বাড়িতেই ফাইনাল দেখবেন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট কাতারে
বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ দেখতে কাতারে যাচ্ছেন না আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ। তিনি জানান, আজ
রাশিয়া থেকে আগেভাগেই বিদায় নিয়েছে আসরের অন্যতম ফেভারিট দুই দল আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। কিন্তু ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়া ফাইনাল ম্যাচকে ঘিরে লুজনিকি স্টেডিয়াম চত্বর তো বটেই পুরো মস্কো শহরই বলছে ভিন্ন কথা। ফাইনালের আবেশে পুরো মস্কোকে মাতিয়ে রেখেছে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ফুটবল সমর্থকরা। দুই ফাইনালিস্ট দলের সমর্থকদের উৎসবও সেখানে ¤øান।
আসলে শুধু আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল নয়, ফাইনাল ম্যাচকে ঘিরে সারা বিশ্বের নানান জাত-বর্ণের মানুষের আনাগোনায় মুখর রাশিয়ার রাজধানী শহর মস্কো। মস্কোর ইজমাইলোভো এলাকায় যে পাঁচটি বিশাল বিশাল হোটেল আকাশ ফুঁড়ে বের হতে চাইছে সেখানে তিল ধারনের ঠাই নেই। রাস্তা-ঘাট সবখানেই একই দৃশ্য। নানান বর্ণ-ধর্ম-জাতের মানুষের আনাগোনা। আনাগোনা বরলে অবশ্য কম বলা হয়, বলা যায় মস্কো শহরটাই লোকে লোকারণ্য। পরনে তাদের প্রিয় দেশের জার্সি। জার্সি ও হাতের পতাকাই আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল ভক্তদের আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। তারা যে কতটা ফুটবল পাগল জাতি তার প্রমাণ মিলল রাশিয়া বিশ্বকাপেও। দল বিদায় নিয়েছে আগেই, এজন্য ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি তারা। আগে থেকেই ফাইনালের টিকিট কেটে রাখায় স্ট্রেডিয়াম চত্বর তো বটেই পুরো মস্কো শহরটাই যেন তাদের দখলে। এই দৃশ্য সত্যিই অবাক করার মত। এমন উৎসব মস্কোবাসী কখনো দেখিনে। ফুটবল যে সম্প্রীতির খেলা, ভ্রাতৃত্বের খেলা এটা যেন তারই উদাহরণ।
সৌন্দর্যের মড়োকে জড়ানো লুজনিকি স্টেডিয়াম চত্বর আলাদা করে নজর কাড়ে। বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে স্টেডিয়ামের রূপসজ্জা বাড়ানো হয়েছে। যেন বিয়ের আসর বসেছে লজনিকিতে। স্টেডিয়ামটি ক্রেমলিন থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে। বিশাল চত্বরের চারপাশ সবুজে ঢাকা পার্ক। পুরো স্টেডিয়ামটাই একটা অসাধারণ স্পোর্টস কমপ্লেক্স। রয়েছে কয়েকটি ট্রেনিং গ্রাউন্ড। তারই একটিতে অনুশীলন করছে ক্রোয়েশিয়া ফুটবল দল। ফ্রান্সের অনুশীলন গ্রাউন্ড অবশ্য স্টেডিয়াম চত্বর থেকে একটু দুরে। অ্যাথলেটিক্সের সুযোগ সুবিধা তো রয়েছেই।
১৯৫৬ সালে চালু হওয়া এই স্টেডিয়ামের রয়েছে ১৯৮০ অলিম্পিক আয়োজনের গৌরব। উয়েফা কাপ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল আয়োজনের মত গৌরবও আছে লুজনিকির। স্টেডিয়ামকে আরো সুন্দর করে তুলেছে মস্কোভা নদী। স্টেডিয়ামটাকে তিন দিক থেকে ঘিরে ধরেছে নদীটি। পর্যটকদের জন্য নদীতে রাখা হয়েছে নানান ধরণের প্রমোদ নৌকা। বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্টেডিয়ামের সঙ্গে অতিথিদের সরাসরি যোগাযোগের জন্য নদীর উপর দিয়ে করা হয়েছে কেবল কারের ব্যবস্থা।
লুজনিকির রূপ বর্ণনায় দুই ফাইনালিস্ট দলের নিয়েই কিছু বলা হলো না। বিশেষ করে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ ফাইনালে পা রাখা ক্রোয়েশিা যেন জীবন্ত স্বপ্নের মাঝে রয়েছে। সম্প্রতি দেশটির মন্ত্রিসভা কেবিনেট মিটিংয়ে অংশ নিয়েছে স্বদেশী জার্সি পরে। ফাইনালের জন্য ভক্তরা ছুটে এসেছে রাশিয়ায়। ফাইনাল উপলক্ষ্যে ফ্রান্সের সমর্থকরাও আছে তবে ক্রোয়াটদের তুলনায় নগন্য। এর প্রধাণ কারণ স্বাগতিকদের সমর্থন। ফাইনালে রাশিয়ানদের সমর্থন পাওয়ায় ক্রোয়াটদের উল্লাসের মাত্রাটা একটু বেশি। লুজনিকির আসেপাশে তাদের প্রচুর আনাগানো। তাদের সবাই যে আজ গ্যালারিতে বসে খেলা দেখার সুযোগ পাবেন তা নয়। মাঠের বাইরে বসানো বিশাল জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখবেন তারা।
রাতের ফাইনাল ম্যাচ শেষে হয়ত কোন এক দলের মুখে ফুঁটবে চওড়া হাসি। কেউ কাঁদবেন খুব কাছে এসেও স্বপ্নকে ছুঁতে না পারার হতাশায়। কিন্তু ফুটবলের যে আসল উদ্দেশ্য তা কিন্তু পুরোটাই পূরণ করেছে রাশিয়া। স্টেডিয়াম চত্বরে নানান রঙের-বর্ণের মানুষের আনাগোনা, পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ বিনিময়, পরস্পরের সম্পর্কে কাছ থেকে জানা সবকিছুই কিন্তু সেই কথাই বলে। আজকের ফাইনালে তাই ফ্রান্স অথবা ক্রোয়েশিয়া যেই জিতুক জয় হবে কিন্তু ফুটবলেরই।
পরিসংখ্যানে ফাইনাল
আগের পাঁচ দেখায় একবারও ফ্রান্সকে হারাতে পারেনি ক্রোয়েশিয়া। বিশ্বকাপের ফাইনালেই প্রথমবারের মতো ফরাসিদের হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে চায় জøাটকো দালিচের দল। অন্যদিকে ক্রোয়াটদের বিপক্ষে সাফল্য ধরে রেখে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলার স্বপ্নে বিভোর দিদিয়ের দেশমের দরটি। যিনি নিজেই ছিলেন আগের বিশ্বকাপ জয়ী দলের গর্বিত সদস্য। আজ মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় মুখোমুখি হবে দুই দল। তার আগে দেখে নেয়া যাক এই রোমাঞ্চের খুঁটিনাটি-
তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছেছে ফ্রান্স। ১৯৯৮ সালে ঘরের মাঠে নিজেদের একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ের পর ২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপে ইতালির কাছে ফাইনালে হারে ফরাসিরা।
অন্যদিকে প্রথমবারের মতো বড় কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে পা রেখেছে ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯১ সালে যুগো¯øাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পর ছয়টি বিশ্বকাপের পাঁচটিতেই খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে ক্রোয়াটরা। ১৯৯৮ সালে বিশ্ব মঞ্চে নিজেদের অভিষেকেই শেষ চারে পা রেখেছিল তারা। ঐ আসরের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের কাছে সেমি-ফাইনালে হারের পর তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলায় জয় পায় নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। এটাই ছিল চলতি বিশ্বকাপের আগে ফুটবলের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতায় দেশটির সেরা ফল।
চলতি বিশ্বকাপে নিজেদের তিনটি নক আউট ম্যাচেই অতিরিক্ত সময় খেলতে হয়েছে ক্রোয়েশিয়াকে। শেষ ষোলোয় ডেনমার্ক ও কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক রাশিয়ার বিপক্ষে জয় আসে পেনাল্টি শুট আউটে। আর সেমি-ফাইনালে মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে মারিও মানজুকিচের অতিরিক্ত সময়ের গোলে ইংলিশদের পেছনে ফেলে প্রথমবারের মতো বিশ্ব মঞ্চের ফাইনালে জায়গা করে নেয় জ্লাতকো দালিচের দল।
নক আউট পর্বের তিন ম্যাচে ক্রোয়াটদের চেয়ে পুরো ৯০ মিনিট কম খেলেছে ফরাসিরা। দুই ম্যাচের পেনাল্টি শুট আউটের সময় বাদেই ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়দের তিন ম্যাচে মাঠে থাকতে হয়েছে ৩৬০ মিনিট। বিপরীতে ফাইনালে পৌঁছাতে তিন নক আউট ম্যাচে ফ্রান্সের খেলোয়াড়রা মাঠে ছিলেন মোট ২৭০ মিনিট।
দুই জয় ও এক ড্রয়ে ‘সি’ গ্রæপের সেরা হয়ে নক আউট পর্বে পা রাখে ফ্রান্স। শেষ ষোলোয় লাতিন পরাশক্তি আর্জেন্টিনাকে হারানোর পর কোয়ার্টার ও সেমি-ফাইনালে পেরোয় উরুগুয়ে ও বেলজিয়াম বাঁধা। প্রতিটি ম্যাচই শেষ হয়েছে ৯০ মিনিটে।
নক আউট পর্বের তিন ম্যাচে সাতটি গোল করেছে ফ্রান্স যা তাদের গ্রæপ পর্বের তিন ম্যাচের মোট গোলের (৩টি) দ্বিগুনের চেয়ে একটি বেশি।
ষ ফাইনালের আগে ক্রোয়াটদের চেয়ে একদিন বেশি বিশ্রাম পেয়েছে ফরাসিরা। মঙ্গলবার সেমি-ফাইনালে বেলজিয়ামকে ১-০ গোলে হারায় তারা। পরদিন ২-১ গোলে ইংল্যান্ডকে হারায় ক্রোয়েশিয়া।
দুই বছরের মধ্যে এ নিয়ে দুটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে পৌঁছালো ফ্রান্স। ২০১৬ সালে ঘরের মাঠে ইউরোর ফাইনালে উঠেছিল দিদিয়ের দেশমের দল। অবশ্য সেবার পর্তুগালের কাছে ১-০ গোলে হার মানতে হয় তাদের।
সমান দুটি করে গোল করে চলতি বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার সর্বোচ্চ গোলদাতা মিডফিল্ডার লুকা মড্রিচ, ফরোয়ার্ড মারিও মানজুকিচ ও ইভান পেরিসিচ। প্রতি ম্যাচে গড়ে দুটি করে গোল করেছে ক্রোয়েশিয়া। এখন পর্যন্ত ছয় ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে ১২ বার বল জড়িয়েছে তারা। বিপরীতে হজম করেছে পাঁচটি গোল।
ফাইনালে মাঠে নামলে ক্রোয়েশিয়ার হয়ে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ (১১টি) খেলার রেকর্ড ভাঙ্গবেন ৩২ বছর বয়সী মড্রিচ। টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পরিশ্রমী খেলোয়াড় ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক। ফিফার পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ৬৩ কিলোমিটার দৌড়েছেন এই মিডফিল্ডার।
চলতি আসরে এখন পর্যন্ত ফ্রান্সের হয়ে সবচেয়ে বেশি তিনটি করে গোল করেছেন ফরোয়ার্ড আঁতোয়ান গ্রিজমান ও কিলিয়ান এমবাপে। ছয় ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে দশ গোল দেওয়ার পাশপাশি ফ্রান্স হজম করেছে চারটি গোল।
সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত দুই দলের দেখা হয়েছে পাঁচবার। একবারও ফ্রান্সকে হারাতে পারেনি ক্রোয়েশিয়া। ফরাসিদের তিন জয়ের সঙ্গী দুটি ড্র।
ফ্রান্স একনজরে ক্রোয়েশিয়া
৪-২-৩-১ ফরমেশন ৪-৫-১
দিদিয়ের দেশম কোচ জøাটকো দালিচ
হুগো লরিস, গোলরক্ষক অধিনায়ক লুকা মড্রিচ, মিডফিল্ডার
কিলিয়ান এমবাপে, ফরোয়ার্ড সেরা তারকা ড্যানিয়েল সুবাসিচ, গোলরক্ষক
আঁতোয়ান গ্রিজমান, ফরোয়ার্ড স্পট লাইটে মারিও মানজুকিচ, ফরোয়ার্ড
বিশ্বকাপে
ফ্রান্সের সেরা সাফল্য
অভিষেক : ১৯৩০
১৯৩৪ : শেষ ষোল
১৯৩৮ : কো.ফাইনাল
১৯৫৮ : তৃতীয়স্থান
১৯৮২ : চতুর্থস্থান
১৯৮৬ : তৃতীয়স্থান
১৯৯৮ : চ্যাম্পিয়ন
২০০৬ : রানার্সআপ
২০১৪ : কো.ফাইনাল
ক্রোয়েশিয়ার অংশগ্রহণ
অভিষেক : ১৯৯৮
১৯৯৮ : সেমিফাইনাল
২০০২ : গ্রæপ পর্ব
২০০৬ : গ্রæপ পর্ব
২০১৪ : গ্রæপ পর্ব
২০১৮ : ?
মুখোমুখি
ম্যাচ ফ্রান্স ক্রোয়েশিয়া ড্র
৫ ২ ০ ৩
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।