Inqilab Logo

শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সেকুলার ভারতের হরিয়ানায় জুমার নামাজে বাধা এবং আফ্রিকায় ইমাম সাহেবের বদৌলতে খ্রিষ্টানদের প্রাণরক্ষা

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৫ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৩ এএম | আপডেট : ৭:৪৪ পিএম, ৪ জুলাই, ২০১৮

সর্বশেষ বিশ্ব-পরিস্থিতির দিকে যদি দৃষ্টি দেখা যায় তাহলে যে সত্যটি বেরিয়ে আসে তাহলো বিশ্বের অধিকাংশ স্থানে মুসলমানরা নিগৃহিত হচ্ছে যদিও মুসলমানরা অমুসলমানদের প্রতি উদারতা প্রদর্শনে কখনো কার্পণ্য করছে না। মুসলমানদের এ আচরণের কারণ ইসলাম আদপেই মানবীয় উদারতায় বিশ্বাসী এবং অমুসলমানদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন ইসলামী আদর্শের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। কয়েক বছর আগের কথা। প্রতিবেশী দেশ ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা চলছিল। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কতিপয় নাগরিক ঢাকা সফরে এসেছিলেন মুসলিম-অধ্যুষিত বাংলাদেশে ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া দেখতে। তার আশংকা ছিল ভারতের মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে নিশ্চয়তা হিন্দু-বিরোধী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকবে। তাকে বিস্মিত হতে হয়েছিল এদেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজমান দেখে।
কয়েক বছর আগের দৃষ্টান্ত বাদ দিয়ে সর্বশেষ বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে তাকালেও আমরা একই দৃশ্য দেখতে পাই। গত সোমবার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসাবে পরিচিত সেকুলার ভারতে জুমার নামাজে বাধা দেওয়া হয়েছে। গত সোমবার দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় ষষ্ঠ পৃষ্ঠায় এ সম্পর্কিত প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রধান শিরোনাম ছিল: প্রকাশ্যে জুমার নামাজে বাধা হরিয়ানায়। উপ শিরোনামে বলা হয়: নামাজের জায়গা ভাড়াদানকারীকে গ্রামছাড়া করার হুমকি।
ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার বরাত দিয়ে দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের গুরু গাঁওয়ে একটি খালি জায়গায় প্রকাশ্যে জুমার নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়ায় আবারও বিষয়টি উঠে এসেছে। মুসলিম কমিউনিটির প্রতিনিধিরা জানিয়েছে, নির্দিষ্ট স্থানে নামাজে বাধা দেবার পর তারা একটি আলাদা জায়গা ভাড়া করেছিলেন, কিন্তু সেখানেও তাদের নামাজ পড়তে দেয়া হয়নি। নেহরু যুব সংস্থা কল্যাণ সোসাইটি চ্যারিটেবল সোসাইটির স্থানীয় প্রধান ওয়াজিদ খান বলেছেন, ফৌজদারী মেট্রো স্টেশনের কাছে জুমার নামাজ আদায়ের জন্য আমাদের জায়গা দেয়া হয়। সেখানে আপত্তি উঠায় আমরা হারিয়ানা নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন আরেকটি পার্কে নামাজ পড়তে যাই, কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা আপত্তি জানায়। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত আমরা নানুপুর গ্রামে একটি জায়গা ভাড়া নিতে সক্ষম হই। কিন্তু এ সপ্তাহে তারা জানিয়েছে, আমরা এখানেও আর নামাজ পড়তে পারবো না।
