Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সরকারের ইচ্ছাপূরণ নির্বাচন কমিশনের কাজ হতে পারে না

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা, অনেক আলোচনা, অনেক সমালোচনা হয়েছে। এসবের পুনরুল্লেখ অপ্রয়োজনীয়। তবে এই নির্বাচনটি বহুদিন ‘নজির’ হিসাবে উল্লেখিত হতে থাকবে বলে মনে হয়। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে সবাই আশা করেছিলো। সে আশা পূরণ হয়নি। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের ‘যোগসাজসে’ যে নির্বাচন হয়েছে তা অকল্পনীয় এবং নির্বাচনের ‘নতুন মডেল’ হিসেবে সেটা স্বীকৃত হতে পারে। উপরে শান্তিপূর্ণ বলে প্রতিভাত হলেও ভেতরে অনিয়ম, দুর্নীতি, দুষ্কৃতির কোনো কিছুই বাদ যায়নি। ফলাফল ক্ষমতাসীন দলের অনুকূলে গেছে। বিপুলভোটে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এরকম একটি নির্বাচন উপহার দিয়ে নির্বাচন কমিশন খুবই খুশি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘চমৎকার’ নির্বাচন হয়েছে। তিনটি ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত হওয়া, নির্বাচন পর্যবেক্ষকের লাঞ্চিত হওয়া, ৫৪টি কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়া, আগে থেকে ছাপ-মারা ব্যালট পাওয়া, ব্যালট বইয়ের মুড়িতে সই বা আঙুলের ছাপ না থাকার পরও ব্যালট বাক্সে ঢোকানো, বহু কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট না থাকা, ভোটের আগে বিএনপিকর্মীদের ঢালাও গ্রেফতার ইত্যাদি যদি চমৎকার নির্বাচনের সাক্ষ্য দেয় তবে আর বলার কিছু থাকে না।
সরকারের ইচ্ছাপূরণ নির্বাচন কমিশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে পারে না। দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাই তার দায়িত্ব। অথচ আগের নির্বাচন কমিশনের মতো বর্তমান নির্বাচন কমিশনও সরকারের ইচ্ছাপূরণে নিবেদিত ও উৎসাহী বলেই মনে হয়। শুরু থেকেই এই নির্বাচন কমিশন আস্থার সংকটে ভুগছে। তার প্রতি অটুট আস্থা যেমন জনগণের নেই, তেমনি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোরও নেই। কুমিল্লা ও রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে বির্তক ওঠেনি। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ওই দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর প্রশংসা নির্বাচন কমিশন পেয়েছে। গণআস্থার পারদ এর ফলে কিছুটা হলেও উপরে ওঠে। খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সেটা একেবারে তলানিতে স্থিত হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলেছিলেন, খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি পরীক্ষা। সে পরীক্ষায় নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থার অভাব এবং তার ভাবমর্যাদার ওপর লেপিত কালিমা কি মোচন করা আগামীতে আদৌ সম্ভবপর হবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে? নির্বাচন কমিশন এবং পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের একাংশ যাই বলুকনা কেন, বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নাগরিক এবং আন্তর্জাতিক মহল খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ বলে মনে করেনি। তারা বরং ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নতুন পদ্ধতি ও কৌশল আবিষ্কার করেছেন। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াটি বিশেষভাবে স্মরণ করা যেতে পারে। দেশটির পক্ষ থেকে নির্বাচনে সংঘঠিত অনিয়ম ও বিচ্যুতির বিষয় তদন্ত করে দেখার তাকিদ দেয়া হয়েছে।
এ মাসের ২৬ তারিখে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচন খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিনেই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট তা স্থগিত করে দেয়। পরে আপিল বিভাগের নির্দেশের আলোকে নির্বাচন কমিশন নতুন তারিখ ঘোষণা করে। কেমন হবে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, এ নিয়ে জনগণের মধ্যে এবং রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষক মহলে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। নির্বাচনের খুব বেশিদিন বাকী না থাকলেও রোজার কারণে প্রচার-প্রচারণা তেমন জমে ওঠেনি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইফতার ও দোয়া মাহফিল নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। সেইসঙ্গে ভোটারদের সাথে যোগাযোগ, দেখা-সাক্ষাতও অব্যাহত রেখেছেন। দু’দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও সেখানে যাতায়াত করছেন এবং ইফতার ও দোয়া মাহফিলে অংশ নিচ্ছেন। ঈদের পর অবশিষ্ট ক’দিনে নির্বাচনী প্রচারণা যে তুঙ্গে উঠবে, সেটা সহজেই আন্দাজ করা যায়।
ধারণা করা যায়, নির্বাচন কমিশন এই সময়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে। ঈদের পর সময় খুব একটা পাওয়া যাবে না। দ্রুতই প্রস্তুতি সেরে ফেলতে হবে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে গাজীপুরের মানুষই নয়, গোটা দেশের মানুষ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক মহল গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করছে। নির্বাচন কমিশন কীভাবে এই নির্বাচনটি সম্পন্ন করে তা দেখার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। খুলনার ব্যর্থতার পটভূমিতে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনটি নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, আচরণ ও কার্যব্যবস্থা কেমন হবে, সেটাই দেখার বিষয়। এর মধ্যেই রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী মাসে ওই তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সম্ভবত, জাতীয় নির্বাচনের আগে আর কোনো স্থানীয় নির্বাচন হবে না। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের সামনে এই চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্ববহ। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য করতে পারলে নির্বাচন কমিশনের ভাবমর্যাদা বাড়বে এবং জনগণ ও রাজনৈতিক মহলে আস্থার ভাব ফের তৈরি হবে, এমনটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এটা নির্বাচন কমিশনের জন্য খুবই প্রয়োজন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, নির্বাচন কমিশন কি সরকারের ইচ্ছাপূরণের ‘বাধ্যবাধকতা’ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে? সম্প্রতিক অতীতের ঘটনাবলী বিবেচনার নিলে এ ব্যাপারে খুব বেশি আশাবাদী হওয়া যায় না। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের তরফে গত এপ্রিলে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিনটি দাবি জানানো হয়। সেগুলো হলে: সিটি কর্পোরেশন সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়ার সুযোগ দিতে হবে, সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনা যাবে না এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংস্কারের আগে তা ফের পর্যালোচনা করতে হবে। দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের এই তিনটি দাবির ব্যাপারেই নির্বাচন কমিশন ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করেছে এবং যতদ্রুত সম্ভব দাবিগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচার-প্রচারণার সুযোগ দেয়ার দাবি বাস্তবায়নে নির্বাচন কমিশন- ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংসদ সদস্যরা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন। পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, সংসদ সদস্যরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী। তারা এই সুযোগ পেলে নির্বাচনে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন। এতে নির্বাচন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে আর কিছু থাকবে না। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে অসম্ভব। এ সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের জন্যই বরং বুমেরাং হয়ে দেখা দিতে পারে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
ওদিকে আরপিও সংস্কারের সুপারিশগুলো অধিক পর্যালোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। অতঃপর জাতীয় নির্বাচনের আগে আরপিও সংস্কার আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, অংশীজনদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপের সময় আরপিও সংস্কারের দাবি জানানো হয়। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানানো হয়। বিএনপিসহ কয়েকটি দল ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা বলে। এটি আরপিও সংশোধন বা সংস্কার ছাড়া সম্ভব নয়। বর্তমান আরপিওতে সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। এ বিষয় সুস্পষ্ট ভিন্নমত রয়েছে আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগ ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েনের পক্ষে নয়। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে বিভিন্ন সময় যে বক্তব্য রাখা হয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগের মতামতই প্রতিফলিত হয়েছে। অতি সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। কীভাবে করা হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেননি। বর্তমান আরপিওতে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্রবাহিনীকে রাখা হয়নি। সশস্ত্রবাহিনীকে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা না হলে তাকে ক্ষমতায়িত করে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ততটুকু পক্ষে যতটুকু বর্তমান আরপিওতে আছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কি সেনাবাহিনী মোতায়নের কথা বলে আওয়ামী লীগের অভিমতকে সমর্থন করেছেন? নির্বাচন কমিশন কি সরকারের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে আরপিও সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে?
সংসদীয় আসনের সীমানা পুননির্ধারণের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ২৫টি আসনের সীমানা পুননির্ধারণে দেখা গেছে, এসব আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের কোনো মন্ত্রী বা প্রভাবশালী সংসদ সদস্য নেই। বিএনপি এক্ষেত্রে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রতিটি আসনের সীমানা যেভাবে ছিল সেভাবে নির্ধারণ করার পক্ষে অভিমত দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ বর্তমানে বিদ্যমান সীমানা অব্যাহত রাখার পক্ষে।
জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম’র ব্যবহার নিয়ে শুরু থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। বিএনপি ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে। আওয়ামী লীগ পক্ষে। বিএনপির সঙ্গীদলগুলো বিপক্ষে। আওয়ামী লীগের সঙ্গীদলগুলো পক্ষে। এধরনের সার্প বিভক্তি সত্তে¡ও নির্বাচন কমিশন তা আমলে না নিয়ে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। বিএনপি যখন খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে এ ব্যাপারে আপত্তি জানায় তখন নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সচিব হেলালুদ্দিন বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন বিএনপির আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে বলেছে, আইন ও বিধিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে আরো বলা হয়েছে, এ প্রযুক্তি খুবই আধুনিক। এটি হ্যাক করার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে বিএনপি ও তার সঙ্গীদলগুলোর অভিমত হলো: ইভিএম শুরু থেকেই প্রশ্নবৃদ্ধি। যেসব দেশের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে সেসব দেশেও এর ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাদের এ আপত্তি ও বক্তব্য নির্বাচন কমিশন গ্রাহ্যে নেয়নি। বরং খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দুটি কেন্দ্রে ইভিএম-এ ভোটগ্রহণ করেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ভোট গ্রহণ করার প্রত্যয় বা পরিকল্পনা নির্বাচন কমিশনের তরফে জানান দেয়া না হলেও ইতোপূর্বে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল রাখার জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, প্রযুক্তি যদি নিখুঁত ও বিশ্বাসযোগ্য না হয় তাহলে তা যতই আধুনিক হোক, ব্যবহার করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ইভিএম শতভাগ নির্ভরযোগ্য নয়। বিশ্বের ৯০ ভাগ দেশেই ইভিএম ব্যবহার করা হয় না। যারা ব্যবহার করেছে তারা ঠেকে শিখেছে। জার্মানির ফেডারেল কোর্ট নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছে। ফিলল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করেছে। নেদারল্যান্ডে ইভিএম ব্যবহার চালু করেও পরে ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ভারতের দিল্লী হাইকোর্টের একটি রায়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। রায়ে বলা হয়েছে, ইভিএম ভারতের নির্বাচনে ফলাফল নির্ধারণের প্রধান অবলম্বন হতে যাচ্ছে। তবে যন্ত্রটি দিয়ে কারসাজি করার সুযোগ রয়েছে।
দুঃখজনক হলো, এতসব তথ্য জানা থাকার পরও নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহার কার্যকর করার পক্ষে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। জানা গেছে, ইতোমধ্যে ২ হাজার ৫৩৫টি ইভিএম কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাও নাকি কেনা হচ্ছে চারগুন দামে। নির্বাচন কমিশনের এই অতি উৎসাহ দেখে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইভিএম ব্যবহারে ভারত অনেক এগিয়েছে। তা সত্তে¡ও আগামী জাতীয় নির্বাচনের ইভিএম এ’র বদলে কাগজের ব্যালটে ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছে সর্বভারতীয় বৃহৎ ও প্রাচীন রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস। পর্যবেক্ষকদের মতে, ইভিএম-এ এত উৎসাহ না দেখিয়ে নির্বাচন কমিশনের উচিৎ কীভাবে একটি অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু, অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা যায় সেদিকে মনোযোগ দেয়া। এ ধরনের নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অপরিহার্য পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত। নির্বাচন কমিশনের এখন সেদিকেই বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন।
এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের ইচ্ছাপূরণের অতি আগ্রহের কারণে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠা করা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সরকার পক্ষের দাবি ও চাপের কারণে নেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তে ফিল্ড আরো অসমান হয়ে গেছে এবং তা সরকার পক্ষের দখলে চলে গেছে।
বিরোধীদল বিএনপির কোনো দাবি-অনুরোধ শুনতেই যেন রাজি নয় নির্বাচন কমিশনবিএনপি বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন কমিশনে যেসব দাবি, প্রস্তাব ও বক্তব্য পেশ করেছে, নির্বাচন কমিশন তা বিবেচনায় নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যাবতীয় দাবি, প্রস্তাব ও বক্তব্য যতদ্রুত সম্ভব কার্যকর করার উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিয়েছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, বিএনপি খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে উপলক্ষ করে পুলিশের ধরপাকড় হামলা-মামলা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পেশীশক্তি প্রদর্শন বন্ধ এবং কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার প্রত্যাহার দাবি করেছিল। এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তরফে খুলনার রিটার্নিং অফিসারের বিরুদ্ধে আপত্তি জানানো হলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন কমিশন একজন যুগ্মসচিবকে নিয়োগ দিয়ে খুলনায় পাঠায়। এভাবে রিটার্নিং অফিসারের ওপরে আরেকজনকে বসিয়ে দেয়া নজিরবিহীন। এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে জোর প্রশ্ন তোলা হয়েছে। গাজীপুরে পুলিশ একটি মামলায় বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকারের স্বজন ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করে। গ্রেফতারও করে কয়েকজনকে। পরে দেখা যায়, মামলাটি একেবারেই বানোয়াট ও সাজানো। নির্বাচন কমিশন পুলিশের এহেন আচরণ ও ভূমিকার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা, জানা যায়নি।
নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধান তাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা ও ক্ষমতা দিয়েছে। তার কাছ থেকে সব সময় নিরপেক্ষ ভূমিকা ও আচরণই সবাই প্রত্যাশা করে। অথচ আগের নির্বাচন কমিশনের মতো বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, সরকারের আজ্ঞাবহনে তার অতি আগ্রহ। সরকারের মিশন বাস্তবায়নে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করাকে সে যেন সাবস্থ্য করে নিয়েছে তার করণীয় ও কর্তব্য হিসেবে। জনগণ ও রাজনৈতিক দলসমূহের আস্থাহীনতা সৃষ্টির মূল হেতু এটাই। তাছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষে তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ঘাটতিও দেখা গেছে। এরকম একটি নির্বাচন কমিশনের পক্ষে জাতীয় নির্বাচনের মতো বড় নির্বাচন অংশগ্রহণভিত্তিক, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা কতদূর সম্ভব হবে সেটাই প্রশ্ন। নির্বাচন কমিশনের সাফল্যের সবচেয়ে বড় শর্ত হলো, জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন, যেমন আস্থায়, আছে প্রতিবেশী ভারতের, নেপালের, পাকিস্তানের, শ্রীলংকার ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন কমিশন। সময় অনেকটা প্রান্তিক পর্যায়ে চলে এলেও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। নির্বাচন কমিশন তার প্রতি সকল মহলের আস্থা অর্জন করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে পারে, কাজের মাধ্যমে প্রমাণ দিতে পারে। গাজীপুরসহ চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন একটা সুযোগ তার সামনে এনে দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, এটা সর্বশেষ সুযোগ। আশা করি, নির্বাচন কমিশন সুযোগটি হেলায় হারাবে না।



 

Show all comments
  • এম আব্দুল্লাহ ১০ জুন, ২০১৮, ১:১৩ এএম says : 0
    নির্বাচন কমিশন তো সেটাই করছেন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সরকারের


আরও
আরও পড়ুন