Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নুসাইরিয়া একটি ভ্রান্ত সম্প্রদায়

কে. এস. সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১৩ জুলাই, ২০১৮, ১২:০১ এএম

‘আল কুফরু মিল্লাতুন ওয়াহহেদা’। অর্থাৎ কুফরের সকল শাখা-প্রশাখা এক। ইসলামের এই ঘোষণা মুসলিম সামাজের স্মরণে থাকলে তাদের উচিত ছিল আল্লাহর রুজ্জুকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করা (ওয়াতাছিসুনু বিহাবলিল্লাহে জামিয়ান)। আর পরিহার করা উচিত ছিল তোমরা বিভক্ত হয়ো না (ওয়ালা তাফাররাকু)। অথচ আমাদের মুসলিম সমাজে ‘তাফাররাকু’র অনুসরণই অধিক। যার ফলে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে অসংখ্য দল, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে। আহলে সুন্নত আল জামাতের হক্কানী ওলামায়েকেরাম এগুলোর মধ্যে বিভ্রান্ত ও ‘গোমরাহ’ দল ও সম্প্রদায়গুলোকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। ধর্মের নামে তাদের গর্হিত কার্যকলাপ মুসলমানদের মধ্যে যেমন বিবাদ ও বিরোধের পর্বত সৃষ্টি করে চলেছে, তেমনি ইসলামেরও নানাভাবে ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। ‘বিভ্রান্ত’ সম্প্রদায়গুলোর আচার-আচরণ মুসলিম ঐক্যে যে ফাটল ধরাচ্ছে তার সমাধান হয়তো কঠিন কিন্তু এগুলোর স্বরূপ জানা থাকা প্রয়োজন। বহু বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের বিবরণ ইসলামের ইতিহাসে রয়েছে। এখানে আমরা এমন একটি বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের পরিচিত তুলে ধরতে চাই যারা আজও আমাদের আশেপাশে বিচরণ করছে এবং তাদের অপতৎপরতা অমুসলিম খোদাদ্রোহীদের অপতৎপরতার চেয়ে কম নয়। মুসলিম ঐক্যকে বিনষ্ট করার জন্য এই বিভ্রান্ত সম্প্রদায়গুলো সর্বদায় তৎপর।
‘নুসাইরিয়া’ সম্প্রদায়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এই যে, এটি সীমা লংঘনকারী একটি শিয়া সম্প্রদায়। হজরত আলী (রা.) কে এরা ‘ইলাহ’ বা খোদা বলে (নাউজুবিল্লাহ) দাবি করে থাকে। আবু শোয়াইব মোহাম্মদ বিন নুসাইর আল-নুসাইরীর নামে এই সম্প্রদায় পরিচিত। আনুমানিক হিজরী ২৭০ সালের অর্থাৎ হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর লোক এই নুসাইর। শিয়া সম্প্রদায়ের দ্বাদশ ইমামের তিনজনেরই ইনি সমসাময়িক ছিলেন। এই তিনজন ইমাম হচ্ছেন, আলী আল হাদী (২১৩-২৫৪ হিজরী), হাসান আল-আসকারী (২৩০-২৬০ হিজরী) এবং মোহাম্মদ আল মাহদী (২৫৫- হিজরী)। উত্তর সিরিয়ায় ‘জাবলুল আলাভী’ নামে যে পর্বত আছে, সেখানেই নুসাইরী সম্প্রদায়ের লোকেরা বসবাস করে। এই স্থানে হেমস, হামা ও লহর নামক প্রসিদ্ধ নগরী অবস্থিত।
ইবনে নুসাইর ইমাম হাসান আসকারী (রহ.) এর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজেকে ‘বাবুদ্দার’ বলে মনে করতেন এবং হাসান আসকারী (রহ.)-এর পরবর্তী সময়ে নিজেকে ‘হুজ্জাত’ বা দলিল রূপে গণ্য করতে থাকেন। শিয়াদের একটি দল তার অনুসারী হয়ে নিজেদের ‘নুসাইরিয়া’ নামে অভিহিত করতে থাকে। কিন্তু ইবনে নুসাইর এই বিষয়কে যথেষ্ট মনে না করে নবুয়াত বা রেসালতের মিথ্যা দাবি করতে লাগলেন এবং ইমামদের সম্পর্কে এতই বাড়াবাড়ি করতে থাকেন যে, শেষ পর্যন্ত ইমামদের মধ্যেও ‘উলুহিয়াত’ বা প্রভুত্বের শক্তি আছে বলে প্রচার করতে লাগলেন। ইমাম হাসান আসকারীর জীবদ্দশায় তার নিকট ইবনে নুসাইরির এই মিথ্যা দাবি ও ভ্রান্ত বিশ^াসের খবর পৌঁছালে তিনি নিজেকে এটা থেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করেন এবং ইবনে নুসাইরিকে অভিশাপও দেন এবং তার অনুসারীদের এই ফেতনা সম্পর্কে সতর্ক করে দেন।
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নুসাইরীদের অধিকাংশই বর্তমানে সিরিয়ার উত্তর ও দক্ষিণ এলাকায় বসবাস করে। দক্ষিণ তুরস্ককেও এদের কিছু লোক বাস করে। উত্তর লেবানন, পারস্য (বর্তমান ইরান), রুশীয় তুকির্স্তান এবং কুর্দিস্তানেও ‘নুসাইরিয়া’ সম্প্রদায়ের লোকেদের দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন স্থানে তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ঐতিহাসিক নাম নুসাইরেয়া হলেও ইরান, তুর্কিস্তান ও কুর্দিস্তানে এদের স্থানীয়ভাবেও কিছু নাম প্রচলিত রয়েছে। যেমন- পশ্চিম আনাদুলে এরা ‘তাখতাজিয়া’ বা ‘হাত্তাবুন’ নামে খ্যাত। ইরান, তুর্কিস্তান ও কুর্দিস্তানে এরা ‘আল আলী-ইলাহিয়া’ নামে পরিচিত। সিরিয়ায় ফরাসী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও প্রথম বিশ^ যুদ্ধের পর ফরাসীরা তাদের নামের সাথে ‘আলাভী’ নামটি যোগ করে হজরত আলী (রা.)কে ‘প্রভু’ বলে ঘোষণা করে।
ইবনে নুসাইর পারস্যবাসী ছিলেন। বনি নুসাইর বংশের সাথে জড়িত ছিলেন বলে তাঁকে নুসাইরীও বলা হয়। বসরা-কুফায় কিছুদিন বসবাস করেন বলে তিনি বসরী-কুফী নামেও পরিচিত। এই ব্যক্তির কতগুলো ভ্রান্ত ধর্মমত ও বিশ^াস প্রচলিত, যেমন-
১. আলী ইবনে আবুতালিব ইলাহ বা প্রভু কিংবা উলুহিয়াত (প্রভুত্ব) তার মধ্যে প্রবেশ করেছে। তিনি (আলী) মেঘে অবস্থান করছেন, বজ্র তার শব্দ ও বিদ্যুৎ তার হাসি। এই জন্য নুসাইরীরা মেঘের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। তারা দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ উত্তরাঞ্চলীয়, যাদের নিবাস লাজেকিয়া ও কালাদিয়া এলাকায় এবং অপর গোষ্ঠী বাস করে পর্বতমালায়। উত্তরাঞ্চলীয়রা বলে থাকে যে, আলী চন্দ্রের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন। আর কালাদিয়াদের দাবি হলো, তিনি সূর্যের মধ্যে মিশে রয়েছেন। সালমান ফারসী (বিশিষ্ট সাহাবী) আলীর রসূল বা প্রেরিত পুরুষ।
২. ‘নুসাইরিয়া’ সম্প্রদায়ের রহস্য বাক্য ‘কলেমায়ে সিরর’ হচ্ছে তিনটি অক্ষর এবং সেগুলো হলো: আইন (আলী), মীম (মোহাম্মদ), সীন (সালমান ফারসী)।
৩. তারা নিজেদের কথা-বার্তা গোপন রাখে। যদি কেউ প্রকাশ করে সে ভুল করবে। তারা মনে করে যে, তারাই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাদের কথা-বার্তা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিতদের কথাবার্তা। কেউ তা অস্বীকার করলে সে ভুল করল।
৪. মদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা তাদের বিশ^াসের অন্তর্ভুক্ত। তারা মনে করে যে, ‘মদ নূর হতে নির্গত’। এই জন্য তারা আঙ্গুর বৃক্ষকে মহৎ বলে গণ্য করে। কেননা মদের মূল হচ্ছে এই বৃক্ষ। এমনকি আঙ্গুর বৃক্ষের উৎপাটনকেও বড় পাপ বলে মনে করে।
৫. হজরত আলী (রা.)-এর হত্যাকারী ইবনে মুলজেমকে তারা ভালবাসে, সে হত্যার মাধ্যমে আলীকে দুনিয়া হতে মুক্ত করে রহস্যময় জগতে প্রেরণ করেছে। আর যারা ইবনে মুলজেমকে অভিসম্পাত করে তারা ভুল করছে।
৬. তাদের ধর্ম বিশ^াসগুলোর মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে, হজরত আলী (রা.) প্রধান ‘খোদা’। তাই তারা আলীর নিকটই সব কিছু প্রার্থনা করে থাকে।
৭. আলী ইবনে আবুতালিব (রা.)কে তারা ‘আল-আলী আল আজীম’ (আলী মহান) উপাধিতে ভ‚ষিত করে থাকে। অথচ এই দুইটি সিফত বা বিশেষণ মহান আল্লাহর জন্য নির্ধারিত।
‘নুসাইরিয়া’ সম্প্রদায়ের এই ধরনের আরও বহু মতবাদের কথা জানা যায়। এখানে সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয় বলে সংক্ষিপ্তভাবে যেগুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো ‘নুসাইরিয়া’ সংক্রান্ত রচিত বিভিন্ন আরবী গ্রন্থ হতে সংকলিত।
এই সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক মতবাদও মারাত্মক। সন্ত্রাস, বিদ্রোহ ইত্যাদিতে তাদের কোন তুলনা হয় না। পূর্ব যুগের মুসলিম চিন্তাবিদ ও পÐিতগণ এই সম্প্রদায়কে বাতিল বলে আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি শিয়া সম্প্রদায়ের নিকটও ‘নুসাইরিয়া’দের বাড়াবাড়ি সমর্থনযোগ্য নয় বলে জানা যায়। তারা শিয়া বলে যে দাবি করে থাকে, শিয়াদের নিকট সেই দাবিও গ্রহণযোগ্য নয়। বস্তুত ‘নুসাইরিয়া’ বলে নিজেদের পদস্খলনের মারাত্মক রূপ কিছুটা লঘু করার জন্য পরবর্তীকালে শিয়া বলে দাবি করতে থাকে। এই সম্প্রদায়ের বহু বিশ^াস ও মতবাদ পারস্যের অগ্নিপূজা ও প্রতিমা পূজার অন্ধ অনুকরণ হতে জন্মলাভ করেছে। কিছু কিছু বিশ^াস ইহুদি-খ্রিস্টানদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
মোটকথা, ‘নুসাইরিয়া’ সম্প্রদায় ইসলাম বিরোধী ও ভ্রান্ত মতবাদের জন্য সুপরিচিত। যেখানে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে, সেখানে কী ধরনের পরিবেশ বিদ্যমান থাকতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। ছদ্মবেশী রূপে এদের অনুসারীরা নানা স্থানে অবস্থান করতে পারে এবং নানা অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে তারা ইন্ধন যোগাতে পারে। সেদিকে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। কেননা ইসলামের বিরুদ্ধে কুফরের সকল শাখা-প্রশাখা যেখানে ঐক্যবদ্ধ, সেখানে মুসলমানদের বিভ্রান্ত সম্প্রদাগুলোকে ওরা নিজেদের স্বার্থে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সুযোগ নেবে, এটাই স্বাভাবিক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন