Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিশুদের জন্য মায়ের দুধের বিকল্প নেই

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

মাতৃদুগ্ধই নবজাত শিশুর জন্য আদর্শ খাদ্য। মাতৃদুগ্ধে শিশুর আইকিউ তথা বুদ্ধ্যঙ্ক বাড়ে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ পায় যেসব বাচ্চারা, তারা তীক্ষè-ধী শক্তি সম্পন্ন হয়। মাতৃদুগ্ধ নিয়মিত খেয়ে গেলে শিশু শুধু ছোটবেলাতেই নয়, বড় হয়েও বহু রোগভোগান্তি থেকে নিস্তার পায়। জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, জন্মের আধ ঘণ্টার মধ্যেই শিশুকে মাতৃদুগ্ধ তথা শালদুধ দিতে শুরু করা উচিত। জন্মের পর প্রথম ছয় মাস কেবল মাতৃস্তন্যই দিতে হবে। পানি, মধু খাওয়ানোর দরকার নেই। শিশুর খিদে-তেষ্টার চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ দিতে হবে। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত বুকের দুধই যথেষ্ট, অন্য কোনো খাবারের দরকার নেই। ছয় মাস বয়স পূর্ণ হয়ে গেলে বুকের পাশাপাশি শিশুর উপযোগী অন্য খাবার দিতে হবে। শিশুর অসুখ হলেও বুকের দুধ বন্ধ করা উচিত নয়। বরং শিশুকে বারবার মাতৃদুগ্ধ খেতে দেয়াই উত্তম। শালদুধ শিশুকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধির থাবা থেকে রক্ষা করে। ছয় মাস বাদেও শিশুকে স্তন্যদান বন্ধ করা উচিত নয়। শিশু যদি এক দেড় বছর বয়স পর্যন্ত খেতে চায় খাক। তাছাড়া স্তন্যদানের কারণে মায়ের মনমেজাজ ভালো থাকে। স্তন্যদানে প্রসবোত্তর ছয় মাসে গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। স্তন্যদায়ী মহিলারা সহজে মুটিয়ে যান না। স্তন্যদানে শরীর ¯িøম থাকে। স্তন্যদায়িনীদের ডিম্বাশয় এবং স্তনে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ কম থাকে।
মাতৃদুগ্ধের সুবিধা হলো, শিশু চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই এটি পেতে পারে। মাতৃদুগ্ধে শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদানই থাকে। প্রোটিন, শর্করা, ফ্যাট, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ এই পাঁচটি উপাদানই মাতৃদুগ্ধে পাওয়া যায়। লৌহঘটিত পদার্থ মাতৃদুগ্ধে পরিমাণে কম থাকলেও শিশুর লিভারে এবং দেহের অন্যত্র যে পরিমাণ লৌহঘটিত পদার্থ সঞ্চিত থাকে, তাতেই প্রথম মাস ছয়েক শিশুর চাহিদা মেটে। ছয় মাস পর শক্ত খাবার যুক্ত করলে শিশুর লৌহঘটিত পদার্থের অভাব হয় না।
মাতৃদুগ্ধে প্রোটিনের পরিমাণ কম হওয়ায় (১০০ গ্রাম দুধে গড়ে ১.১ গ্রাম) কিডনির উপর চাপ কম পড়ে। সাধারণত নবজাত শিশুর কিডনি যথেষ্ট পরিণত না হওয়ায় বেশি কাজের ধকল সহ্য করতে পারে না। কাজের ধকল বেশি হলে কিডনির কাজকর্ম ব্যাহত হয় ও উপযুক্ত পরিমাণে মূত্র দেহ থেকে নির্গত না হওয়ায় শিশুর দেহে বর্জ্য জমতে থাকে। শিশু খাবার গ্রহণ করতে নিরুৎসাহী হয় ও ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়তে থাকে। মাতৃদুগ্ধে প্রোটিনের পরিমাণ কম থাকায় শিশু এই সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা পায়। মাতৃদুগ্ধে রোগ প্রতিরোধকারী প্রোটিন অ্যান্টিবডি থাকে, বিশেষত ইমিউনোগেøাবিউলিন-এ যা শিশুকে বিভিন্ন ধরনের অসুখ-বিসুখ থেকে রক্ষা করে। যে সমস্ত শিশু মাতৃদুগ্ধ পান করে, তারা সর্দি কাশি ও পাতলা পায়খানা জাতীয় অসুখে কম ভোগে। শিশুর জন্মের পর প্রথম দুই দিন মায়ের বুকের দুধ এই অ্যান্টিবডির পরিমাণ সব থেকে বেশি থাকে।
মাতৃদুগ্ধে ল্যাকটোফেরিন নামক লৌহঘটিত এক ধরনের প্রোটিন থাকে যা শিশুর খাদ্যনালিতে অ্যান্টিমিবা জাতীয় পেটের অসুখের অণুজীবকে বাসা বাঁধতে দেয় না। মাতৃদুগ্ধ পান করলে খাদ্যনালিতে ল্যাকটোব্যাসিলাস জাতীয় জীবাণু বাসা বাঁধে, যা শিশুর কোনও ক্ষতি তো করেই না, বরং অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণুর সংক্রমণ থেকে শিশুকে রক্ষা করে। পর্যবেক্ষেণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মাতৃদুগ্ধে অসংপৃক্ত ফ্যাটি-অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি হওয়ায় (ওলিক ও লিনওলিক অ্যাসিড) সেই ফ্যাট সহজেই হজম হয়। তা ছাড়া অত্যাবশ্যক ফ্যাটি অ্যাসিডের অভাবজনিত অসুখও হয় না।
মাতৃদুগ্ধের ফ্যাট ও প্রোটিন সহজেই হজম হওয়ায় পাকস্থলি তাড়াতাড়ি খালি হয়। ফলে শিশুর খিদে পায়। মাতৃদুগ্ধে অ্যালার্জি সাধারণত হয় না। মাতৃদুগ্ধ পান করালে মা শিশুর মধ্যে পারস্পারিক বোঝাপড়া ভালো হয়, যা শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে প্রভূত পরিমাণে সাহায্য করে। প্রত্যেক শিশুরই মায়ের প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ থাকে ও জন্মের পর শিশু মাকেই বেশি পছন্দ করে। মাতৃদুগ্ধ পান করানোর সময় শিশু মায়ের ঘনিষ্ঠ হয়, ফলে আনন্দে থাকে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, জীবনের প্রথম দিকে শিশুর সঙ্গে মায়ের মানসিক ব্যবধান তৈরি হলে পরবর্তীকালে শিশুর জীবনে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। মাতৃদুগ্ধ পান করার সময় শিশুর মাড়িতে চাপ পড়ার ফলে মাড়ি ও দাঁত শক্ত হয়।
শিশু মাতৃগর্ভে থাকাকালীন মানে স্তন্যপান সম্পর্কে সচেতন করা ও জন্মের পর শিশুকে মাতৃদুগ্ধ খাওয়াতে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। কারণ মাতৃদুগ্ধ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্ত ধারণা আমাদের সমাজে চালু আছে যা শিশুর পক্ষে ক্ষতিকর। শিশুর জন্মের পর প্রথম দুই-তিন দিন মায়ের স্তন থেকে খুব অল্প পরিমাণে ইষৎ হলুদ বর্ণের যে ঘন তরল পদার্থ বের হয় তাকে বলে কলস্ট্রাম। এতে অ্যান্টিবডি জাতীয় প্রোটিন খুব বেশি পরিমাণে থাকে যা শিশুকে বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। অথচ দুধের মতো সাদা রঙ না হওয়ায় অনেকেই একে দুধ বলে মনে করেন না ও শিশুকে এটি খেতে দেন না। ফলে শিশুর ক্ষতি হয়। সমস্ত নবজাত শিশুকেই কলস্ট্রাম খেতে দেওয়া উচিত।
অনেকেরই জানা নেই, শিশু মাতৃদুগ্ধ পান করার চেষ্টা করলে মায়ের বুকে জমে থাকা দুধ বের হয় যা পুনরায় দুধ তৈরিতে সাহায্য করে। অনেক সময় ভ্রান্ত ধারণার ফলে দুধ নেই বা দুধ কম হচ্ছে অজুহাতে শিশুকে জন্মের পর কয়েকদিন মাতৃদুগ্ধ পান করতে দেওয়া হয় না। তাতে মায়ের বুকে দুধ তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, এমনকি পুরোপুরি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। প্রথমদিকে এই দুধের পরিমাণ কম হওয়াই স্বাভাবিক। শিশুকে বারে বারে স্তন্যপান করার চেষ্টা করলেই কেবল এই পরিমাণ বাড়তে পারে, অন্যথায় নয়। অনেক সময় মায়ের স্তনে ব্যথা আছে বলে শিশুকে স্তন্যপান করানো হয় না। এটিও ভুল ধারণা। স্তন্যপান করালেই বরং বুকের জমা দুধ বের হয়ে যায় ও ব্যথার উপশম হয়।
জন্মের তিন-চার দিনের মাথায় অনেক শিশুরই জন্ডিস (হলুদ প্রস্রাব ও চোখ হলুদ, শরীরও হলুদ বর্ণের হতে পারে) হয়। শিশুর লিভার অপরিণত থাকার কারণে ও শিশুর রক্তের লোহিত কোষ অতিরিক্ত পরিমাণে ধ্বংস হওয়ার ফলে এই জন্ডিস হয় যা সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। এই সময় শিশু শারীরিক দিকে দিয়ে সুস্থ থাকে ও স্বাভাবিকভাবেই খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। অনেক মা ভ্রান্ত ধারণাবশত এই সময় বুকের দুধ বন্ধ করে দেন যা শিশুর পক্ষে ক্ষতিকর। অবশ্য শিশু যদি ঝিমিয়ে পড়ে বা খেতে না চায়, তাহলে তার অন্য কারণে জন্ডিস হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অনেককেই বলতে শোনা যায়, মায়ের অম্বল আছে, তাই শিশুর বুকের দুধ দেওয়া হচ্ছে না। এটিও ভ্রান্ত ধারণা। অম্বলেরও অর্থ মায়ের পাকস্থলিতে বেশি পরিমাণে অ¤ø তৈরি হচ্ছে, এর সঙ্গে বুকের দুধের কোনও সম্পর্ক নেই। মায়ের অম্বলের চিকিৎসা করা প্রয়োজন, বুকের দুধ বন্ধ করে শিশুর ক্ষতি করা অনুচিত।
সাধারণত জন্মের পর দ্বিতীয় সপ্তাহে যে কোনও সুস্থ স্বাভাবিক শিশু দুই-চার ঘণ্টা পরপর খেতে চাইবে। যত বয়স বাড়বে, শিশু স্তন্যপান করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়তে পারে। পায়ে ও মাথায় আস্তে টোকা দিয়ে শিশুকে জাগিয়ে দেওয়া উচিত, যাতে সে তার প্রয়োজনীয় সবটুকু দুধই খেয়ে নিতে পারে। শিশু ঘুমিয়ে থাকলে তাকে জোর করে খাওয়ানো উচিত নয়। আবার খিদের জন্য কাঁদলে শিশুকে সবসময়ই খেতে দেওয়া উচিত। তবে কান্নার কারণ সবসময় খিদে নাও হতে পারে। পেটভরে খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই যদি কোনো সুস্থ শিশু কেঁদে উঠে, তাহলে অন্য কারণ ভাবা উচিত। প্রস্রাব-পায়খানা করলে, ঠান্ডা বা গরম লাগলে কিংবা বেশি জামাকাপড় পরালেও শিশু কাঁদতে পারে। অনেক সময় শুধু মায়ের কোলে উঠার জন্য শিশু কাঁদতে পারে। তাই শিশুর প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখা দরকার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন