Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও ভুল করেন ভুল রোগ নির্ণয় থেকে সাবধান

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০২ এএম

আজ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য পরিসেবা এবং চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে লিখবো। বাংলাদেশে মানুষের স্বাস্থ্য পরিসেবা পাওয়া যে কত কঠিন সেটি আমি একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করবো। যে বিষয়টি নিয়ে আমি এখন লিখছি সেটির সাথে আমি প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত । যা কিছুই লিখছি সেটি পূর্ণ দায়-দায়িত্ব নিয়েই লিখছি।
গত মাসের শেষ দিকে আমি, আমার ছোট ভাই এবং আমার মেডিকেল চেক আপের জন্য ঢাকার একটি অত্যন্ত নামকরা হাসপাতালে যাই। আমার এবং আমার অর্ধাঙ্গীনির দৃশ্যত কোনো কার্ডিয়াক ডিজিস নাই। তবুও রুটিন ও পিরিয়ডিক চেক আপের জন্য আমরা সেখানে যাই। আমরা কোনো কমপ্লেইন নিয়ে যাইনি। সেখানকার এক নামকরা কার্ডিওলজিস্ট আমার মিসেসকে আর একটি নামকরা হাসপাতালের একজন মহিলা কার্ডিয়াক সার্জনের কাছে রেফার করেন। বিগত ৩১ জুলাই আমরা তার কাছে যাই।
ঐ মহিলা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন যে, আমার স্ত্রীর হার্টের সমস্যা আছে। সেটি সঠিকভাবে জানতে হলে তাকে ইকো/ কালার ডপলার করতে হবে। তদনুযায়ী কালার ডপলার হলো। এটি শেষ হওয়ার পর ঐ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ আমায় ডাকলেন এবং সরাসরি বললেন যে, আপনার মিসেসের হার্টে দুটো ফুটো আছে। অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে সেটার অপারেশন করতে হবে। আমি আপনাদের পরামর্শ দেবো, আপনারা ইন্ডিয়াতে এই অপারেশনটি করুন। আমি জানতে চাইলাম, ইন্ডিয়ার কোথায়? তিনি বললেন, দিল্লিতে। আমি বললাম, কলকাতা কেমন হয়? তার উত্তর, কলকাতায় কার্ডিয়াক অপারেশনের মান নেমে গেছে। আপনি দিল্লিতেই যান। আমি জানতে চাইলাম, অপারেশন ছাড়া কি আর কোনো পথ নাই? সোজা উত্তর দিলেন তিনি, Operation is a must. অবশ্য তিনি এও বললেন যে, আপনারা যদি চান তাহলে ঢাকাতেও এটা করতে পারেন। তবে আমি সাজেস্ট করবো, দিল্লিতেই করুন। জানতে চাইলাম, ঢাকায় করলে কোথায়? তিনি বললেন, হার্ট ফাউন্ডেশনে। কোন ডাক্তার? তিনি হার্ট ফাউন্ডেশনের একজন কার্ডিয়াক সার্জনের নাম প্রেসক্রিপশনের ওপর লিখে দিলেন। আরো বড় বড় অক্ষরে লিখলেন, Surgical Correction. এবং এই অপারেশন মানে ওপেন হার্ট সার্জারি। তার পরেও আমি বললাম যে, তার তো কোনো কমপ্লেইন নাই। তার পরেও কেন হার্ট ওপেন করতে হবে? তিনি আমার প্রশ্নের কোনো গুরুত্ব দিলেন না।
প্রিয় পাঠক, বুঝতেই পারছেন তখন আমাদের মনের অবস্থা কি? আমার স্ত্রীর ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হবে, সেই খবরটি মুহূর্তেই সব আত্মীয়স্বজন জেনে গেলেন। দুই একজন বললেন, চট করে সার্জারিতে যাবেন না। আমরা একটু আসে পাশে দেখি। আমি ঐ মহিলা কার্ডিয়াক সার্জনের পরামর্শ মতো সেই ডাক্তারকে দেখাতে হার্ট ফাউন্ডেশনে যাই। আমাকে বলা হলো যে, হার্ট ফাউন্ডেশনের ঐ বিশেষজ্ঞ কার্ডিওলজিস্টের এ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে গেলে ৭ দিন অপেক্ষা করতে হবে। সুতরাং বাসায় ফিরে এলাম।
বাসায় এসে আমার মিসেসের হার্ট সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজ, অতীত এবং বর্তমানের ইকো/ কালার ডপলার, ইসিজি, এক্সরে, ব্লাড রিপোর্ট সব কিছু স্ক্যান ও প্রিন্ট করি। দেশের বাইরে আমার দু চার জন আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ী আছেন। তাই বিদেশের এক্সপার্ট ওপিনিয়ন নেওয়ার জন্য ঐসব কাগজপত্র আমি ওয়াশিংটন, ক্যানবেরা, সিডনি ও বার্মিংহামে পাঠাই। অন্যদিকে দিল্লিতে পাঠাই মেডান্টা হসপিটালে । অন্যদিকে আমার বিয়াই এসব কাগজপত্র নিয়ে চেন্নাইয়ের এ্যাপোলো হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জনকে দেখান। আমার আর এক বিয়াই ভারতের হায়দারাবাদে বসবাস করেন। তিনি এসব কাগজপত্র হায়দারাবাদের গান্ধী মেমোরিয়াল হাসপাতালের চিফ কার্ডিওলজিস্টকে দেখান। বিদেশের এই সমস্ত হাসপাতাল এবং কার্ডিওলজিস্টরা যে লিখিত মতামত দেন সেগুলি দেখে এবং শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। কোথায় আছি আমরা? শুনলে আপনারাও স্তম্ভিত হবেন। আপনারাও বিলাপ করবেন, কোথায় আছি আমরা? আসুন, ঐসব মতামত আপনাদের সাথে শেয়ার করি।
দুই
আমাদের কাগজপত্র মনযোগ দিয়ে পরীক্ষা করেছে দিল্লির মেডান্টা হসপিটাল। তারা আমাদেরকে লিখিত ভাবে জানিয়েছে যে, রোগীর অর্থাৎ আমার স্ত্রীর কেসটা যদি হয় Asymptomatic তাহলে কোনো সার্জারির প্রয়োজন নাই। অর্থাৎ কোনো অপারেশন করতে হবে না। তাদের ভাষাটা হলো It can be medically managed. . আমরা পাল্টা লিখলাম, Asymptomatic বলতে তারা কি বোঝাচ্ছে? উত্তরে জানানো হলো যে রোগের কতগুলো symptom আছে। যথা, বুকে ব্যাথ্যা, হার্ট এনলার্জড হওয়া, শর্ট ব্রেথ সহ আরো কয়েকটি লক্ষণ বা উপসর্গ। যদি এগুলো থাকে তাহলে রোগীকে দিল্লি আসতে হবে। দিল্লি আসার পর রোগীকে ক্লিনিক্যালি পরীক্ষা করা হবে। তারপর বলা যাবে যে অপারেশন লাগবে কিনা। আর যদি এসব লক্ষণ বা উপসর্গ না থাকে তাহলে দিল্লি আসারও প্রয়োজন নাই এবং অপারেশনেরও কোনো প্রয়োজন নাই। আমরা উত্তরে বললাম, রোগীর এসব কোনো উপসর্গ নাই। তারা বললো, তাহলে দিল্লি আসারও প্রয়োজন নাই। আমাদের উভয়েরই ইন্ডিয়ার ভিসা রয়েছে। এছাড়াও মেডিকেল ভিসার জন্য আমরা এর মধ্যেই এ্যাপ্লাই করে দিয়েছি।
