সম্পর্কে যেসব দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, আমরা সচেতনভাবে যদি সেসব মেনে চলি, তা হলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য ও রহমত থেকে আমরা বঞ্চিত হবনা বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদ


আরও
আরও পড়ুন