হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
গল্পটা কম-বেশি সবারই জানা। একেকজন একেকভাবে উপস্থাপন করলেও মূল থিমটা একই। গ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি, যার ধমকা-ধমকিতে প্রায় সবাই তটস্থ থাকে। একদিন গ্রামের এক সাধারণ লোক উক্ত প্রভাবশালীর জমির আইল ধরে বাড়িতে যাচ্ছিল। প্রভাবশালী ব্যক্তি তা দেখে ধমক দিয়ে বলল, অ্যাই বেটা আমার ক্ষেতের আইল ধরে যাচ্ছিস কেন? লোকটি ধমক খেয়ে জমির মাঝ দিয়ে যাওয়া শুরু করে। প্রভাবশালী ব্যক্তি আরও ক্ষেপে গিয়ে বলল, তোর এতো বড় সাহস! আমার ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিস! লোকটি তাড়াতাড়ি ক্ষেত থেকে উঠে পাশের রাস্তায় গিয়ে উঠে। প্রভাবশালী ব্যক্তি বলল, তুই আবার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিস! লোকটি অসহায় হয়ে জিজ্ঞেস করল, তাহলে কী করব! প্রভাবশালী ব্যক্তি ধমক দিয়ে বলল, ‘কী’ও করতে পারবি না। গল্পটি উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, ক্ষমতা থাকলে মানুষকে কীভাবে দমন এবং তার বাকশক্তিকে কীভাবে হরণ করা যায়, গল্পটিতে তা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে উঠে এসেছে। ক্ষমতা এমন এক জিনিস, যার আছে সে যদি তার অপব্যবহার করে, তবে সাধারণ মানুষের কেন অসাধারণ মানুষেরও কিছু করার থাকে না। কিছু বলতে গেলেই তাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দমন করা হয়। এ ধরনের ঘটনা সাধারণত সামন্ততান্ত্রিক যুগ কিংবা স্বৈরশাসকদের আমলে ঘটতে দেখা যায়। সেখানে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। সচেতন ও সাধারণ মানুষের ‘ফ্রিডম অফ স্পীচ’ বাধাগ্রস্ত হয়, গণ-এর ইচ্ছা নয়, ব্যক্তি-ইচ্ছাই সেখানে শেষ কথা। কেউ এর ব্যতিক্রম করলেই, তার উপর খড়গ নেমে আসে। তাকে শায়েস্তা করার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরনের পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়। ইতিহাস হচ্ছে, এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা বেশিদিন স্থায়ীত্ব লাভ করে না। একটা সময় গণইচ্ছার কাছেই পরাভূত হয়। আমাদের দেশে এর একাধিক নজির রয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘ফ্রিডম অফ স্পীচ’-এর বিষয়টি কতটা আছে, তা সচেতন মানুষ মাত্রই জানে। টেলিভিশন টকশোগুলোর দিকে যদি লক্ষ্য করা যায়, তবে দেখা যাবে সেখানে কেবল ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ও সমর্থকদেরই উপস্থিতি। সরকারের গুণগান ও উন্নয়ন ছাড়া কথা নেই। সরকার তার সাফল্যের কথা বলবে, এটাই স্বাভাবিক। তার উন্নয়নের কথা বলতেই পারে। তবে বিরোধী দলেরও যে কথা থাকতে পারে, তাদের সমালোচনাও যে শুনতে হয়, এ সুযোগটি সে দিচ্ছে না, দিতে চায় না। বলা যায়, বিরোধী দলকে দমন করে বা জোর করে চুপ করিয়ে রেখে এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বহুদিন ধরেই বলছেন, বাকস্বাধীনতার বৃত্তটিকে প্রায় বিন্দুতে পরিণত করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের বাকস্বাধীনতা অবারিত। আর বিরোধী পক্ষের বাকস্বাধীনতা সীমাবদ্ধ নেহায়েতই যতটুকু প্রকাশ না করলে নামমাত্র গণতন্ত্রের উপর আঁচড় পড়বে, ততটুকুই প্রকাশ করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এটুকু প্রকাশ করতে দিয়েই ক্ষমতাসীন দল অবারিত বাকস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের কথা বলছেন। এই যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তাদের অবস্থাটা এখন কী! ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন তাদের কাউকে পিটিয়ে পা ভেঙ্গে দিয়েছে, কাউকে তথ্যপ্রযুক্তি মামলায় গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। বাকী যারা আছে তাদেরকে দৌড়ের ওপর রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দাঁড়াতেও দেয়া হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নোটিশ জারি করেছে বহিরাগতরা এখানে ঢুকতে পারবে না। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে গণ্য করা হয়। যে কোনো আন্দোলনে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা এখানেই ছুটে আসে। সাধারণ মানুষও শামিল হয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে এখান থেকেই বেগবান হয়েছিল। অথচ এখন ন্যায্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক জন মিল্টনের মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আকুল হয়ে বলেছিলেন, ‘গিভ মি দ্য লিবার্টি টু নো, টু আটার, অ্যান্ড টু আরগু ফ্রিলি অ্যাকোর্ডিং টু কনসাইয়েন্স, এভাব অল লিবার্টিস। তিনি বাকস্বাধীনতার নামে যা খুশি তা বলার অধিকার চাননি। যা সত্য এবং উচিত তাই বলতে দেয়ার দাবী করেছেন। এ কথা সত্য, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক অসৌজন্যমূলক ও অশোভন ভাষার ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। বেফাঁস কথাবার্তা শেকড় গেঁড়ে বসেছে। সচেতন জনসাধারণ এ ধরনের কথাবার্তা শুনে অভ্যস্ত। রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকরা যে ভাষায় কথা বলেন, তাদের এসব কথা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে যে পড়ে না এবং তা জনসাধারণ বোঝে না এমন নয়। তারা বোঝে এবং বোঝে বলেই এসব ভাষা ‘কথার কথা’ বা রাজনীতিকরা এমনই বলেন বলে এড়িয়ে যায়। রাজনৈতিক নেতাদের এ ধরনের বাকস্বাধীনতা যে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। সচেতন শ্রেণীর অনেকের মধ্যে রাজনীতিকদের লাগামহীন বক্তব্যকে ‘পলিটিক্যাল রেটরিক’ বা বাগাড়ম্বরপূর্ণ ও মাঠে-ময়দানের বক্তব্য বলে জায়েজ করার প্রবণতা রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জনসাধারণ যাদের নেতা মানে, ভরসা করে এবং যারা জননেতা বলে দাবি করে, তাদের কথা কেন রেটরিক হবে? কেন কথার কথা হবে? তাদের কথার কি কোন দাম থাকবে না?
দুই.
জনসাধারণের বাকস্বাধীনতার বিষয়টি সাধারণত নির্ভর করে রাজনৈতিক দল ও তার নেতৃবৃন্দ, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত প্রিণ্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সচেতন নাগরিক মহলের উপর। তাদের দায়িত্ব জনসাধারণের জন্য উচিত-অনুচিত এবং কল্যাণ-অকল্যাণমূলক ঘটনা এবং কথাবার্তা সুবিবেচনাপ্রসূত অথচ অবারিতভাবে প্রকাশ করা। এ দায়িত্ব পালনে তারা কতটা স্বাধীন বা তাদের করতে দেয়া হচ্ছে, তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ ফ্রিডম অফ স্পীচ বা ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৪৮ সালে গৃহীত ‘ইউনিভার্সেল ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটস’-এর আর্টিক্যাল ১৯-এ বলা হয়েছে, কোন ধরনের বাধা ছাড়া প্রত্যেকেরই মতামত প্রকাশ ও ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। এর মধ্যে সব ধরনের তথ্য খোঁজা, গ্রহণ করা এবং তা বলা, লেখা, শিল্পকলাসহ যত ধরনের প্রকাশ মাধ্যম রয়েছে, তার পছন্দমতো মাধ্যমে প্রকাশ করা। তবে এ স্বাধীনতা সতর্কতার সাথে বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে চর্চা করতে হবে, যাতে অন্যের অধিকার ও সম্মানহানি এবং জাতীয় ও জনসাধারণের নিরাপত্তা বিঘিœত না হয়। অর্থাৎ বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রটি কেবলমাত্র নিশ্চিত হতে পারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক পরিবেশে। আমাদের দেশে বাকস্বাধীনতার এই মৌলিক শর্তটির অনুপস্থিতি এখন কতটা তীব্র আকার ধারণ করেছে, তা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। ক্ষমতাসীনদের জন্য যে কথা সুবিধাজনক সেটাই সঠিক, আর তার বিরোধীদের কথা একেবারে অগ্রহণযোগ্য, এমন প্রবণতা তার মধ্যে পরিদৃষ্ট হচ্ছে। অথচ গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার নিউক্লিয়াসই হচ্ছে, অন্যের মতামত পছন্দ না হলেও তার গুরুত্ব দেয়া। বিশ শতকে নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন, তুমি যদি বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করো, তবে তোমাকে ধরেই নিতে হবে তোমার বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির বাকস্বাধীনতাকে পছন্দ করতে হবে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, একনায়ক স্বৈরাচার হিসাবে পরিচিত অনেকেই তাদের বিরুদ্ধবাদীদের মতামত পছন্দ করতেন। আর ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের বিখ্যাত সেই উক্তি তো সকলেরই জানা। তিনি বাকস্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, তোমার মতের সাথে আমি একমত না হতে পারি, তবে তোমার মত প্রতিষ্ঠায় আমি জীবন দিতে পারি। বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পক্ষে তার এমন উক্তি অমর হয়ে রয়েছে। তার নির্যাস মুক্তমনের মানুষ সবসময়ই ধারণ করে চলেছে। আমাদের দেশের মতো গণতন্ত্রকামী দেশে যেখানে গণতন্ত্র পুরোপুরি ভিত্তি লাভ করেনি, সেখানে গণতন্ত্র অনেকটা তৈলাক্ত বাঁশে বানরের উঠানামার মতো অবস্থায় রয়েছে। গণতন্ত্রকে একেক দল বা গোষ্ঠী তাদের সুবিধা মতো সংজ্ঞায়িত করেছে এবং করে চলেছে। মুখে মুখে বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশ এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারতের উদাহরণও প্রায়ই তারা দিয়ে থাকে। গণতন্ত্রের এসব উদাহরণ দেখিয়ে জনসাধারণের আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি করলেও কার্যক্ষেত্রে এর চর্চা এবং প্রতিফলন দেখা যায় না বললেই চলে। এখন তো বলা যায়, গণতন্ত্রের মোড়কে এক ধরনের একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। অথচ গণতন্ত্রের জন্য এদেশের মানুষ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেই বারবার আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। পরিতাপের বিষয়, যাদের নেতৃত্বে জনগণ সংগ্রাম করেছে, ক্ষমতায় আসার পর তাদের দ্বারাই গণতন্ত্রের সুরক্ষা ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। জনসাধারণের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। এক গণতন্ত্রের জন্য তাদের আর কত আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে? এ প্রশ্ন এখন দেখা দিয়েছে। অনেককে বলতে শোনা যায়, ব্রিটিশ, আমেরিকার গণতন্ত্র ভিত্তি লাভ করতে শত বছর লেগেছে। তাদের দেড়-দুইশ’ বছরের গণতন্ত্র। আর আমাদের যাত্রা তো সবে শুরু। তাদের এসব কথার মধ্যে যে এক ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক ও শাসন-শোষনের মনোভাব রয়েছে, তা সচেতন মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাদের এ কথার অন্তর্গত অর্থ হচ্ছে, শতবর্ষ না পেরুলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না, কাজেই জনসাধারণকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। এটা গণতন্ত্রকামী মানুষের সাথে এক ধরনের প্রবঞ্চণা ছাড়া আর কী হতে পারে! যে রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে দেশে গণতন্ত্র নেই, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, সেই তারা যখন ক্ষমতায় গিয়ে একই কাজ করে, তখন দেশের মানুষের আশ্চর্য হওয়া ও আফসোস করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। দেশের রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যদি এ ধরনের মনোভাব থাকে, তবে শত বছর কেন, হাজার বছরেও গণতন্ত্র ভিত্তি লাভ করবে না। মানুষের বাকস্বাধীনতাও নিশ্চিত হবে না। যারা উচিত কথা বলতে যাবেন, তাদেরকে পদে পদে হুমকি-ধমকির মধ্যেই থাকতে হবে। দেশে বর্তমানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটুকু তা গত শনিবার ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ন্যায্য দাবিতে শন্তিপূর্ণ আন্দোলনের অধিকার: কোন পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সংলাপে বক্তারা বলেন, অবস্থা এমন হয়েছে যে অনেকে ভয়ে কথা বলছেন না। কথা বললে জামায়াত-শিবিরসহ বিভিন্ন তকমা দেয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আইনের শাসন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাইলে জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছেন, বিরোধী দলকে কোথাও দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না। গণতন্ত্র হরণ এবং বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেছেন, দেশে যদি গণতন্ত্র না থাকে, তবে বিএনপি কীভাবে অশালীন ভাষায় কথা বলছে। অবশ্য বিএনপি অশালীন ভাষায় কথা বলছে কিনা, তা সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই শুনছে এবং তার বিচারের ভার তাদের ওপরই ছেড়ে দেয়া উচিত। তবে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের এ বক্তব্যে এটা মনে হতে পারে, বিএনপির কথা বলাই উচিত নয়।
তিন.
আমাদের দেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কতটুকু রয়েছে, তা নিয়ে আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশ এখন এক অস্বাভাবিক ও অসহনীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছে। প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল আন্দোলন করতে গেলেই ক্ষমতাসীন দল তাকে সন্ত্রাসী কর্মকাÐ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। সচেতন নাগরিক সমাজ এই পরিস্থিতিকে পলিটিক্যাল অ্যানহিলেশন বা নিশ্চিহ্নকরণ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। অনেকে বলছেন, ক্ষমতাসীন দল আন্দোলনরত বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে তাদেরকে যে নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়া অবলম্বন করছে, তা কখনো না কখনো বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে। ক্ষমতাসীনদের অস্তিত্বের স্বার্থেই কার্যকর বিরোধী দলের প্রয়োজন রয়েছে। তারা মনে করছেন, ক্ষমতাসীন দল আর সরকারের মধ্যে এখন আর কোনো পার্থক্য নেই। তাদের আশঙ্কা, যদি কোনো দিন সরকারের পতন হয়, তবে সরকারের সাথে দলের পতন অনিবার্য হয়ে উঠবেই। ক্ষমতাসীন দল এ দিকটি বিবেচনায় না নিয়ে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে বিরোধী দল দমনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন এক নতুন স্টাইলে করে নিজেদের বিজয় নিশ্চিতের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সচেতন মানুষ তো বটেই একজন সাধারণ মানুষও ক্ষমতাসীন দলের এই লোক দেখানো কৌশল সম্পর্কে অবগত। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বরাবরই অভিযোগ করে আসছে, জনগণ যাতে প্রকৃত ঘটনা জানতে না পারে তাই মিডিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশে প্রতিমুহূর্তে কি হচ্ছে, না হচ্ছে, তা জানার অধিকার দেশের মালিক জনগণের রয়েছে। তাদের এ জানানোর কাজটি যেসব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া রয়েছে, সেগুলো যে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে, তা তারা বুঝতে পারছে। বাংলাদেশে যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত অবস্থায় রয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কয়েক বছর আগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অব্যাহত অবনতি ঘটছে। সঙ্কুচিত হয়ে আসছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। অব্যাহত রয়েছে গণমাধ্যম সম্পাদক আর নির্বাহীদের হয়রানি। তাদের উপর প্রচÐ চাপ সৃষ্টি করেছে সরকার।’ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকারি দলের এক প্রভাবশালী নেতা সংগঠনটিকে বিরোধী দলের দালাল বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সরকারি দলের লোকজন দ্বারা যেখানে বিশ্বখ্যাত সংগঠন তোপের মুখে পড়ে, সেখানে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের উপর সরকার প্রচÐ চাপ সৃষ্টি করেছে, এ কথা দেশীয় কোন মানবাধিকার সংগঠন বা ব্যক্তি বললে, তার পরিস্থিতি কী হতে পারে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। যারাই বলতে গেছে, তাদের কী অবস্থা হয়েছে তা এ সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম বন্ধ ও পরিণতি ভোগ করার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছে। বলা প্রয়োজন, গণমাধ্যম অত্যন্ত সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল মাধ্যম। এখানে সচেতন, দক্ষ ও পেশাদার ব্যক্তিরাই কাজ করেন। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না, তারাও মানুষ। ভুল তাদেরও হতে পারে। আর তাদের ভুলের প্রতিকারের নানা নিয়মকানুন ও বিধিব্যবস্থা রয়েছে। তার অর্থ এই নয়, ভুলের জন্য মাধ্যমটিকেই বন্ধ করে দিতে হবে বা মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলতে হবে। চার.
আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সংকুচিত অবস্থার মধ্যে থাকলেও যারা নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সংগ্রাম করছেন, তাদের সতর্ক থাকা উচিত। কোনো ধরনের ফাঁদে পা দেয়া বা অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত নেয়া সঠিক হবে না। ক্ষমতায় যে থাকে, তার কূটচালের অভাব হয় না। পূর্ণ গণতন্ত্র এবং বাকস্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে হলে বুঝেশুনে পা ফেলতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, তাদের ভুলের কারণে যদি পুনরুদ্ধারের কাজটি ব্যাহত হয়, তবে আম ও ছালা দুটোই যাবে। এখন যেটুকু অস্তিত্ব রয়েছে সেটুকু নিয়েও শঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। তাদের মনে এ বিশ্বাস রাখতে হবে, গণতন্ত্রের স্পিরিটটাই এমন যে, জরুরী অবস্থার মধ্যেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করা বা দমানো যায় না। কোন না কোনভাবে তা প্রকাশিত হবেই। এ প্রকাশকে যারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে দমাতে চায়, তা কোনক্রমেই তাদের অনুকুলে যায় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, ফ্রিডম অফ স্পীচ গণতন্ত্রের ‘সেফটি ভাল্ভ’ বা নিরাপদ কপাট হিসেবে কাজ করে। বিশ্ব ব্যাংকের ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড গর্ভনেন্স ইন্ডিকেটরস’ প্রজেক্টের আওতায় কিছুকাল আগে বিশ্বের ২০০ দেশের উপর করা জরিপে দেখা গেছে, যেসব দেশে বাকস্বাধীনতা এবং জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া রয়েছে, সেসব দেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র সংহত হয়েছে। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে আসা নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সচেতন মহল আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে যেটুকু গণতন্ত্র রয়েছে, সেটুকুও বিলুপ্ত হতে পারে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, ক্ষমতাসীন দল এ ব্যাপারে সচেতন হবে এবং গণতান্ত্রিক ধারা ও বাকস্বাধীনতার সংকোচন নীতি পরিহার করে শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।