ওয়াজিদ খান বলেন, যে ব্যক্তি আমাদের জায়গা ভাড়া দিয়েছেন, তিনি বলেছেন, গ্রামের মানুষ জন তাকে সতর্ক করে দিয়েছে। তারা এই ব্যক্তিকে বলেছে, তারা আমাদের জায়গা বন্ধ করে না দেওয়া হলে তাকে গ্রাম ছাড়তে হবে। তাই তিনি আমাদের এখন অন্যত্র জুমার নামাজ আদায় করতে বলেছেন। ডিএসএফ ফেজফ্রির একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন যে, তারা একটি অভিযোগ পেয়েছে। এএসআই নরেশ কুমার বলেন, আমরা অভিযোগ পেয়েছি যে, নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে নামাজে আদায় হচ্ছে। এদিকে মুসলিম কমিউনিটির কয়েকজন সদস্য অভিযোগ করেছেন, শুক্রবার সেক্টর ৩৪-এ একদল মুসল্লি নামাজ পড়তে গেলে তাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে পুলিশ।
এতো গেল সেকুলার ভারতে জুমার নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়ার কথা। অন্যদিকে অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গির এক অনন্য দৃষ্টান্ত জানতে পারা গেছে, আফ্রিকার এক মুসলিম ধর্ম-নেতা তথা ইমাম সাহেবের দৃষ্টান্ত থেকে। দৈনিক ইনকিলাব-এ ঐ একই দিন (গত সোমবার) প্রকাশিত দুই কলম ব্যাপী এ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল : “ইমামের চেষ্টায় প্রাণ বাঁচল খৃস্টানদের”। প্রকাশিত প্রতিবেদন বলা হয় নাইজেরিয়ার এক গ্রামে একজন ইমামের চেষ্টায় প্রাণ বাঁচল পাশের গ্রামের খ্রীস্টানদের। লুটেরাদের ভয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য গ্রাম ছেড়ে পালাতে থাকা খ্রীস্টানদের নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন এই ইমাম। পালিয়ে আসা গ্রামের খ্রীস্টান অধিবাসীদের উপর হামলা চালাতে হামলাকারী দলটি পাশের এই মুসলমান-অধ্যুষিত গ্রামে গিয়েও উপস্থিত হয়েছিল।
সংবাদ মাধ্যম বিবিসি লিখেছে, হামলাকারীরা মূলত যাযাবর গোষ্ঠীর সদস্য। অন্যদিকে হামলার শিকার হওয়া ব্যক্তিরা পেশায় কৃষক, তারা মূলত খ্রিস্টান। আক্রান্ত খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্যরা জানান, স্থানীয় সময় শনিবার দুপুর ৩টার দিকে তাদের গ্রামে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা সংখ্যায় প্রায় ৩০০ হবে। তাদের সবার কাছে ছিল অস্ত্র। এলোপাথারি গুলির পাশাপাশি ঘরে অগ্নিসংযোগও করে হামলাকারীরা। গুলির মুখে গ্রামবাসীরা পালাতে বাধ্য হয়। এমন কি নিরাপত্তা চৌকি পার হয়ে যাওয়ার পরও গুলি বন্ধ হয়নি। হামলায় পালানো নিরাপত্তা রক্ষীরাও চৌকি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। প্রায় ঘণ্টাখানেকের পথ পাড়ি দিয়ে তারা পৌঁছান এই ইমামের গ্রামে। তিনি আশ্রয় প্রার্থীদের নারী, পুরুষ ও শিশু-সহ ২৬২ জন নিজের বাড়ী ও মসজিদে লুকিয়ে রাখেন।
তিনি বলেন, আমি প্রথমে নারীদের আমার বাড়িতে লুকিয়ে রাখি। তারপর পুরুষদের নিয়ে যাই মসজিদে। হামলাকারীরা খ্রিস্টান কৃষকদের খোঁজে উপস্থিত হয় ইমাম সাহেবের গ্রামে এবং তাকে ঐ মসজিদ থেকে খৃস্টান কৃষকদের বের করে দিতে বলে। কৃষকদের বের করে দিতে অস্বীকৃতি জানালে মসজিদে অগ্নিসংযোগের হুমকি দেয়। ইমাম সাহেব এক পর্যায়ে মসজিদের প্রবেশ পথে শুয়ে পড়েন। এবং হামলাকারীদের অনেক অনুনয় বিনয় করে চলে যেতে অনুরোধ জানান। শেষ পর্যন্ত হামলাকারীরা গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার পথে তারা নিকটবর্তী দুইটি গীর্জায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে যায়।
বিবিসি বলেছে, এই গ্রামগুলো যে এলাকায় অবস্থিত, সেখানে ধর্মীয় উত্তেজনা একটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাইজেরিয়ায় শুধু ২০১৮ সালেই শত শত মানুষ মারা গেছে পশু পালনের তৃণভূমির দখল নিশ্চিত করতে ও পশু ছিনিয়ে নিতে গিয়ে। এই যেখানে নাইজেরিয়ার বাস্তব পরিস্থিতি, সেখানে ইমাম সাহেবের দু:সাহসিক ভূমিকা না থাকলে অসংখ্য খৃষ্টান যে নির্মমভাবে প্রাণ হারাত সে কথা বলাই বাহুল্য।
এই দু:সাহস ইমাম সাহেব পেলেন কোথা থেকে? নি:সন্দেহে ইসলামের উদার আদর্শ থেকে। পবিত্র কোরআনুল কারিমে বলা হয়েছে: ধর্মে জবরদস্তি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সে নিরিখে সম্প্রদায়কেন্দ্রিক বৈষম্য-চেতনাও ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী। অন্য ধর্মাবলম্বীরা মুসলমানদের প্রতি শত অবিচার করলেও ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি কোন অমুসলমানের প্রতি অবিচার করতে পারে না, কারণ এটা তার ধর্মীয় আদর্শে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ। প্রতিবেশী দেশের কোন না কোন রাজ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় না এমন বছর প্রায় যায় না বললেই চলে। তা সত্তে¡ও বাংলাদেশ যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম আদর্শস্থানীয় রাষ্ট্র হিসাবে সুনাম অর্জন করে চলতে পারছে তার কারণ এদেশের মানুষ সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও সার্বজনীন শান্তির আদর্শ ইসলামে বিশ্বাসী।
ইসলামের এ মহান আদর্শ আমাদের কোন আকস্মিক অবিষ্কার নয়। এ আদর্শ আমরা পেয়েছি শেষ নবী (সা.) এবং তাঁর চার খলিফার আমলের খিলাফতে রাশেদার রেখে যাওয়া ঐতিহ্য থেকে। এ প্রসঙ্গে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) পর খিলাফত-আমলের একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। তাঁর খিলাফতকালে মিসরের গভর্নর-নন্দন এক অমুসলিম বালককে অন্যায়ভাবে আঘাত করলে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিচার প্রার্থী হয় অন্যায়ভাবে আঘাত-প্রাপ্ত বালকের পরিবার। কিন্তু তার যথাযোগ্য বিচার না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত খলিফার কাছে যায় বিচারের আবেদন। খলিফা সকল পক্ষের বক্তব্য শুনে সংখ্যালঘু বালকের প্রতি অন্যায় আঘাতের উপযুক্ত না বিচার না হওয়ায় তিনি সংখ্যালঘু বালককে বলেন, তোমাকে যেভাবে আঘাত করা হয়েছে, তুমি ঠিক সেভাবে আঘাতকারীকে আঘাত করো। এবং মিসরের গভর্নরকে বলেন : মুনজু কাম তাআব্বাদতুমুন্নাছা ওয়া কাদ অলাদাতহুম উম্মুহুম আহারারান? যার অর্থ হলো তোমরা মানুষকে কতদিন ধরে গোলাম ভাবা শুরু করেছ? অথচ তাদের মায়েরা তাদের স্বাধীনভাবে জন্ম দিয়েছে।
খিলাফতের রাশেদার সময়কালের এ নীতি যদি মুসলিম বিশ্বে চালু থাকতো তাহলে মুসলিম উম্মাহ সারা বিশ্বে নিগৃহীত হতো না এটা নি:সন্দেহে দাবী করা যায়।



 

Show all comments
  • Helal Masud ৫ জুলাই, ২০১৮, ৪:১৩ এএম says : 0
    ata Islam er sikkha
    Total Reply(0) Reply
  • সোবহান ৫ জুলাই, ২০১৮, ৪:১৪ এএম says : 0
    মোহাম্মদ আবদুল গফুর স্যারকে এই লেখাটির জন্য ধন্যবাদ জানচ্ছি।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নামাজ


আরও
আরও পড়ুন