Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রাজধানীর যানজটে আর্থিক ক্ষতি

| প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০১৮, ১২:১১ এএম

রাজধানী বসবাসের অনুপযোগী অনেক আগেই হয়েছে। অপ্রতুল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, রাস্তাঘাটে চলাচলের সমস্যা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সমস্যা আর নিত্যদিনের সঙ্গী যানজট তো আছেই। এক যানজটই ঢাকা শহরকে স্থবির করে রেখেছে যুগের পর যুগ। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। নগরবিদরা অনেক পরামর্শ ও পরিকল্পনা দিয়েছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও পরিকল্পনা করে, তবে তা বাস্তবে আলোর মুখ দেখে না। ফলে যানজট দিনের পর দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। যানজটে দিনে বা বছরে কত ক্ষতি হয়, তারও অনেক পরিসংখ্যান বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থার মাধ্যমে প্রায় নিয়মিতই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গতকাল দৈনিক ইনকিলাব এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবির সর্বশেষ প্রতিবেদন উল্লেখ করে যানজটে ক্ষতির পরিমাণ প্রকাশ করেছে। এডিবির কান্ট্রি ডায়াগনস্টিক স্টাডিতে বলা হয়েছে, ঢাকায় যানজটে প্রতি বছর জিডিপির ৩ শতাংশ ক্ষতি হয়। যার আর্থিক মূল্য ৫২ হাজার কোটি টাকা। এর আগে কোনো কোনো সংস্থা বলেছে, যানজটে প্রতিদিন মানুষের ৮০ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হয় এবং ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এমনও আরও ক্ষতির পরিমাণ বিভিন্ন সংস্থা উল্লেখ করেছে। মোদ্দা কথা, যানজটে দেশের অর্থনীতির যে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যানজট ও এর ক্ষতি থেকে কবে মুক্তি পাওয়া যাবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

ঢাকা শহরের মতো শহর বিশ্বে খুব কম দেশেই আছে। যে শহরের চারপাশে নদী থাকে এবং ভেতর দিয়ে খাল বয়ে যায়, সে শহরকে অনেকে স্বপ্নের শহর মনে করেন। ঢাকার এর সবকিছুই রয়েছে। তবে চারপাশের নদীগুলো দখল-দূষণ এবং শহরের অভ্যন্তরে যে ৪৬টি খাল ছিল তা দখল ও ভরাট করে নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছে। কারো বোঝার উপায় নেই যে সড়কটির উপর দিয়ে যানবাহন চলছে, তা এক সময় খাল ছিল। একটি স্বপ্নের মতো শহরকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যে ধরনের ক্ষতি করা দরকার সবই নির্বাধে করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এর উপর রয়েছে অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ। রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কারে পরিকল্পনার প্রচÐ অভাব রয়েছে। যতটুকু রাস্তা দিয়ে যত যানবাহন চলাচল করা সম্ভব, দেখা যাচ্ছে তার তিন-চার গুণ যানবাহন চলছে। সড়কগুলোতে তিল ধারনের ঠাঁই নেই। এই ঠাঁই না থাকার কারণ, সড়কের স্বল্পতা। সাধারণত একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা আবশ্যক। ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। তার উপর প্রতিদিন প্রায় আড়াইশ’ নতুন গাড়ি এই সড়কেই নামছে। সড়ক নেই, অথচ প্রতিদিন শত শত নতুন গাড়ির অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। একবারও কেউ ভাবছে না কি হবে। এত গাড়ি চলাচল করবে কোথায়? যানজট নিরসনে সরকার গত কয়েক বছরে ৯টি ফ্লাইওভার, ৬৬টি ফুটওভার ব্রিজ, ৩টি আন্ডারপাস, ২০ জোড়া ডেমু ট্রেন, ৯টি ওয়াটার বাস, বিআরটিসির ৪২টি আর্টিকুলেটেড এবং ৩০৩টি ডাবল ডেকার বাস কিনেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব যানজট নিরসনে কতটা ভূমিকা রাখছে? যে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে নগরবিদদের প্রশ্ন রয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এসব ফ্লাইওভার এক সময় কনক্রিটের জঞ্জালে পরিণত হবে। আর ফ্লাইওভার পর্যন্ত পৌঁছতে যে যানজট অতিক্রম করতে হয়, তাতে তার কার্যকারিতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফ্লাইওভারে উঠলে শুধু এর দৈর্ঘটুকু দ্রæত অতিক্রম করা যায়। তারপর সেই যানজটেই পড়তে হয়। এমনকি যানজট ফ্লাইওভার পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তাহলে ফ্লাইওভারে কী লাভ হচ্ছে! নগরবিদরা অনেক সময় আশাজাগানিয়া কথা বলে যানজটকে সহনীয় করার পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা বলেছেন, ঢাকায় যে ৭ শতাংশ সড়ক রয়েছে তা যদি যথাযথ ও পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে যানজট সহনীয় মাত্রায় রাখা যাবে। বিদ্যমান সড়ক ও ফুটপাত যেভাবে হকার এবং বিভিন্ন উপায়ে দখল হয়ে আছে, তা আগে মুক্ত করা প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে যদি এ কাজটি করা যায়, তবে যানজট সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। অন্যদিকে পরিবহন খাত শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে পারলে আরও বেশি উপকার পাওয়া যাবে। যেমন উত্তরের সাবেক মেয়র আনিসুল হক উদ্যোগ নিয়েছিলেন, পরিবহন কোম্পানিগুলোকে পাঁচটি কোম্পানির অধীনে নিয়ে আসা। এতে যাত্রীবাহী গাড়িগুলোর মধ্যে একে অপরকে টপকে যাওয়া বা ওভার টেক করার প্রবণতা কমবে। একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে সুশৃঙ্খলভাবে যানবাহন চলবে এবং যানজটের অন্যতম কারণ যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠা-নামা করতে গিয়ে যে যানজটের সৃষ্টি হয় তা কমে যাবে। তার মৃত্যুর পর এ উদ্যোগ থেমে গেছে। বলিষ্ঠ উদ্যোগ নিলে যে কাজ হয়, তার নজির তিনি স্থাপন করে গিয়েছিলেন। তেজগাঁওস্থ অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করেছিলেন, গাবতলি বাস টার্মিনালের সামনে চিরকালের যানজট কমিয়েছিলেন। সাত রাস্তা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ইউলুপ চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এসব কার্যক্রম এখন বাস্তবায়ন নিয়ে শংকা দেখা দিয়েছে। উল্টো দেখা যাচ্ছে, রাজধানীর বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম চালাতে গিয়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে এমন অবস্থা করে রাখে, তাতে যানজট আরও তীব্র হয়ে উঠে। এসব নিয়ে বহু লেখালেখি হলেও সংশ্লিষ্টরা কোনো ধরনের কর্ণপাত করছে না। এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা যদি বছরের পর বছর চলতে থাকে, তবে যানজট কমার পরিবর্তে বাড়তেই থাকবে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। তবে একটি উন্নয়নশীল দেশের রাজধানীর উন্নয়নও যে চোখে পড়তে হয়, ঢাকাকে দেখে তা কারো পক্ষে বোঝার উপায় নেই। অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতার কথা বাদ দেয়া যাক, প্রতিদিনের দৃশ্যমান যানজট দেখলেই তো তা মনে করার কারণ নেই। উন্নয়নশীল দেশের রাজধানী হিসেবে যার গতিশীল হয়ে ওঠার কথা, অথচ ক্রমাগত স্থবির হয়ে পড়ছে। দিনে-বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। মানুষের অপূরণীয় শারিরীক ও মানসিক ক্ষতি হচ্ছে। কর্মঘন্টা হারিয়ে কর্মোদ্যম হারিয়ে ফেলছে। যার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। সরকার কি এসব বিবেচনায় নিচ্ছে না? শুধু যানজটকে যদি সহনীয় মাত্রায় আনা যেত, তাহলে অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হতো। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনোভাব যেন এরকম: যেভাবে চলছে, চলতে থাকুক। এই মানসিকতার কারণেই যানজট কমছে না এবং কমবে না। আমরা মনে করি, যানজট নিরসনে সরকারকেই ড্রাস্টিক উদ্যোগ নিতে হবে। রাজধানীর যানবাহন শৃঙ্খলাবদ্ধ করা এবং সড়ক ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আসার পদক্ষেপ নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যানজট

১৯ জানুয়ারি, ২০২৩
৯ জানুয়ারি, ২০২৩
১৯ ডিসেম্বর, ২০২২
২৭ নভেম্বর, ২০২২
২৯ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন