Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে কিছু কথা

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২২ জুন, ২০১৮, ১০:৪৫ পিএম


২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী। গত ৭ জুন জাতীয় সংসদে পেশকৃত উক্ত বাজেটের আকার ৪,৬৪,৫৭০ কোটি টাকা। রাজস্ব ব্যয় ও এডিপি ১,৭৯,৬৬৯ কোটি টাকাসহ ঘাটতি ১,২৫,২৯৩ কোটি টাকা। কারণ, রাজস্ব আয় ৩,৪৩,৩৩১ কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ বাজেটের ২৭%, যা দেশি-বিদেশি ঋণ থেকে সংগৃহীত হবে। তন্মধ্যে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৬০,৫৮৫ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.৮%।
বাজেট ঘোষণার পর থেকে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। কেউ বলছেন সেকেলে বাজেট, কেউ বলছেন স্বল্প মানুষকে তোষামোদি করার বাজেট, কেউ বলছেন বাস্তবায়নযোগ্য নয়, কেউ বলছেন নির্বাচনী বাজেট ইত্যাদি। সর্বজনীন পেনশন চালু ও চাল আমদানিতে ২৫% শুল্ক আরোপ বেশ আলোচিত হচ্ছে। আর একটি বিষয় সর্বাধিক আলোচিত হচ্ছে, তা হলো এই যে সর্বোচ্চ বাজেট দেয়া হলো, এর কাটছাঁট শুরু হবে কবে। আবার অনেকেই বলছেন বাজেট দিয়ে বলা হচ্ছে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হয়নি। কিন্তু ২/৩ মাস পরই তো সরকারি আদেশ বলে বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়ানো হবে, যা’হোক, বাজেট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এবং হবে এটাই সাধারণ নিয়ম। তাই এ বিষয়ে আলোচনা না করে যে বিষয়ে তেমন আলোচনা হয় না, সেই বিষয়ে অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়নের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
কয়েক বছর যাবত বাজেট পেশ করার পর বলা হচ্ছে দেশের স্বচ্ছ বাজেট (এবারও তাই বলা হয়েছে)। কথাটির মধ্যে কিছুটা অহংকারী ভাব আছে। স্বচ্ছ বাজেট দেয়া ভাল কথা। কারণ, এডিপি যত বাড়বে, দেশের উন্নতি তত বেশি হবে। কিন্তু তা হয় না। কারণ, বাজেট দেয়ার কিছুদিন পরই এডিপির কাটছাঁট করা শুরু হয়ে যায় এবং তা ব্যাপক আকারে চলতে থাকে। তাই আয় বুঝে ব্যয় নির্ধারণ করা দরকার। নতুবা এটি হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হয়। যা’হোক, বাজেট কাটছাঁট করার পর যেটুকু থাকে, তারও সবটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। যেমন: ২০১০-১১ সালে বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল ৯৭%। কিন্তু এরপর এটা প্রতিবছর কমতে কমতে চলতি অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৭৫% এ। অর্থাৎ আমরা টাকা খরচ করতে পারছি না। একইভাবে বিদেশি টাকা ফেরত যাওয়ারও অন্ত নেই! স্মরণীয় যে, স্বাধীনতার আগেও বাজেটের টাকা ফেরত যেত, খরচ করার যোগ্যতা ছিল না। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও তা অব্যাহত আছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের ব্যর্থতাই এর প্রধান কারণ। দ্বিতীয়ত: যেটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে, তা নিয়েও লজ্জাজনক ঘটনার অন্ত নেই। যেমন: বছরের ১০-১১ মাসে বাস্তবায়ন হয় মাত্র ৬০%, আর ১/২ মাসে বাস্তবায়ন হয় বাকী ৪০%, যা মূলত কাগজে কলমে হিসেব ঠিক করা হয়। আর টাকা ভাগ করে নেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অভিমত হচ্ছে, এডিপির ৬০% টাকা দুর্নীতি হয়। অথচ জিডিপি, মাথাপিছু গড় আয়, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদিতে এডিপি যোগ হয়। কিন্তু তার আউটপুট শূন্য। শুধুমাত্র কিছু বাটপারের লাভ হয় আর দেশের সর্বনাশ ঘটে। এভাবে আয়বৈষম্য বাড়ছে এবং দারিদ্র্যবিমোচনের হার হ্রাস পাচ্ছে! বাজেট বাস্তবায়নকেলেঙ্কারির ঘটনার এখানেই শেষ নয়। কাজের মান এত নিচে নেমেছে, যার নজির বিশ্বের কোথাও নেই। যেমন: নির্মাণ ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক। আর মান সব চেয়ে নিচে। তাই কাজ শেষ হতে না হতেই ধসে পড়া শুরু হয়ে যায় এছাড়া, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের অন্ত নেই। যেমন: এমনও দেখা গেছে, বিলের মধ্যে কোন রাস্তা নেই। অথচ সেখানে ব্রিজ দেয়া হয়েছে। উপরন্তু কোন কাজই নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট অর্থে ও নির্দিষ্ট মানে হয় না। এতে করে উন্নতি চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মেগা-প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। শুধুমাত্র পদ্মা ব্রিজ নির্মাণ ছাড়া অন্য প্রকল্পের অগ্রগতি তেমন নেই বলে মিডিয়ায় প্রায়ই খবর প্রকাশিত হয়! তাই প্রতিটি কাজই নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট অর্থে ও নির্দিষ্ট মানে বাস্তবায়ন করতে হবে যে কোন মূল্যে। নতুবা কাক্সিক্ষত উন্নতি হবে না।
চলতি বছর বাজেট বাস্তবায়নের হার ৭৫%, যা সর্বনিম্ন। কিন্তু আগামী বাজেট বাস্তবায়নের হার আরও কমতে পারে। কারণ, বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হতে হতে ২/৩ মাস পার হয়ে যায়। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসের দিকে শুরু হয়। বিশেষ করে এডিপি। কিন্তু এ বছর জাতীয় নির্বাচন হবে ডিসেম্বর নাগাদ। তাই সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ নির্বাচনী কাজ শুরু হয়ে যেতে পারে। আর তা হলে সরকার নির্বাচন নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে পড়বে। সেই সাথে প্রশাসনও। ফলে বাজেট বাস্তবায়নের কাজ শ্লথ হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত: নির্বাচনে সরকারপরিবর্তন যদি না হয়, তাহলে এডিপি ঠিক থাকবে। আর যদি পরিবর্তন হয়, তাহলে ব্যাপকভাবে এদিক-ওদিক হয়ে যেতে পারে। তাতে করে কাজের অগ্রগতি আরও শ্লথ হয়ে পড়বে। এভাবে বাজেট বাস্তবায়নের হার ৬০% এর নিচে নেমে আসতে পারে। একই কারণে রাজস্ব আয়ও হ্রাস পেতে পারে। তাই রাজস্ব আদায়ের এরিয়া বাড়ানো আবশ্যক। যেমন: গ্রামগঞ্জে বহু কৃষক ও ব্যবসায়ী আছেন, যারা আয়কর প্রদানযোগ্য। তাই তাদেরকে আয়করের আওতায় আনা দরকার। এছাড়া, ভ্যাট ও আয়কর ফাঁকি বন্ধ করার জন্য প্রতিটি আর্থিক খাতেই ই-ক্যাশ ব্যবহার বাধ্যতামূলক এবং শহরের প্রতিটি বাড়ি/ফ্ল্যাটের সামনে টিন নম্বর টাঙ্গিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক করা দরকার। তাহলে ভ্যাট ও আয়কর ফাঁকি দেয়া অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যাবে।
বাজেট পেশের এতদিন হয়ে গেলো অথচ মানুষের মুখে তা নিয়ে কথার্বাতা শোনা যায় না। বিবিসি বাংলা কিছু দিন আগে কয়েকজন ব্যক্তির কাছে বাজেটের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বলেন, সংসারের বাজেট বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি, সেখানে জাতীয় বাজেটের খবর শুনে লাভ কি? কেন এ প্রশ্নের উত্তরে তারা এটা বলেন, এই সপ্তাহে যে জিনিস যে দামে কিনে নেই, পরের সপ্তাহেই সেই জিনিস সেই দামে পাওয়া যায় না। বাড়তি টাকা দিতে হয়। সে বাড়তি টাকা পাব কোথায়? তাই সংসদ, বাজেট ইত্যাদির কথা শুনতে ভালো লাগে না। বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার। কারণ, এই অভিমত শুধুমাত্র কয়েকজন ব্যক্তিরই নয়, বরং দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই। তাও যারা কর্মের মধ্যে আছেন, তারা। আর যারা বেকার তাদের কথা বলাই বাহুল্য।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাজেট

১৩ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন