Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কুমিল্লায় অবাধে মা-মাছ নিধন হুমকির মুখে দেশীয় মাছ

মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল চান্দিনা (কুমিল্লা) থেকে : | প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০২ এএম

কুমিল্লায় সচেতনতার অভাবে অবাধে মশারি জাতীয় নেট ব্যবহার করে মাছ ধরা হচ্ছে। এর ফলে সমস্ত ডিম নষ্ট হয়ে যায়। এইসকল সচেতনতার অভাবেই হারিয়ে যেতে বসেছে দেশি কই, শিং-মাগুর, ট্যাংরা, বাটা মাছ। এখন খাল-বিল ও নদীতে পানি থৈ থৈ করছে। শুরু হয়েছে মাছ ধরা। তাই বেড়েছে মাছ ধরার সরঞ্জামের চাহিদাও। কুমিল্লায় বর্ষায় পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাল নদী ও বিলগুলোতে অবাধে ডিমওয়ালা মা-মাছ ও পোনা নিধন করা হচ্ছে। প্রজনন মৌসুমে এ ধরনের মাছ নিধন ও বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো নজর দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে দেশি অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বর্ষা মৌসুম মাছের প্রজনন সময়। নতুন পানি আসতে শুরু করলে নদী, খাল ও বিলে মা-মাছ ডিম ছাড়ে। এতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনায় ভরে ওঠে খাল-বিল ও নদী। কিন্তু এই সময়ই মাছ ধরার ধুম পড়ে। এতে মিঠা পানির বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ এখন বিলীন হওয়ার পথে। মাত্র ৯০ থেকে ১০০ দিন ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ ধরা বন্ধ রাখলে দেশি মাছের ঘাটতি অনেকটা পূরণ হতে পারে।
কুমিল্লার জেলার বেশ কয়েকটি নদী ও ঘুঘরার বিলপাড়ের বাসিন্দারা জানান, প্রধানত নদী থেকে খাল ও বিলে পানি ঢোকার পথগুলোতে অবাধে মাছ শিকার করা হচ্ছে। চান্দিনা উপজেলার বড়ইকৃষ্ণ গ্রামের জামাল হোসেন জানান, শুধু বোয়াল নয়, ডিমওয়ালা মাগুর, শিং, পাবদা, টেংরা ও পুঁটি মাছও ধরা হচ্ছে। নতুন পানি আসায় মা-মাছ ডিম পাড়ার জন্য বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়ায় মাছ শিকারিদের হাতে ধরা পড়ছে। এসব মাছ প্রতিদিন সকালে মাছের আড়তগুলোতে বিক্রির জন্য আনা হচ্ছে। বিশেষ করে ডিমভর্তি টেংরা, পুঁটি, মলা, বোয়াল, শোল, শিং, মাগুরসহ দেশীয় প্রজাতির ১৫ থেকে ২০ প্রজাতির মাছ এসব আড়তে বিক্রি করা হচ্ছে। গতকাল বৃহ¯প্রতিবার শহরের বাদশা মিয়ার মৎস্য আড়তে প্রতি কেজি টেংরা ৭০০, মলা ৫০০, বোয়াল ১০০০ ও শিং মাছ ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। এসব মাছের দামও বাজারে চড়া। ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ ধরা অন্যায় জেনেও সবাই এ কাজটি করছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চার মাস মাছের প্রজনন সময়। এই সময় ডিমওয়ালা মা-মাছ ও নয় ইঞ্চির নিচে পোনা ধরা নিষিদ্ধ। মাছ শিকারিদের সচেতনতা বাড়াতে প্রণোদনামূলক কর্মসূচি, আলোচনাসভাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে। নদী ও খাল-বিলগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে বলেও আশ^াস দেন মৎস্য কর্মকর্তা।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নজরুল ইসলামের মতে কয়েক দশক পূর্বেও এই দেশীয় প্রাকৃতিক মাছের কদর ছিল না, ফলে দামও কম ছিল। কিন্তু, এখন উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় চাহিদা ও দাম দুই বেড়েছে। কুমিল্লার ঘুঘরার বিলে আড়াইশত প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ছিল। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব মাছের অনেক প্রজাতি এখন চোখে পড়ে না। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমের সময় নদী-খাল-বিল থেকে কারেন্ট জালের মাধ্যমে ব্যাপকহারে ডিমওয়ালা মাছ ধরার কারণে দেশীয় মিঠা পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে সব অব্যবস্থাপনাকে মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই মিঠা পানির মাছগুলো এখন ধীরে ধীরে ধীরে অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ছে।
বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লার চান্দিনায় বৃহত্তম ঘুঘরার বিলটি দৈর্ঘ্যে ১৫ এবং প্রস্থে ৮ মাইল। এই বিলসহ ছোট বড় দেড়শ’ নদী ও পুকুরে টিকে আছে মিঠা পানির দেশীয় প্রজাতির সামান্য মাছ। অথচ এসব মাছের উৎসস্থল থেকে অতীতে বিপুল পরিমাণ মাছ আহরণ করা সম্ভব হলেও বর্তমানে নানা কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হতে চলেছে।
ঘুঘরার বিল এক সময়ের দেশীয় মৎস্য ভাÐারখ্যাত হিসেবে পরিচিত থাকলেও বর্তমানে এই বিল থেকে ক্রমশই বিলীন হয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। দু’দশক পূর্বে এখানে ২৬৬ প্রজাতির মাছের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন মৎস্য অধিদপ্তর। এই ২৬৬ প্রজাতির দেশীয় পানির মাছের মধ্যে এখন কোন মতে টিকে আছে মাত্র ৫০ প্রজাতির মাছ।
তবে ৫০ প্রজাতির মাছ সচরাচর দেখা গেলেও দেশীয় মাছের অস্তিত্ব আজ পুরোপুরিই হুমকির মুখে। দেশীয় মাছের মধ্যে শোল, টাকি, কৈ, গজাল, টেংরা, চিতল, শিং, খয়রা, বাটা, পাইশ্যা, কালিবাউশ, বাইল্যা, কাজলি, সরপুটি, পাবদা, খৈলশা, ডগরি, জাবা, ভোলা, বাগাড়, বাশপাতা, ভাঙ্গান, কাইন, খলা, দেশী পুটি, গোদা চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মিঠাপানির মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। এ সকল মাছ স্বাদে ও পুষ্টি গুণে ছিল ভরপুর। সারা বছর জেলেরা মৎস শিকার করে নিজ পরিবারের চাহিদাপূরণসহ জীবিকা নির্বাহ করত।
শুষ্ক মৌসুমে খাল বিলের পানি কমে গেলে চলত মাছ ধরার উৎসব। প্রতি বছর বর্ষাকালের আগে বৈশাখ জৈষ্ঠ থেকে খালে বিল নদীতে মাছ ডিম্ব নিঃস্বরণ শুরু করে। কারেন্ট জালের ব্যাপকতায় খাল, বিল নদীতে এ মাছের রেনু ধরা পড়ে মাছের প্রজনন প্রচÐভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জালে ধরা পড়ে নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার রেনু মাছ। পরিবেশ ও মৎস বিজ্ঞানীদের মতে ঘুঘরার বিল থেকে মৎস প্রজাতি বিলুপ্তির কারণ হচ্ছে, অপরিকল্পিততভাবে বাধ দেয়ায় ভরা বর্ষা মৌসুমে ডিম ছাড়ার মা মাছ আসতে বাধা পায়। মাছের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা তদুপরি খাল, বিলগুলো ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে আসার কারণে মাছের বংশবৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসচেতনতা, ফসলের ক্ষেতে ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের যথেচ্ছা ব্যবহার এবং মিঠাপানির অভাবে মৎস্যখনি খ্যাত কুমিল্লায় বিভিন্ন প্রজাতির মিঠাপানির দেশীয় মাছের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে। সুস্বাদু দেশীয় মাছ এখন আর তেমন মিলছে না। বাজারে যদি বিদেশী ক্রস ও কার্প জাতীয় মাছ না থাকতো তাহলে আমিষের চাহিদা মিটানো সম্ভবপর ছিলনা। শহর-বন্দর গ্রামে গঞ্জে সর্বত্রই দেশীয় মাছের চরম সঙ্কট। যা পাওয়া যায় তাও তার অগ্নিমূল্য। বাজার দখল করে আছে চাষের পাঙ্গাস, কৈ, তেলাপিয়া আর সামুদ্রিক মাছ।
মৎস্য অধিদপ্তরের তালিকানুযায়ী সারা দেশে ছোট মাছের মোট ৫৬ টি অভয়াশ্রম রয়েছে। চান্দিনা উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, মাছের জন্মস্থানগুলোতে অভয়াশ্রম থাকা দরকার । তা না হলে দেশী মাছ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এ জন্য গণসচেতনতা প্রয়োজন।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কুমিল্লা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