পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের নামে মসজিদ-মাদরাসা ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ সংক্রান্ত কিছু খবর ও বিভিন্ন সংগঠনের বিবৃতি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে একটি সংগঠনের বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। তাতে ইতোমধ্যে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, এমন কিছু মসজিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভাঙার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, এমন কিছু মসজিদের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। বিবৃতি মতে, ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য ফেনীর ঐতিহ্যবাহী মহিপাল জামে মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। স্থানীয়দের ইবাদত-বন্দেগী ও যাত্রাপথের মুসাফিরদের জন্য মসজিদটি ছিল খুবই প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। মহাসড়কের পাশে হওয়ায় এর আলাদা গুরুত্বও ছিল। রাজধানীর মিরপুর এলাকায় রাস্তা প্রশস্ত করতে পাঁচটি মসজিদ ও একটি মাদরাসা ভাঙা হয়েছে। কুড়িল ফ্লাইওভার সংলগ্ন মসজিদটি ভাঙা হয়েছে। মাটিকাটায় বায়তুন নূর জামে মসজিদ ভাঙা হয়েছে। হাতিরঝিল সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে শুধুমাত্র সৌন্দর্যবৃদ্ধির নামে দুটি মসজিদ ও একটি মাদরাসা ভাঙা হয়েছে। রংপুরের শাহী মসজিদ নামে পরিচিত মসজিদটিও ভাঙা হয়েছে। ভাঙার তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন জায়গায় আরো বহু মসজিদ। ঢাকার সদরঘাট ও কামরাঙ্গিরচরে অন্তত ২১টি মসজিদ ভাঙার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া মেট্রোরেল প্রকল্পের বাস্তবায়নে আরো ২৩টি মসজিদ ভাঙা হতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখেনা, মসজিদের মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর ধর্মীয় স্থাপনা ভাঙা হলে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ দেখা দেয়া খুবই স্বাভাবিক। আলোচ্য ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। মসজিদ ভাঙার প্রতিটি ঘটনায় স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংঘাত-সংঘর্ষ হতেও দেখা গেছে। রাজধানীর সদরঘাটের বাইতুন নাজাত মসজিদ ভাঙা নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। কিছু কিছু মসজিদ ভাঙার বিরুদ্ধে হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। জানা গেছে, ওই সব মসজিদও ভাঙার পাঁয়তারা চলছে।
মসজিদ-মাদরাসার ক্ষেত্রে যেটা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেটা হলো, উন্নয়নের উসিলায় তা নির্বিচারে ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে বা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। পক্ষান্তরে অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয় ও ধর্মীয় স্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করা হচ্ছে। এর কিছু নজির আলোচ্য বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজধানীর হাতিরঝিল প্রকল্পে গৌরাঙ্গমন্দির যাতায়াতের সুবিধার জন্য ভেঙ্গে ফেলায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাধার মুখে তা ভাঙ্গা সম্ভব হয়নি। মন্দির বাঁচাতে রাস্তা ও ফ্লাইওভারের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখানে রাস্তা ও ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে বাঁকা করে। পাবনার রাঘবপুরে রাস্তার মাঝখানে চার-পাঁচটি মন্দির রেখেই রাস্তা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সরকারীভাবে মন্দিরগুলো সংস্কারও করা হয়েছে, যদিও সেসব মন্দিরে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয় না। চট্টগ্রামের পটিয়ায় একটি রাস্তা নির্মাণকালে একটি মন্দির ও ৪০টি হিন্দু পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন আশংকায় হিন্দু নেতারা সড়ক ও সেতুমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাদের আশ্বাস দিয়েছেন, রাস্তা বাইপাস করে হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘর রক্ষা করা হবে। নরসিংদী শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ নয় বছর আটকে আছে হিন্দু বাউলদের একটি আখড়ার কারণে। বাউলরা সেখানে থাকে এবং মেলার আয়োজন করে, যা তাদের উপার্জনের উপায়। অথচ শহর রক্ষার জন্য বাঁধ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। রাজধানীর মিরপুর পাঁচটি মসজিদ ও একটি মাদরাসা ভেঙ্গে দেয়া হলেও নাজারেথ নভিসিয়েট ও এসএল লুইজেন সিস্টার্স গির্জা অক্ষত রাখা হয়েছে। এই সব ব্যতিক্রমে সংঘতকারণেই প্রশ্ন দেখা দেয়। একটি ভুল বার্তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যায়। বলা যেতে পারে, অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয় ও স্থাপনা রক্ষার ক্ষেত্রে যে সতর্কতা, সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছে সংশ্লিষ্টরা, মসজিদ-মাদরাসা সুরক্ষায় অনুরূপ সর্তকতা, সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের পরিচয় তারা দেয়নি বা দিচ্ছে না। এতে মুসলমানদের মধ্যে উদ্বেগ ও ক্ষোভ এবং ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে মসজিদ-মাদরাসার নিরাপত্তা নেই, এরূপ ধারণা তৈরি হওয়া মোটেই অমূলক নয়।
উত্থাপিত অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, ব্যক্তিবর্গ ও সরকারের আমলে নেয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। এ ব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্ত ও যথাযথ প্রতিকার আবশ্যক। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে ও কল্যাণে রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। উন্নয়নের তাকিদে ও প্রয়োজনে মানুষের ভুসম্পত্তি অধিগ্রহণ, বসতি ভেঙ্গে দেয়া বা সরিয়ে দেয়াতে কারো আপত্তি থাকলেও করার কিছু নেই। তা মেনে নিতে হবে। তবে মসজিদ ভাঙ্গার প্রশ্নে শরীয়তের বিধান অগ্রাহ্য করার অধিকার কারো নেই। মসজিদ গড়ে তোলার যেসব পূর্বশর্ত আছে তা অনুসরণ করে কোনো মসজিদ নির্মিত হলে এবং সেখানে নিয়মিত পাঞ্জেগানা নামাজ আদায় হলে তা ভেঙ্গে ফেলার অধিকার শরীয়ত কাউকে দেয়নি। তবে নদী, সমুদ্রতীর বা উপকূলবর্তী এলাকায় কোনো প্রতিষ্ঠিত মসজিদ যদি ভাঙনের মুখে পড়ে বা তার বিলীন হওয়ার আশংঙ্কা দেখা দেয় তবে সরিয়ে নিয়ে অন্য নিরাপদ স্থানে নির্মাণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ মসজিদ ভাঙা নয়, অনির্বায কারণে স্থানান্তর করা যেতে পারে। উন্নয়নের নামে মসজিদ ভাঙার প্রশ্ন এই নীতি-বিধান অনুসরণ করাই বিধেয় ও কাম্য। মসজিদ রেখে রাস্তাঘাটসহ অন্যান্য উন্নয়ন সম্ভব হলে, সেটাই করতে হবে। নিতান্তই যদি সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে কাছাকাছি কোনো স্থানে তা সরিয়ে নির্মাণ করতে হবে। এটাও মনে রাখতে হবে, জনস্বার্থেই প্রতিটি মসজিদ গড়ে উঠেছে। এ স্বার্থকে উপেক্ষা করা যাবে না। আমরা আশা করি, উন্নয়নের নামে মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার নীতি পরিহার করা হবে। সর্বোতভাবে মসজিদ রক্ষার চেষ্টা করতে হবে। একেবারেই না হলে বিকল্প তৈরি করে দিতে হবে। এব্যাপারে ইতোমধ্যে যে বৈষম্যর চিত্র লক্ষ্য করা তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এটা পরিত্যজ্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।