পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশকে অপার সম্ভাবনার দেশ হিসেবেই দেখছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। তিন দশক আগে তারা চীনের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার মূল্যায়ন করে সে দেশের শিল্পখাতে বিনিয়োগে এগিয়ে যায়। পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারা চীনের ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আরও কিছু দেশের দিকে নজর রাখছে। গ্রহণ করেছে চায়না প্লাস ওয়ান কৌশল। চীনের সঙ্গে আরও একটি দেশকে বেছে নেওয়ার এই কৌশলে বাংলাদেশ রয়েছে অগ্রাধিকারের তালিকায়।
চীনে গত তিন দশকে শ্রমের মূল্য বেড়েছে বিপুলভাবে। বাংলাদেশে শ্রমের দাম এখনো সস্তা হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে চীনের বিকল্প হিসেবে ভাবছে। ভৌগোলিক দিক থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগসূত্র বাংলাদেশ। এদেশের একদিকে বিশাল ভারত অন্যদিকে মিয়ানমার, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশের এই সম্ভাবনার বিষয়ে দুই বছর আগে প্রণীত জাইকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সস্তা শ্রমের পাশাপাশি দেশটিতে শ্রমিকও সহজলভ্য। ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার তুলনায় জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বেশি। ইংরেজি ভাষাতে সহজে যোগাযোগ করাও যায় এ দেশে। এ ছাড়া স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধি, গার্মেন্ট এবং চামড়া শিল্পে অগ্রগতি, মধ্যম আয়ের ভোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি, আকর্ষণীয় বাজার, পানির সহজলভ্যতা, কম খরচে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের সুযোগ থাকায় পশ্চিমা উদ্যোক্তারা বাংলাদেশকে বিদেশি বিনিয়োগের পছন্দের তালিকায় রেখেছে।
তবে দুই বছর আগের ওই প্রতিবেদনে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতাও তুলে ধরা হয়। যেগুলো হলো, রাজনৈতিক ও শ্রম খাতে অস্থিরতা, অনুন্নত অবকাঠামো, বিনিয়োগ সংক্রান্ত আইন এবং নীতিতে অস্পষ্টতা, অদক্ষ জনশক্তি, ভূমির স্বল্পতা, বিদ্যুৎ স্বল্পতা এবং ভিসা প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা। বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে মনে রেখে আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এ দেশটি অচিরেই দক্ষিণ এশিয়ার একটি উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হবে। চীন, জাপান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে মুখিয়ে আছেন। তবে সম্ভাবনাই শেষ কথা নয়। তা কাজে লাগাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে আমলাতান্ত্রিকতার ইতি ঘটাতে হবে।
সত্তর দশকের তলাবিহীন ঝুড়ি, নব্বই দশকের বিশ্ব পরিমন্ডলে তুলনামূলক অচেনা বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাপী এক বিস্ময়ের নাম। উন্নয়ন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা মানুষদের কপালে ভাঁজ ফেলে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও সম্ভাবনার দিগন্তে সাফল্যের পতাকা উড়িয়ে দেশ অব্যাগত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিএমআই রিসার্চের মতেই আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন চালিকাশক্তি। ২০২৫ সালের মধ্যে এই ১০টি দেশ সম্মিলিতভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ৪ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন অর্থাৎ চার লাখ তিন হাজার কোটি ডলার যোগ করবে, যা বিনিয়োগকারীদের বড় সুযোগ এনে দেবে। উল্লিখিত অর্থ জাপানের বর্তমান অর্থনীতির সমান।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার যে সম্ভাবনা বাংলাদেশের সামনে হাতছানি দিচ্ছে তাকে কাজে লাগাতে হলে রাজনৈতিক সংঘাতের অবসান ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে সম্ভাবনাময় দেশের বদলে ব্যর্থ রাষ্ট্রের অভিশাপ যে জাতির জন্য অনিবার্য হয়ে উঠবে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এ বিপদ ঠেকাতে পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে প্রয়াস চালাতে হবে। দেশে শিক্ষিতের হার শতকরা ৭০ শতাংশের মতো হলেও মোট জনশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বেকার। যাদের অধিকাংশই শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত, কিংবা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। প্রতিবছর বাংলাদেশে গড়ে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে লক্ষাধিক, যাদের বেশিরভাগের কর্মসংস্থান হয় না। ফলে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও। পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এমনিতেই বিশ্ব মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রেক্ষাপটে সারাবিশ্বেই কর্মসংস্থান সঙ্কুুচিত হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান যে হারে বাড়ছিল তা হ্রাস পেয়েছে নানা কারণে। তাই অনেকে শ্রম বেচতে বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা অস্থিরতার কুফল যেসব দেশ ভোগ করছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। সারাবিশ্বে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশী নাগরিক কর্মসংস্থানের কারণে বসবাস করছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায়ই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। তাই বলা যায়, সার্বিক পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়। পরিস্থিতির অবনতি রোধে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ কোনটাই মূলত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীকে সম্পদ নয়, রাষ্ট্রের বোঝা হিসেবেই ভাবা হচ্ছে।
এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সঠিক হবে না। তাই অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে সরকারের দেয়া সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেদের সম্পদ কাজে লাগিয়ে দেশেই কর্মসংস্থানের পথ খুঁজতে হবে। সময়টা তথ্যপ্রযুক্তির। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে এদেশের যুবকরা। অনেকেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজের ক্ষেত্র গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। ফলে সমাজে সম্ভাবনার ক্ষেত্র আরও স¤প্রসারিত হচ্ছে। আসলে যুব সমাজই হচ্ছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত আধুনিক, অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রধান চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের ভবিষ্যত গড়তে দেশের এই বিশাল শক্তির উপযুক্ত ব্যবহার হওয়া দরকার। এরাই নিজেদের মেধা ও মনন শক্তি ব্যবহার করে নির্ধারণ করবে দেশের আগামী দিনের চলার পথ।
উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদদের মতে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে তরুণ জনগোষ্ঠীকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে। বাংলাদেশের সামনেও সোনালি ভবিষ্যৎ হাতছানি দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফল হবে কিনা তা নির্ভর করছে সৃষ্ট সুযোগ কতটা কাজে লাগানো যাবে তার ওপর। বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে সমস্যা হলো জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ বেকার। যুব জনগোষ্ঠীর একটি অংশ অভিভাবকদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। যুবসমাজের কর্মসংস্থানের যথাযথ পদক্ষেপ যেমন দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে তেমন এ ক্ষেত্রের ব্যর্থতা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশের সোনালি ভবিষ্যতের স্বার্থেই কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গতি আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সভাপতি বাংলাদেশ ম্যাচ ম্যানুফ্যাকচারার এসোসিয়েশন, সদস্য এফবিসিসিআই, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।