Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

লাখো রাশেদের মা সালেহা

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৮, ১২:৪১ এএম

সালেহা বেগম। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাশেদ খানের মা। রাশেদের মা নামেই সবাই চেনেন। রাজমিস্ত্রি স্বামী কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় বাধ্য হয়েই পরের বাড়িতে ঝি’য়ের কাজ করেন। ঝিনাইদহ জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের দুঃস্থ নারী রাশেদের মা এখন হয়ে উঠেছেন দেশের লাখ লাখ তরুণের মা। যে সব তরুণ-যুবক ছাত্রছাত্রী কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছেন; সালেহা বেগম যেন সবার মা’য়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছেন। সন্তানের জন্য মায়ের আর্তি, আহাজারী, গগণবিদারী আত্মনাদ তাকে বিশেষ মর্যাদায় যায়গায় বসিয়ে দিয়েছে। ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘রুমির মা’ বললেই সবাই যেমন জাহানারা ইমামকে বুঝতেন; তেমনি বর্তমানে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ‘রাশেদের মা’ শব্দ উচ্চারণ করলেই মানুষ বুঝে যায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মা।
ঝিনাইদহের গ্রামে রাশেদের মা এর আগে কখনো ঢাকায় আসেননি। ছেলের গ্রেফতারের খবর শুনে ঢাকা এসেছেন। ঢাকায় পা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নয়; তাকে ছুটতে হয়েছে ডিবি অফিস, ডিএমপি, শাহবাগ থানা, সিএমএম কোর্ট, প্রেসক্লাব, রিপোর্টাস ইউনিটি এবং বিভিন্ন সেমিনারে; ঘুরতে হচ্ছে পথে পথে। তিনি এখন ছেলেকে ঢাকায় রেখে লেখাপড়া শিখে বিদ্যান করার বদলে অর্ধশিক্ষিত রেখেই গ্রামে নিয়ে যেতে চান। রাজধানী ঢাকাকে বড় নিষ্ঠুর মনে করেন সালেহা। সবার কাছে তার আর্তি আমার মণিকে (রাশেদ) তোমরা মাফ করে দাও। ভিক্ষা দাও। আমার মণিকে আমি ঢাকায় আর রাখবো না গো। গ্রামে নিয়ে চলে যাব। শুধু মুক্তি দাও। সেও বাঁচুক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষার্থী রাশেদ খানের মা ছেলের মুক্তির জন্য বিভিন্ন জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, রাশেদ পঞ্চম, অষ্টম, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে সরকারি ও ব্যাংকের বৃত্তির টাকা পেয়েছে। লেখাপড়ার বাকি টাকা জুগিয়েছেন ঘাম ঝরিয়ে। ছাগল বিক্রী করে ছেলেকে এমবিএ ভর্তি করিয়েছেন। স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষে ছেলে চাকরি পাবে; কষ্টের দিনও শেষ হবে। এখন সেই স্বপ্ন ভুলতে চান। লেখাপাড়া আর চাকরির দরকার নেই; ঘরে ছেলে ঘরে ফিরে গেলেই মায়ের স্বস্তি। কিভাবে মানুষের সঙ্গে গুছিয়ে কথা বলতে হয় তা জানেন না সালেহা। তারপরও মানুষের সহায়তায় ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছেন। বুদ্ধিজীবী, সশীল সমাজ ও বিজ্ঞজনদের সেমিনারে অংশ নিয়ে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আর্তি জানিয়েছেন। গত শনিবারও রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ আয়োজিত ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ন্যায্য দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অধিকার ঃ কোন পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল সংলাপে রাশেদের মায়ের কাঁন্নায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। বলেন, কতদিন আমার বাবার (রাশেদ খান) মুখ থেকে ‘মা’ ডাক শুনি না। আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। ওতো শুধু একটা চাকরি চেয়েছিল। কেন তাকে এতদিন রিমান্ড নেয়া হয়েছে? কেন তাকে কারাগারে রাখা হলো? আমার ছেলেকে আপনারা ফিরিয়ে দাও। আমার পরিবারকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দিন, বলেই অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন। এ যেন শুধু ঝিনাইদহের গ্রামের রাশেদের মান নয়; সমগ্র বাংলাদেশের লাখ লাখ রাশেদ যারা শিক্ষা জীবন থেকে করে চাকরি না পেয়ে বেকার দূর্বিসহ জীবন যাপন করছেন তাদের সকলের মায়ের আকুতি।
শিক্ষা জীবন থেকে করে শিক্ষার্থীরা চায় মেধার ভিত্তিতে চাকরির নিশ্চয়তা। এটাই তাদের অপরাধ? এ জন্যই তাদের ওপর ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সুনামী। হামলা-মামলা, জুলুম-নির্যাতন, জেল যেন তাদের নিয়তি হয়ে গেছে। গতকালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ফের হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে হামলার প্রতিবাদ ও গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু টাওয়ার এলাকায় তাদের আক্রমন করে ছাত্রলীগ। এর আগেও বেশ কয়েক বার আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর পৈচাসিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রছাত্রীদের ওপর বর্বারোচিত হামলা ও পুলিশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশ বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠেছে। আমেরিকা, সুইডেন, ইংল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ কোটা বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে বিবৃতি দেন। তারা জানতে চায় কেন এমন জুলুম তরুণদের ওপর। এমনকি বাংলাদেশের নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অধ্যায়নরত ছাত্রছাত্রীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর জুলুমের প্রতিবাদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ করেছেন। শনিবারও ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি ৬২ জন শিক্ষার্থী এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন তরুণদের ওপর দমন-পীড়নের ঘটনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে তরুণ শিক্ষার্র্থীদের ওপর কেন এই জুলুম। তাদের কি যোগ্যতার মাফকাঠিতে চাকরি পাওয়ার অধিকার নেই? যে দেশ মেধাবী তরুণ-যুবসমাজকে যোগ্যতা মেধার মাফকাঠিতে চাকরি দিতে চায় না; সে দেশ কি মেধাবীদের ধরে রাখতে পারে?
তরুণরাই জাতির প্রাণশক্তি। যুগে যুগে ন্যায়-সত্যের জন্য সংগ্রাম করেছে তরুণরা। তারা পুরাতনকে ভেঙে নতুন দেশ গড়েছে। তরুণরা অন্যায়ের কাছে কখনো মাথানত করেনি। যারা পরাজয় মানতে নারাজ তারাই তো তরুণ! তরুণদের এই প্রাণশক্তি স্থবির নয়। তারা সদা চঞ্চল, সদা সৃষ্টিতে বিশ্বাসী। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯ গণঅভ্যুত্থান, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি ’৯০ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ২ কোটি কর্মক্ষম ছাত্রছাত্রী; যারা আগামীর স্বপ্ন দেখছেন। যুবসমাজ প্রায় ৩ কোটি; যারা শিক্ষা জীবন শেষ করে কেউ কাজ করছেন কেউ কাজ করার স্বপ্ন দেখছেন। আমাদের পাশের দেশ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীন। বাংলাদেশের তুলনায় ওইসব দেশে তরুণসমাজ খুব কম। প্রাকৃতিক সম্পদ ও মাটির উর্বরতাও সীমাবদ্ধ। এই অল্প সম্পদে ওই সব দেশে যুবকরা হয়ে গেছেন বিশাল সম্পদ। অথচ আমরা? জাতির উন্নতি, অগ্রগতিতে প্রয়োজন উপর্যুক্ত তরুণসমাজ। যারা সমাজ ও দেশের কল্যাণে অবদান রাখবে, দেশের যাবতীয় সম্পদকে উর্বর করবে। রাষ্ট্রীয় সংহতি, বিকাশে পাহারাদার হবে। জনগণের কল্যাণ ও মানবতা রক্ষার্থে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেবে। আমরা কি তরুণদের সেদিকে নিতে চেষ্টা করছি? দেশে এখনো শতকরা ৪০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। শিক্ষা শেষে কাজের দাবীতে আন্দোলন করতে হয়। অন্যদিকে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে। কানাডায় বেগম পল্লী মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম এবং সুইস ব্যাংকে টাকার পাহাড় গড়ছে। তাদের জীবনযাত্রা প্রণালী ইউরোপ-আমেরিকার সমান্তরাল। জীবন উপভোগে তারা পাশ্চাত্যের সমকক্ষ। অথচ তরুণদের বড় একটি অংশ চরম হতাশায় নিমজ্জিত। শিক্ষা শেষে তরুণদের কেউ কেউ চাকরি না পেয়ে বিদেশ চলে যাচ্ছে। যাদের সে সুযোগ নেই তারা হতাশায় মাদকের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ব্যবসায়িক স্বার্থে একশ্রেণীর রাজনীতিক-প্রশাসনিক কর্তা মাদকসেবীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। দেশের আনাচে-কানাচে মাদক এখন সহজলভ্য। মাদকে আটকে যাচ্ছে যুব সমাজের প্রাণশক্তি। হতাশাগ্রস্থ মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত তরুণদের বড় অংশ নেশাতে আক্রান্ত। তাদের স্বপ্ন ও প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য যোজন যোজন মাইল। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। এই মাদক মুক্ত দেশ গড়তে হলেও তো হতাশায় ডুবে থাকা শিক্ষিত তরুণদের চাকরির ব্যবস্থা করা উচিত। এতে আর যাই হোক রাশেদের মায়ের মতো দেশের লাখ লাখ রাশেদের মায়ের চোখের পানি ফেলতে হবে না। ##



 

Show all comments
  • রফিকুল ইসলাম পাখি ১৬ জুলাই, ২০১৮, ২:১১ এএম says : 0
    এইসব মর্মান্তিক ঘটনার বিচার না হলে বাংলাদেশ কখনোই সামনে এগিয়ে যেতে পারবে না। পিছিয়ে পড়বে। গণতন্ত্র সুসংহত হবে না।
    Total Reply(0) Reply
  • মুহাম্মাদ মুরাদ মিয়া ১৬ জুলাই, ২০১৮, ২:২৯ এএম says : 0
    লক্ষ কোটি টাকা আত্নসাতকারী চোর ডাকাতরা বুঁকফুলে ঘুরেবেড়াই আর যৌক্তিকদাবীতে আন্দোলনরত ছাত্রদের রিমান্ড শেষে যেতেহয় হাজতে !
    Total Reply(0) Reply
  • Md Shojib Ali ১৬ জুলাই, ২০১৮, ২:৩০ এএম says : 0
    রাশেদ খাঁন এর মায়ের আর্তনাত..... আমার মনিকে ভিক্ষা দাও,আমার মনির আর চাকরী দরকার নাই....
    Total Reply(0) Reply
  • Protik Saha ১৬ জুলাই, ২০১৮, ২:৩১ এএম says : 0
    সাধারণের অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেও জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করেছেন।
    Total Reply(0) Reply
  • Alamin Sumon ১৬ জুলাই, ২০১৮, ২:৩২ এএম says : 0
    কোটা আন্দলনের নেতা হওয়াই ছিল তাদের অপরাধ। সাধারন ছাএদের উপর বর্বরতা নির্যাতন বন্ধ করুন।
    Total Reply(0) Reply
  • তপন ১৬ জুলাই, ২০১৮, ২:৩৩ এএম says : 0
    মা আমরা তোমার লক্ষ সন্তান বিজয়ী বেশে তোমার ছেলেকে নিয়ে ফিরবো
    Total Reply(0) Reply
  • Shah Alam ১৬ জুলাই, ২০১৮, ২:৩৭ এএম says : 0
    আল্লাহ তুমি এই অসহায় মায়ের কান্নার বিচার করো
    Total Reply(0) Reply
  • Sagar ১৬ জুলাই, ২০১৮, ২:৩৮ এএম says : 0
    Maa Please don't down you head to evil. You are the SAMBAL of our hero mother . Whole National pray for our quota demonstration hero.
    Total Reply(0) Reply
  • Jack Ali ১৬ জুলাই, ২০১৮, ১১:৫৮ এএম says : 0
    Our Government is populated with heartless people as a result they are committing heinous crime to us,
    Total Reply(0) Reply
  • শাহীন আহমদ ১৬ জুলাই, ২০১৮, ২:৩৬ পিএম says : 0
    সবাইকে রাজপথে আসতে হবে। রাজপথেই সমাধান।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