Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি

| প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ‘জাতীয় মজুরি ও উৎপাদনশীলতা কমিশন-২০১৫’এর সুপারিশ অনুসারে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দ্বিগুন বাড়ানোর প্রস্তাব গত সোমবার মন্ত্রী পরিষদের নিয়মিত সভায় অনুমোদিত হয়েছে। এই প্রস্তাব অনুসারে শ্রমিকদের ১৬টি গ্রেডে ভাগ করে গ্রেড অনুসারে সর্বোচ্চ ১১,২০০ টাকা এবং সর্বনি¤œ ৮,৩০০ বেতন নির্ধারন করা হয়, যা বর্তমান বেতন কাঠামোর প্রায় দ্বিগুণ। গত একদশকে একাধিকবার সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানসমুহের শ্রমিকদের বেতন বাড়েনি। জাতীয় মজুরী ও উৎপাদনশীলতা কমিশন-২০১৫ এর রিপোর্ট অনুসারে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের এই বেতন বৃদ্ধির উদ্যোগ নি:সন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে সরকারী কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কোন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে রফতানীমুখী শিল্প ও সার্ভিসখাত নির্ভর অর্থনীতিতে পরিনত হলেও সরকারী খাতের শিল্প সেক্টরে এক প্রকার বিপর্যয় দেখা দেয়। নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার কারণে রাষ্ট্রায়াত্ত শত শত শিল্প কারখানায় উৎপাদনশীলতায় ধস নামার সাথে সাথে এ খাতে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার লোকসান গুণতে হয়। লোকাসানের মুখে সরকারী ভর্তুকির বোঝা লাঘব করতে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ’র পরামর্শে সরকারী শিল্প কারখানাগুলোকে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে লাভজনক সরকারী শিল্পকারখানাও ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়ার পর তা বন্ধ হয়ে গেছে।
সাড়ে চার শতাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহদ শিল্প কারখানার মধ্যে বর্তমানে মাত্র ৬০/৬২টি কারখানা কোনমতে টিকে আছে। পাট, চিনি, বস্ত্র ও বিদ্যুতখাতের পুরনো কারখানাগুলোর গড় বয়স ৬০ বছরের বেশী। একটি বৃহৎ শিল্প কারখানার স্থাপিত উৎপাদন সক্ষমতা পঁচিশ-তিরিশ বছরের বেশী বজায় থাকেনা। আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশীরভাগই পাকিস্তান আমলের, নর্থবাংলা চিনিকল, কেরু অ্যান্ড কোম্পানীর মত কিছু সংখ্যক কারখানা বৃটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠার পর শতাব্দী পেরিয়ে আসা কোন কোন কারখানা জোড়াতালি দিয়ে কোন রকমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও এসব কারখানায় বছরে শত শত কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। কারখানাগুলোর আধুনিকায়ণের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদ্যমান দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা বন্ধ করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে এসব কারখানাকে লোকসান থেকে লাভজনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা অসম্ভব নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে বর্তমানে মাত্র ৬টি সেক্টর সক্রিয় রয়েছে । এগুলো হচ্ছে, বিসিআইসি, বিএসএফআইসি, বিএসইসি, বিজেএমসি, বিটিএমসি এবং বিএফসিআইসি। উৎপাদনশীলতায় ধস ও লোকসানের মুখে পুরনো কারখানাগুলো বন্ধ করে দেয়া হলেও নতুন পরিকল্পনার আওতায় নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ ছিল খুবই অপ্রতুল। স্বাধীনতার পর শত শত রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও নতুন কারখানা স্থাপিত হয়েছে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি। অথচ এ সময়ে বেসরকারী খাতে শিল্পবিনিয়োগে এক ধরনের বিপ্লব সূচিত হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিটি সেক্টরেই অনিয়ম, দুর্নীতি অব্যবস্থাপনার কারণে বছরে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত কম সম্পদ ও সীমিত অবকাঠামো নিয়ে গড়ে ওঠা বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ধরে লোকসান দেয়ার কারণগুলো নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অজানা নয়। উপরন্তু জনগনের রাজস্ব থেকে এসব কারখানার জন্য শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি গুণতে হচ্ছে। এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি কারখানার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির উদ্যোগ ইতিবাচক হলেও অব্যবস্থাপনা ও লোকসানের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে তা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকারী পাটকল, বস্ত্রকল, সার কারখানা, বিদ্যুতকেন্দ্র, চিনিকল, রেলওয়ে ওয়ার্কশপসহ রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের কারখানাগুলোর দৈন্যদশা লাঘব করে লাভজনক করার উদ্যোগ নেয়া হলে এসব খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বেশী লাভবান হবে এসব সেক্টর ও কারখানায় কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীরা। কর্তৃপক্ষীয় নজরদারী ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থার বদলে আধুনিক লাগসই প্রযুক্তি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সেক্টরকে আরো বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বান্ধব ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্য লাভজনক হিসেবে গড়ে তোলার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারী শিল্প সেক্টরের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে মজুরি বৈষম্য নিরসন করাও সরকারের দায়িত্ব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শ্রমিক

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৮ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন