সাতশ’র বেশি রুশ নাগরিক ও তাদের কোম্পানিগুলো বর্তমানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মূলত রাশিয়াকে পশ্চিমের প্রতি দুরাচারী আচরণের কারণে শাস্তি দিচ্ছে। মস্কো ক্রমাগত নিষেধাজ্ঞার ঢেউয়ের নিচে পড়ছে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ এবং আর্থিক ও বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ। এসব নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিকে দংশন করতে শুরু করেছে এবং আরও সাজা দেশটির মুদ্রা রুবলের মূল্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যার ফলে রাশিয়া অর্থনৈতিক মন্দার দিকে আরেকটু অগ্রসর হবে। রাশিয়ার অর্থনীতি ভেঙে দেয়ার এ চেষ্টার উদ্দেশ্য রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের আচরণে পরিবর্তন আনা।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ নতুন কিছু নয়- এটি হচ্ছে মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়মিত বৈশিষ্ট্য। ইউক্রেন ভেঙে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ করে নেয়া এবং ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগে ওবামা প্রশাসন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। চলতি বছরের এপ্রিলে ট্রাম্প প্রশাসনও নির্বাচনী প্রচারণায় হস্তক্ষেপ এবং অন্যান্য শত্রুতামূলক কাজের জন্য রাশিয়ার ক্ষমতাশীল ব্যক্তি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আর এখন আগস্টের শেষের দিকে ব্রিটেনে নার্ভ গ্যাস হামলার কারণে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতা থেকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার লোক- কেউই বাদ যাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কুঠার থেকে। সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞায় সম্ভাব্য জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন সামগ্রী যেমন- গ্যাস টারবাইন ইঞ্জিন, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, পরীক্ষা ও ক্রমাঙ্কন যন্ত্রপাতি রাশিয়ায় রফতানির বিষয়টিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর জবাবে প্রতিশোধ হিসেবে নাসার কাছে রাশিয়ার তৈরি বিভিন্ন ইঞ্জিন বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে মস্কো। তবে রসকসমসের (রুশ মহাকাশ সংক্রান্ত সংস্থা) প্রধান চলতি গ্রীষ্মে তার মার্কিন প্রতিপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাতের পরিকল্পনা করছেন। দীর্ঘস্থায়ী ও গভীর তিক্ততা সত্তে¡ও মহাকাশসংক্রান্ত পারস্পরিক সহযোগিতা চলমান থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন হবে বিমান চুক্তি স্থগিত এবং রাশিয়াকে নতুন সার্বভৌম (সভরেন) ঋণ দেয়া বন্ধ করা, যা হতে পারে রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য খুবই যন্ত্রণাদায়ক। নতুন নিষেধাজ্ঞায় যা ঘটতে যাচ্ছে- এর মাধ্যমে রাশিয়াকে দৃঢ়ভাবে চেপে ধরা হচ্ছে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে। রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হতে চাওয়া প্রেসিডেন্ট
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার সমর্থক গোষ্ঠী এবং ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় হস্তক্ষেপের কারণে প্রতিশোধ নিতে চাওয়া জাতীয় নিরাপত্তা আমলাদের কথিত ‘ডিপ স্টেটে’র মাঝে সংগ্রাম চলছে দেশটিতে। নির্বাচনের পর থেকে যত সময় গড়িয়েছে, পুতিনের প্রতি ট্রাম্পের আচরণে, বিশেষত হেলসিঙ্কিতে, মনে হয়েছে প্রেসিডেন্ট এখন স্থায়ীভাবেই রাশিয়ার ‘প্রভাবাধীন’। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হন বা না হন, এ মনোভাব আমেরিকার রাজনীতি কাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। সামনের কিছু সময় ক্ষুব্ধ আমেরিকার জ্বালা বহন করবে রাশিয়া। যে কেউ এ ধরনের মনোভাব সম্পর্কে অবগত, যা কিনা ওয়াশিংটনে বিরাজ করছে চার দশক পর ইরানে এক মার্কিন নাগরিকের ৪৪৪ দিনের জিম্মি সংক্রান্ত সংকট নিয়ে। বোধগম্য এ ক্রোধ কত দীর্ঘ সময় থাকতে পারে, তা বিবেচনার জন্য বর্তমান পরিস্থিতি হতে পারে একটি প্রয়োজনীয় নির্দেশক।
সিরিয়া হচ্ছে মূল বিষয়; কিন্তু আরও গরম ইস্যুও আছে, বিশেষত তুরস্কের ভবিষ্যৎ এবং ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারণা। কৌশলগত অস্ত্র হ্রাস চুক্তি বৃদ্ধিসহ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণও সামনেই রয়েছে। এসব আলোচনাই একসঙ্গে পাকিয়ে গেছে এবং তুরস্কের বিরুদ্ধে হোয়াইট হাউসের পদক্ষেপের কারণে টানটান অবস্থায় আছে। এর ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, যা রাশিয়াসহ সবখানে বাজারজুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আমেরিকার এ পদক্ষেপকে রুবলের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছে মস্কো, ২০১৬ সাল থেকেই যার দর পড়তির দিকে। এটি মনে রাখা দরকার যে, রাশিয়ার হাতে সবচেয়ে বেশি সোনার মজুদ রয়েছে, যা দেশটিকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, এমনকি ল্যাটিন আমেরিকার নতুন ভূরাজনৈতিক বিষয়ে মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজের মাধ্যমে চীনও যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে একটি ভূমিকা রাখছে। ঋণ ও অধিগ্রহণ পূর্বমুখী বাণিজ্যের নতুন অস্ত্র এবং এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাজ করে।
এখন নতুন বিশ্বব্যবস্থার উত্থান দেখছেন পুতিন, যেখানে পশ্চিম দোদুল্যমান এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ট্রাম্প-পরবর্তী ও পুতিন-পরবর্তী ভবিষ্যৎও মুখোমুখি হবে আজকের ও আগামীর ইস্যুগুলোতে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, পুতিন কেবল নিজেকে উদীয়মান বিশ্ব অর্থনীতির পরিবর্তনের নকশাকারই মনে করেন না, একই সঙ্গে তিনি নিজেকে এর প্রভাবকও ভাবেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যত বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে, এর ফল হিসেবে ইরান ও অন্য দেশগুলো তত বেশি ঐক্যবদ্ধ হবে। অন্যদিকে নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের গুরুত্ব এবং মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতর হওয়ার জন্য ট্রাম্প যে চাপের মুখে পড়বেন, তাতে বাগাড়ম্বর, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কিছুটা মজাদার হয়ে উঠতে পারে। - আরব নিউজ