ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
বাবার সাথে বাড়ি ফিরছিল বরিশালের স্কুলছাত্রী মেনহাজ হাসান মিলি। কিন্তু তার শেষ রক্ষা হলো না। কাজ ফেলে যে বাবা শুধুমাত্র বখাটেদের ভয়ে, নিরাপত্তার অভাবে সন্তানকে পাহারা দিয়ে নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছিলেন, সেই বাবাই তার মেয়েকে শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। চোখের সামনেই ঘটল অবাক করার মতো ঘটনা। দশ-বারোজন কিশোর বাইক নিয়ে বাবা ও মেয়ের পথ আগলে ধরল। অতঃপর মেয়েটির ওড়না ধরে টান দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিল। তারপর বাইক চালিয়ে চলে গেল মিলির শরীরের উপর দিয়ে। রক্তাক্ত মিলি তিন দিন হাসপাতালের বেডে ছটফট করার পর মারা গেল।
ঠিক এ রকমই মর্মান্তিক ঘটনা একের পর এক ঘটতে দেখা যাচ্ছে। কিশোরদের এ ধরনের বাইক সন্ত্রাসের কবলে পড়ে শুধু স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীরাই প্রাণ হারাচ্ছেন তা কিন্তু নয়; প্রাণ হারাচ্ছে পথচারী, নব বিবাহিত নারী ও তাদের সমবয়সী কিশোররা। ঝগড়া কিংবা কথা কাটাকাটির রেষ ধরে বাইক চাপা দিয়ে হত্যা করছে তাদেরই সহপাঠীদের। নতুন এই সন্ত্রাসের উৎপাত থামাতে কী করা যায়, সেটাই এখন ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজকাল শহরের অলিগলিতে কিশোররা বাইক নিয়ে দলবেঁধে ঘুরে বেঁড়ায়। তারা বাইক নিয়ে পাড়া-মহল্লায় টহল দেয়, স্ট্যান্টবাজী করে। কখন কোন মেয়ে কোন রাস্তা দিয়ে ফিরছে তা দেখে এগিয়ে যায়। প্রেমের প্রস্তাব দেয়। প্রত্যাখান করলে পরের যাত্রা পথে বাইক চাপায় লাশ হয়ে ফিরতে হয়। এই বখাটে তরুণদের রুখবে কে? তারা পাড়া-মহল্লা ঘিরে কায়েম করছে ত্রাসের রাজত্ব। চায়ের দোকানে, রাস্তার মোড়ে মোটর সাইকেল নিয়ে নিয়মিত আড্ডা দিয়ে ভীতির রাজ্যে পরিণত করে তুলেছে পাড়া-মহল্লাকে। বিকাল হলেই ওরা জনে জনে বাইক চালিয়ে ছুটে আসে প্রতিদিনের নির্দিষ্ট স্থানে। সন্ধ্যার পর শুরু করে বখাটেপনার প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার ধরন, রাস্তায় যানবাহনের মধ্যে কে কত দ্রুত চালিয়ে আগে যেতে পারে, কে কোন মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে পারে। আর এমন অসম প্রতিযোগিতা লড়তেই পথচারীরা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আহত হয়, প্রাণ হারায়। আর নিছক সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার কারণে ভুক্তভুগিরা ন্যায্য বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। পার পেয়ে যায় অবিবেচক উগ্র কিশোররা। বার বার এসব কাজ করার প্রবণতাও বেড়ে যায় তাদের।
মনে হয়, বাইকধারী কিশোররা আমাদের সভ্য সমাজের বাইরের। কেননা, তাদের আচরণগত শালীনতা যেমন নাই, তেমনি তাদের বেশভূষা, চালচলনেও সমবয়সী অন্যদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের চুলের কাটিং যেন বন্য শেয়ালের ঝুঁটির মতো! পাড়া-মহল্লায় নিজেদেরকে ত্রাস হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে, গ্রুপিং করতে এই বখাটেদের দলগুলোর আলাদা আলাদা নামও রয়েছে। যেমন- ‘দজাম্বু গ্রুপ’, ‘পট্টি গ্রুপ’, ‘দুল গ্রুপ’ ইত্যাদি। এসব গ্রুপের কাজ সংঘবদ্ধ হয়ে বাইক নিয়ে নিয়মিত মহড়া দেওয়া, নারীদের ওড়না ধরে টান দেওয়া, দুজন পুরুষ ও নারী একত্রে গেলে তাদের ধরে হেনস্তা করা, মোবাইল, ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়াসহ অসামাজিক নানা কুকর্ম করা। মোটের ওপর এসব কিশোর প্রতিদিনই মোটর সাইকেল নিয়ে কিছু না কিছু অঘটন ঘটাচ্ছে।
বড় দুঃখের বিষয়, এসব কিশোর স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রভাবশালী লোকজনের ছেলে হয়ে থাকে। তাই সাধারণ লোকজন যেমন প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না, তেমনি প্রশাসনের কানে দিলে তারা এটাকে ‘নিছক ছেলে মানুষি’ বলে চালিয়ে দিয়ে নিজেদেরকে দায়মুক্ত করে। প্রশ্ন হলো, দেশে যখন এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড মহামারি আকার ধারণ করবে, তখন কি প্রশাসনের টনক নড়বে?
কিশোরদের এমন নৈতিক অবক্ষয় আমাদের সমাজ ও দেশের জন্য চরম লজ্জাকর। যে বয়সে কিশোরেরা পাঠে মনোযোগ দেবে সে বয়সে সন্ত্রাসী করে বাড়ি ফিরছে। তাহলে কি আমাদের স্কুল-কলেজ তাদেরকে নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে পারছে না? না কি পিতা-মাতা তাদের সন্তানদেরকে সুপথে আনতে পারছে না? নাকি তাদেরকে সময় দিতে পারছে না?
আজকাল অনেক পরিবারের বাবা-মায়ের ভাবনা, তাদের সন্তান সাহসী ও সংগ্রামী হোক। এই সাহসী ও সংগ্রামী হতে গিয়ে সন্ত্রানেরা বখাটে হচ্ছে, কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, নিষিদ্ধ সংগঠন করছে, সেসবের খোঁজখবর পরিবারসমূহ রাখছে না। বরং ছেলেরা যখন যা চাইছে, তাই দিয়ে দিচ্ছে, যা কিনতে চাইছে, তাই নির্বিঘে কিনে দিচ্ছে। তারা খোঁজ নিয়ে দেখছে না যে এসব টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। আর তা না হলে একজন তের-চৌদ্দ বছর বয়সের ছেলের কাছে লাখ লাখ টাকা দামের মোটর সাইকেল কীভাবে শোভা পায়? কীভাবে সেসব কিশোর তাদের স্কুল ব্যাগে ইয়াবা, ফেন্সিডিল, গাজা, মদ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কোন সাহসে তারা শিক্ষকের গলায় ছুরি ধরে? নারীদের রাস্তায় ছুরি চালিয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে পালিয়ে যায়?
আমরা সবসময় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও শাসন ব্যবস্থাকেই দায়ী করে থাকি। কিন্তু অসচেতন পরিবারের কারণে সমাজে উগ্রপন্থা বাড়ছে, সন্ত্রাসী কার্যক্রম বাড়ছে তার দিকে নজর দেওয়ার একটুও প্রয়োজন মনে করছি না বোধহয়। নানাবিধ কারণে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ আজ হারানোর পথে। আমরা এমন একটা সমাজের দারপ্রান্তে এসেছি যেখানে বাবার পাশেও সন্তান নিরাপদ না। বাবার সামনে কন্যাকে বাইকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। চোখের সামনেই সন্তান খুন ও নির্যাতিত হচ্ছে। বাবারা বিচার পাচ্ছে না। বাবারাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আইনের আশ্রয় নিলে হুমকি-ধামকি যেন আছড়ে পড়ছে। কথা হলো, এসব বাইকধারী কিশোর সন্ত্রাসী যতই ক্ষমতাসীন নেতা-কর্মীদের ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠুক না কেন, যতই তারা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হোক না কেন, আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে এইসব অপকর্ম দ্রুত বন্ধ করতে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। এদের বিচারের আওতায় আনতে যেসব চক্র বাধা প্রদান করবে তাদেরকেও যথাযোগ্য শাস্তি দিতে হবে। কেননা, ওদের ছত্রছায়া পেয়েই কিশোররা আজ বিপদগামী।
আমরা এমন একটা সুন্দর সমাজ নির্মাণের দিকে মনোযোগ দিতে চাই, যেখানে এই বর্বর-অসভ্যদের কোনো দিন জন্ম না হয়। শুধু কতিপয় বাইকধারী কিশোরদের বিচার করলে হবে না, এই বর্বরদের যারা তৈরি করে তাদেরও বিচার করতে হবে। লাম্পট্যের চাষাবাদ হয় যে সমাজে সে সমাজকে সুশিক্ষার মাধ্যমে আঘাত করতে হবে। কিশোর অপরাধের কবলে পড়ে সমাজটা যাতে ভেঙ্গে না যায় তার জন্য এখনই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রশাসনকে।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।