প্রিয় পাঠক, এই যে আমরা দিল্লির হাসপাতালের সাথে যোগযোগ করলাম এর বিনিময়ে কিন্তু তাদেরকে কোনো ফি দিতে হয়নি। শুধু তাই নয়, এই যে তিন দিন ধরে যোগাযোগ হলো, এই তিন দিন ধরেই তারা কিন্তু আমাদের প্রতিটি ইমেইলের জবাব দিয়েছে তাৎক্ষণিক ভাবে। কখনো তারা বিরক্ত বোধ করেননি। এই সার্ভিসটি কি আপনারা বাংলাদেশে পাবেন? এবার আসছি চেন্নাই এ্যাপোলো হাসপাতাল এবং হায়দারাবাদ গান্ধী মেমোরিয়াল হাসপাতালের কথায়। উভয় হাসপাতালেই গিয়েছিলেন আমার দুই বিয়াই। একজন মেয়ের শ্বশুর, আর একজন ছেলের শ্বশুর। চেন্নাইয়ের এ্যাপোলো হাসপাতালে আমাদের কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয় ৪০ মিনিট ধরে। আর হায়দারাবাদে দেড় ঘন্টা ধরে। আমাদের কাগজপত্রের স্ক্যানড কপি গুলো পেন ড্রাইভে ভরা হয়েছিলো। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো এই যে, তারা আমাদের কাগজপত্র পরীক্ষা করতে যে এত সময় দিলেন তার বিনিময়ে তারা আমাদের নিকট থেকে একটি পয়সাও গ্রহণ করেননি। তাদের ওপিনিয়ন একই। অর্থাৎ যেহেতু রোগীর কোনো কমপ্লেইন নাই তাই রোগীর ইন্ডিয়াতে আসারও কোনো প্রয়োজন নাই, আর অপারেশনেরও কোনো প্রয়োজন নাই। ক্যানবেরা, সিডনি, বার্মিংহাম এবং ওয়াশিংটন থেকেও একই ওপিনিয়ন।
এবার আমাদের এই ঘটনার সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং জায়গায় আসছি। আগেই বলেছি যে, হার্ট ফাউন্ডেশনের ঐ ডাক্তার এ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেন ৭ দিন পর, ৮ম দিনে। এর মধ্যে আমরা বিদেশের সব ওপিনিয়ন পেয়ে গেছি। আমরা বিদেশের এসব মতামত সম্বলিত কাগজপত্র হার্ট ফাউন্ডেশনের ডাক্তার সাহেবকে দেখাইনি এবং এসম্পর্কে আমরা কিছু বলিওনি। আমরা যথারীতি হার্ট ফাউন্ডেশনের ডাক্তার সাহেবের কাছে গেলাম। রোগীকে অর্থাৎ আমার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার সাহেব প্রথমে কাগজ পত্র গুলো পরীক্ষা করলেন। তারপর রোগীকে Thoroughly পরীক্ষা করলেন। এভাবে প্রায় ৫০ মিনিট কেটে গেলো। ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে তখন বিরাজ করছে পিন পতন স্তব্ধতা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হলে ডাক্তার সাহেব তার চেয়ারে এসে বসলেন । খুব খোশ মেজাজে আমাদেরকে বললেন, বলুন, কি জানতে চান? আমার উত্তর, ডাক্তার সাহেব, অপারেশনটা কি কোনোভাবেই Avoid করা যায় না? বিশেষ করে এই বয়সে? শুনেছি, স্টেনটিং বা রিং পরানোর মতো হার্টেও বোতাম ইনসার্ট করা যায়। সেজন্য কোনো সার্জারির প্রয়োজন হয় না। আমাদের এই কেসটাতে কি Buttoning করা যায় না? ডাক্তার সাহেব যে উত্তর দিলেন, সেটা শুনে আমরা দুজনই আকাশ থেকে পড়লাম। ডাক্তার সাহবে বললেন, অপারেশন বা বোতাম লাগানোর প্রশ্ন উঠছে কেন? আমরা বললাম, আপনার কাছে যিনি রেফার করেছেন তিনি তো অপারেশনের জন্যেই রেফার করেছেন। এই ডাক্তার বললেন, আপনার স্ত্রীর কোনো অপারেশন লাগবে না। আমি শুধালাম, কেন? উনি বললেন, বিষয়টি Asymptomatic. সুতরাং কোনো কিছুই করা লাগবে না। আমরা তো আনন্দ ও বিস্ময়ে হতভম্ভ। আমাদের এই অবস্থা দেখে উনি প্রশ্ন করলেন, আপনারা কেন এসেছেন? উনার তো কোনো অসুখ নাই। উনার তো কোনো সমস্যা নাই। এই বলে উনি হাত বাড়িয়ে দিলেন, অর্থাৎ আপনারা এখন আসতে পারেন। আমি জানতে চাইলাম, আপনি যে ব্যবস্থা পত্র দিলেন সেখানে তো কোনো ওষুধ লিখে দেননি। উনি বললেন, উনার ওষুধের কোনো প্রয়োজন নাই। শুধু মাত্র উনার দৈনন্দিন জীবনে কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে। অন্য কথায়, উনার Life style-এ কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। আমার সাথে হাত মিলাতে মিলাতে উনি শেষ কথা বললেন, আপনার স্ত্রীর কোনো অসুখ নাই।
তিন
প্রিয় পাঠক, এর পর আমার কি আর কোনো কিছু খুলে বলতে হবে? স্পেশালিস্ট বলে যারা বড়াই করেন, সেই সুবাদে যারা প্রতিদিন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাই করেন, তারা তো আমার স্ত্রীর মতো একজন সুস্থ মানুষের ওপেন হার্ট সার্জারি করতে যাচ্ছিলেন। অথচ, দেশের অন্য ডাক্তার এবং বিদেশের ডাক্তারদের সুচিন্তিত মত হলো, উনার সার্জারি তো দূরের কথা, কোনো মেডিসিনেরও প্রয়োজন নাই। আজ যদি আমার কিছু কিছু যোগাযোগ না থাকতো, যদি দেশে বিদেশ থেকে ওপিনিয়ন না আনতে পারতাম তাহলে এতদিনে আমার স্ত্রীর অর্থাৎ একটি জল জ্যান্ত সুস্থ মানুষের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়ে যেত। চিন্তা করতে পারেন, কি ভয়াবহ ব্যাপার? এভাবেই বাংলাদেশে শুধু মাত্র সাধারণ ডাক্তাররাই নন, অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও ভুল রোগ নির্ণয় করছেন। Wrong diagnosis করছেন। আর সেই করে কত মানুষের সর্বনাশ করছেন। একদিকে তারা লক্ষ লক্ষ টাকাও কামাই করছেন , অন্যদিকে তারা মানুষের চূড়ান্ত সর্বনাশও করছেন। আমার আজকের এই লেখা পড়ে কেউ যদি চিকিৎসা সেবা গ্রহণের বেলায় ডাক্তারদের মতামতের ক্রস চেক করেন তাহলে অনেকে এই ধরণের সর্বনাশ থেকে পরিত্রাণ পাবেন।
বাংলাদেশে এই ধরণের অশুদ্ধ মানুষের ভীড়ে, অশুদ্ধ চিকিৎসকদের ভীড়েও আজও দু চারজন শুদ্ধ মানুষ এবং শুদ্ধ চিকিৎসক রয়েছেন। এদের কনসালটেশন ফি মাত্র ৬০০টাকা। অশুদ্ধ ডাক্তারদের মতো ১২০০ বা ১৫০০ টাকা নয়। এরা ফেরেস্তাতুল্য। হিন্দুদের ভাষায় দেবতাতুল্য। এই ধরণের দু চার চিকিৎসক আজও আছেন বলেই আমরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখনও কিছু ভাল চিকিৎসা সেবা পাচ্ছি।



 

Show all comments
  • N Hoque Shobuz ২৮ আগস্ট, ২০১৮, ১১:০১ এএম says : 0
    ভালো পরামর্শ দেওয়ার জন্য লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • Sharowar Hossen ২৮ আগস্ট, ২০১৮, ১১:০১ এএম says : 0
    i agree
    Total Reply(0) Reply
  • sotan das ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১১:৪৪ এএম says : 0
    আমার বাড়ি চট্টগ্রাম অধ্যাপক নাজির আহাম্মেদ দেখাতে হবে
    Total Reply(0) Reply
  • আশেকেএলাহী ৭ মার্চ, ২০২২, ৭:২০ এএম says : 0
    এখানে কি ডা প্রশান্ত পাল বসেন???
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চিকিৎসক

১৩ আগস্ট, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন