চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
এক
প্রত্যেক জীবই মরণশীল। এই কথাটি সকল মানুষের জন্যও প্রযোজ্য। পৃথিবীতে কিছু মানুষ রয়েছেন বা থাকেন যারা কখনও মিথ্যা কথা বলেন না বরং যতটুকু সম্ভব অন্য মানুষের উপকার করেন। উঁনারাই পৃথিবীতে অনেক দেশে বা জায়গায় আউলিয়া বা ওলি বলে পরিচিত হন এবং মৃত্যুর পর উঁনারাই বেহেশতবাসী হন বা হবেন। আমাদের ধারনা যারা পরকালে বেহেশতবাসী হতে চান তাঁরা জীবনে অন্তত: একবার আল্লাহর তৈরী পৃথিবীর প্রথম ঘর কাবা শরীফে যান। সেখানে গিয়ে তারা কাবা ঘর তোয়াফ, হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ, চুমু করে বলেন- ‘‘হে আল্লাহ আপনি একমাত্র ক্ষমাশীল এবং আমার বা আমাদের সকল প্রকার দোষত্রুটি ক্ষমা করুন এবং আমার বা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত জীবন অত্যন্ত কার্যকর ও ফলপ্রসু করে নিন। সমস্ত প্রসংশা শুধু আপনারই জন্য। আমার বা আমাদের কোন দোষত্রুটি থাকলে তা আপনি নিজ গুণে ক্ষমা করুন। আমরা সবাই আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থী ও আত্মসমর্পিত। হজ্বব্রত পালনকারী সবাই মদিনাতেও যান এবং হযরত মুহাম্মদ (স.) এর রওযা মোবারক জিয়ারত করেন। সেখানে কয়েক দিন থেকে রসূল (স.) এর সাফায়ত ও মহান আল্লাহর করুনা প্রাপ্তির জন্য প্রাণঢালা প্রার্থনা ও মোনাজাত করেন। আমাদের জীবন সম্বন্ধে আমরা তেমন কিছুই জানিনা, শুধু আল্লাহর কুরআন এবং রসূল (স.) হাদিসের মাধ্যমে কিছু জ্ঞান প্রাপ্ত হই। মহান হজ্ব ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদত। কেউ যদি হজ্ব ফরয হওয়ার বিষয় মানতে অস্বীকার করে সে কাফের হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, ‘‘সামর্থবান লোকদের প্রতি আল্লাহ উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর হজ্ব আদায় করা ফরয। আর কেউ যদি তা মানতে অস্বীকার করে তাহলে (জেনে নিক) আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি মুখাপেক্ষী নন’’। (আল ইমরান: ৯৭)। হজ্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, একবার নবী করীম (সা:) জিজ্ঞাসিত হলেন, সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান’’। তারপর প্রশ্ন করা হলো, এরপর কোন আমলটি? তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’’। তারপর প্রশ্ন করা হলো, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘‘মাবরুর হজ্ব’’-(বুখারী ও মুসলিম)। আর মাবরুর হজ্ব হচ্ছে ঐ হজ্ব, যা আদায় করার সময় হাজী সকল প্রকার গুনাহ বা নিলর্জ্জতার কাজ থেকে বিরত থাকে। এ ধরনের মাবরুর হজ্ব আদায় করতে পারলে আল্লাহ তা’আলা জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দেন। নবী করীম (সা:) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হজ্ব আদায় করলো এমন অবস্থায় যে, কোন প্রকার কাম, প্রবৃত্তি চর্চা বা গুনাহর কাজে লিপ্ত থাকেনি, সে এমনভাবে হজ্ব শেষে ফেরত আসবে যেমন নবজাতক শিশু মায়ের পেট থেকে (গুনাহমুক্ত অবস্থায়) ভূমিষ্ঠ হয়। -(বুখারী ও মুসলিম)আরেকটি হাদীসে তিনি এরশাদ করেছেন...মাবরুর হজ্বের প্রতিদান হচ্ছে একমাত্র জান্নাত। (বুখারী ও মুসলিম) এত বড় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি আল্লাহ তা’আলা জীবনে মাত্র একবার ফরয করেছেন। এরপর পুনরায় করলে তা নফল হবে। যদি আল্লাহ প্রতি বৎসরই ফরয করতেন, তাহলে সেটা আদায় করা নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন হয়ে যেতো। হিজরী ৬ষ্ঠ সনে মতান্তরে নবম অথবা দশম সনে হজ্ব ফরয হওয়ার আয়াত নাযিল হলে নবী করীম (সা:) এক খুৎবায় তার ঘোষণা দিতে গিয়ে বললেন, ‘‘হে জনতা, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি হজ্ব ফরয করে দিয়েছেন, তাই হজ্ব আদায় করে নাও। একজন বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল, তা-কি প্রতি বৎসরই? তিনি উত্তর দিলেন না। লোকটি তিন তিন বার প্রশ্নটি করতে থাকলো। শেষে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, আমি যদি বলতাম হ্যাঁ, তাহলে প্রতি বৎসরই ফরয হয়ে যেতো। আর তোমরা তা পালন করতে পারতে না। অত:পর তিনি বললেন, যেটা আমি বলি না, সেটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করো না। তোমাদের পূর্বের জাতিগুলো ধ্বংস হয়েছে বেশি বেশি প্রশ্ন করা, আর নবীদের সাথে মতবিরোধের কারণে। আমি তোমাদের যা করার নির্দেশ দেই, সাধ্যমত তা করার চেষ্টা করো, আর যে বিষয় থেকে নিষেধ করি তা বর্জন করো।’’-(বুখারী ও মুসলিম)।হজ্ব ফরয হয়ে গেলে বিলম্ব না করে সাথে সাথেই আদায় করা উচিৎ। বিলম্ব করে কয়েক বৎসর পরে আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু বিলম্ব করার কারণে গুনাহগার হতে হবে। আর যদি বিলম্ব করার কারণে শেষ পর্যন্ত হজ্ব আদায় পূর্বেই মৃত্যুবরণ করতে হয়, তার পরিণতি হবে অত্যন্ত করুণ। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “যে ব্যক্তির মক্কা শরীফ যাতায়াতের মত সম্বল রয়েছে (অর্থাৎ হজ্ব ফরয হয়ে গেছে) কিন্তু গড়িমসি করে আদায় করেনি, সে যেন ইহুদী বা খৃষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করে- (তিরমিযী)। অর্থাৎ সে যেন মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করার আশা না করে। ওমর (রা:) বলতেন, যাদের উপর হজ্ব ফরয হওয়া সত্বেও হজ্ব আদায় করছে না, আমার মনে চায়, তাদের উপর (অমুসলিমদের ন্যায়) জিযিরা কর আরোপ করতে। কারণ এরা মুসলিম হতে পারে না, এরা মুসলিম হতে পারে না (বাক্যটির দুইবার উচ্চারিত হয়েছে)।আল্লাহ তা’আলা সবার উপর হজ্ব ফরয করেননি। যাদের সামর্থ রয়েছে, শুধু তাদের উপরই ফরয করেছেন। সামর্থ দু’ধরনের, শারীরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে। হজ্বের আহকামগুলো আদায় করার মত শারীরিক ক্ষমতা থাকতে হবে। আর অর্থনৈতিকভাবে নিজের হজ্বের সফর ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় খরচপত্র বহন এবং হজ্ব শেষে ফিরে আসা পর্যন্ত তার উপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যদের যাবতীয় মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার মত অর্থনৈতিক সঙ্গতি থাকলেই হজ্ব করা ফরয হবে। মহিলাদের ক্ষেত্রে হজ্বের সফরে স্বামী অথবা মাহরাম সঙ্গী থাকা জরুরী। বিনা মাহরামে মহিলাদের হজ্বের সফরে বের হওয়া ঠিক নয়। ইবনে আব্বাছ (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, ‘মাহরামের অনুপস্থিতিতে বেগানা নারী-পুরুষ যেন একান্তভাবে একত্রিত না হয়। কোন মহিলা যেন বিনা মাহরামে সফর না করে। তা শুনে একজন বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমার স্ত্রী হজ্বের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে, আর আমি অমুক যুদ্ধে যাওয়ার জন্য নাম লিখিয়ে রেখেছি। তিনি বললেন, ‘‘তুমি গিয়ে তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্ব আদায় করো।’’ (বুখারী ও মুসলিম)।হজ্বের সফরের প্রয়োজনীয় সম্বল যোগাড় করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেছেন, ‘‘তোমরা হজ্বের সম্বল যোগাড় করো। আর সর্বোত্তম সম্বল হচ্ছে তাকওয়া’’-(বাকারা : ১৯৭)। তাই হজ্ব করতে ইচ্ছুক সবাইকে প্রয়োজনীয় বস্তুগত প্রস্তুতির সাথে সাথে রূহানী প্রস্তুতিও গ্রহণ করা উচিত। আর রূহানী প্রস্তুতি শুরু হয় হজ্ব সংক্রান্ত ইলম হাসিল করার মাধ্যমে। হজ্ব একটি বিরাট ইবাদত। যাতে রয়েছে বহুবিধ মাসায়েল ও আহকাম। হজ্বে রওয়ানা হওয়ার অনেক আগ থেকেই সেসব জানা ও বুঝা এবং বার বার পড়া উচিত। অভিজ্ঞ আলেম থেকে এলম হাসিল করা উচিত। শুধু বই কিতাব পড়াই যথেষ্ট হবে না। ব্যবহারিক তালিমেরও প্রয়োজন আছে। বিভিন্ন মসজিদে অনুষ্ঠিত এসব তা’লীমে যোগদান করা উচিত। এখন থেকেই গুনাহ থেকে তাওবা করে হজ্বের জন্য প্রস্তুতি নেয়া উচিত।পবিত্র ভূমি মক্কা ও বাইতুল্লাহর ইতিহাস হজ্ব যাত্রীদের মনে আবেগ ও অনুভূতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যে আলোচনা করতে চাই তা হচ্ছে হজ্বের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। হজ্ব আদায়কালীন সময়ে পবিত্র ভূমিতে লুকিয়ে থাকা সেসব ঐতিহাসিক স্মৃতি ও তার সাথে জড়িত পূণ্য ব্যক্তিদের অবদানের কথা হৃদয়ে জাগরুক থাকলে হাজীর মনে সৃষ্টি হবে আল্লাহ প্রেমের অনুপম আবেগ। উজ্জীবিত হয়ে উঠবে ঈমানের স্ফুলিঙ্গ। পবিত্র ভূমিতে পা রাখার সাথে সাথেই আবেগভরে খেয়াল করা উচিত, এ কোন ভূমিতে এসেছি আমি! আমি কি সে পবিত্র ঘরকে স্বচক্ষেই দর্শন করছি, যার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে প্রতিটি দিন কমপক্ষে পাঁচ বার নামায আদায় করেছি। স্মরণ করতে হবে সে ঘরের ইতিহাস। ধু-ধু বালির এ মরুভূমিতে বাড়ি-ঘর তো দূরের কথা, ছিল না কোন জন মানুষের চিহ্ন। নবী ইবরাহীম (আ:) প্রিয় সহধর্মিণী পুণ্যময়ী নারী হাযেরাকে নিয়ে এলেন মক্কার এ জনমানবহীন ভূমিতে। সাথে রয়েছে দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈল। তাদেরকে রেখে বিদায় হতে চললেন। হাযেরা বললেন, এ কি! আমাদেরকে এভাবে রেখে যাচ্ছেন। এটা কি আল্লাহরই নির্দেশে? তিনি বললেন, ‘অবশ্যই’। হাযেরা বললেন, ‘তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আমাদেরকে বিপদের মধ্যে ফেলে দেবেন না’-(আল বেদায়া, ওয়ান্নেহায়া, ইব্ন কাছীর)। যেতে যেতে ইবরাহীম (আ:) প্রভূর দরবারে ফরিয়াদ করছেন, হে প্রভূ! আমি আমার পরিবার পরিজনকে এমন একটি প্রান্তরে রেখে এলাম, যেথায় নেই কোন ফসলাদির চিহ্ন, আপনার পবিত্র ঘরের কাছে, এজন্য যে, তারা যেন তথায় সালাত কায়েম করে। হে প্রভূ! লোকদের অন্তরে তাদের কাছে আসার জন্য প্রবল আবেগ ঢেলে দিন। আর তাদেরকে ফল-ফসলাদির রিযক প্রদান করুন, যাতে করে তারা আপনার শোকরগুজার হতে পারে।-(ইবরাহীম ঃ ৩৭) স্মরণ করুন, মা হাযেরার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।