Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাদকবিরোধী অভিযান সফল হচ্ছে না কেন?

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৮:২৯ পিএম, ১ জুন, ২০১৮

দেশে বর্তমানে যে শাসনব্যবস্থা চলছে তাকে ‘গণতন্ত্র’ বলে চালাতে ইচ্ছুক সরকার। কিন্তু বাস্তবে কী দেখতে পাচ্ছে জনগণ? দেশে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাতে বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে? তাতে কি সরকারের গণতন্ত্রের দাবী প্রমাণিত হচ্ছে? দৃষ্টান্ত স্বরূপ অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি নির্বাচনে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে স্বয়ং সরকার নিযুক্ত ইসির তদন্ত কমিশন। এতে কী প্রমাণিত হচ্ছে? প্রমাণিত হচ্ছে বর্তমান সরকারের আমলে যেসব নির্বাচন হচ্ছে তাতে অনিয়ম হচ্ছে এবং নির্বাচনের মূল লক্ষ্যই অর্জিত হচ্ছে না।
নির্বাচনের মূল লক্ষ্য হলো দেশ পরিচালনার উদ্দেশ্য দেশে নিয়মিত ব্যবধানে সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে এবং তাতে যারা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন তারাই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করবেন। কিন্তু সেই নির্বাচনেই যদি অনিয়ম হয় তাহলে সেই নির্বাচনকে কি সুষ্ঠু নির্বাচন বলা চলবে? চলবে না। সেই অনিয়মের নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হবেন, তাদেরকে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিও বলা যাবে না। সেক্ষেত্রে দেশে গণতন্ত্র চলছে বলেও দাবী করা যাবে না। খুলনার নির্বাচনে স্বয়ং ইসির তদন্ত কমিটির তদন্তের ফল প্রমাণ করেছে নির্বাচনে অনিয়ম হওয়ারই যেন বর্তমান সরকারের আমলে ‘নিয়ম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুলনার নির্বাচন সম্পর্কে স্বয়ং ইসি কর্তৃক নিযুক্ত তদন্ত কমিটির তদন্তে নির্বাচনে অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ার পর বর্তমান সরকারের আর কোন নির্বাচন অনুষ্ঠানের নৈতিক অধিকার নেই। কারণ তা হবে নির্বাচনে অনিয়ম চালিয়ে যাওয়ার অবৈধ লাইসেন্স দিয়ে দেশে গণতন্ত্রকে অসম্ভব করে তোলার শামিল। সেক্ষেত্রে দেশে গণতন্ত্র চলছে বলে দাবী করারও আর সুযোগ থাকে না।
দেশে সম্প্রতি আর একটি ক্ষেত্রেও চলছে একটি লোভ-দেখানো অভিযান। সেটি হচ্ছে মাদক-বিরোধী অভিযান। যে সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালিয়ে যাবার প্রশ্নে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি, যে সরকারের পক্ষে মাদক-বিরোধী অভিযানে সফল হওয়া আসলেই অত্যন্ত সুকঠিন। তবুও মাদক-নির্মূল অভিযান দেশে একটি জনপ্রিয় দাবী বলে সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ঘোষণা দিয়েছেন : সরকার মাদকের বিরুদ্ধে অল আউট যুদ্ধে নেমেছে। কিন্তুু মাদকের বিরুদ্ধে এই অল আউট যুদ্ধের কি অবস্থা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে?
বাস্তবে সরকারের এই বড় গলায় ঘোষিত অভিযানে কি ইপ্সিত ফল দেখা যাচ্ছে? মোটেই না। এই ব্যর্থতার বহু কারণ রয়েছে, যা এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকায় রিপোর্টে কয়েকটি বড় শহরের মাদক ব্যবসায়ীদের সংখ্যা সম্পর্কে জানা গেছে। রাজধানীতে শীর্ষক স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ১৩৮৪ জন বলে জানা গেছে দৈনিক ইত্তেফাকে গত ২৮ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। খুলনায় শীর্ষ স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ২৭২ বলে জানা। দৈনিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকায় এ সম্পর্কে যে খবর বেরিয়েছে, তা রীতিমত ভয়াবহ। এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনের প্রধান শিরোনাম ছিল : ‘‘তবু থামছেনা ইয়াবা পাচার’’। উপ-শিরোনাম ছিল: ‘‘নারকেল, আম, জুতা, মাছ, মোবাইল ফোন সেট ও পায়ুপথে করেও আসছে”। এই যদি হয় বাস্তব পরিস্থিতি তা হলে মাদক নির্মূল অভিযান যে ব্যর্থ হতে বাধ্য, তা এক রকম জোর করেই বলা যেতে পারে। এ সম্পর্কে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় গত মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘থামছে না ইয়াবা পাচার। মাদক নির্মূলে চলমান অভিযানের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিত্য নতুন কৌশলে পাচার হচ্ছে ইয়াবা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে রীতিমতো বোকা বানিয়ে সক্রিয় ইয়াবা ব্যবসারীরা। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা অভাবী মানুষকে টার্গেট করে একের পর এক ইয়াবার চালান পৌছাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সর্বশেষ গত রবিবার গোপন খবরের ভিত্তিতে রাজধানীর দক্ষিণখান পূর্ব খেওয়াইর থেকে যে ৩ হাজার ৩৫৩ পিস ইয়াবাসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ, তাদের কাছ থেকে আদায় করা তথ্যে বিস্মিত তদন্ত সংশ্লিষ্টরাও।
সরকারের মাদক-বিরোধী অভিযান ব্যর্থ হচ্ছে নানা কারণেই। যেমন অভিযান শুরুর আগেই অভিযানের খবর ফাঁস করে দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে যে অভিযানের সাথে জড়িত সদস্যদের একাংশ দায়ী তা নতুন করে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে সমাজের মধ্যে যদি নীতিহীনতা ব্যাপক আকার ধারণ করে, তখন এমনটি হবারই কথা। বর্তমানে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, নীতিহীনতা ও সংকীর্ণ স্বার্থপরতা যে ভাবে ঢুকে পড়েছে, তাতে এমনটা হওয়া মোটেই আশ্চর্জনক নয়।
বিশেষ করে মাদক ব্যবসায়ের সাথে জড়িত চুনোপুটিরা মাঝে মধ্যে ধরা পড়লেও এর সাথে যুক্ত রাঘব বোয়ালরা তথা গডফাদাররা খুব কমই ধরা পড়ে। কারণ তারা সমাজে খুবই উচ্চ পর্যায়ের লোক। দৈনিক ইনকিলাবের গত মঙ্গলবার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রধান খবর থেকে জানা গেছে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত তালিকায় রয়েছে দেড় শতাধিক রাজনীতিক ও পুলিশ সদস্যের নাম। রাষ্ট্র ও সরকারে রয়েছে তাদের বিরাট প্রভাব। সেই প্রভাবকে পাশ কাটিয়ে তাদের গায়ে হাত দেয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
আরও দু:খের ব্যাপার মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছেন দেশের রাজনীতিকরাও। যাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা তারা দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তারাই যদি সংকীর্ণ ব্যক্তি স্বার্থে মাদক ব্যবসায়ের মত দেশ বিরোধী কাজে সক্রিয় হতে পারেন, এবং তাতে যদি দলীয় ও উপদলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন, তবে তাদের কাছে থেকে মাদক বিরোধী অভিযানের মত একটি দু:সাহসী অথচ দেশপ্রেমিক অভিযান সফল হওয়ার আশা কোথায়?
গত মঙ্গলবারের দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল : ‘মিলে মিশে মাদক ব্যবসা করছেন জনপ্রতিনিধিরা। অর্থাৎ যারা জনগণের ভোটে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন, তারাই যদি তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও সমর্থনের এমন অপব্যবহারের পথে যান, তাহলে জনগণের আর ভরসা থাকে কোথায়?
গত মঙ্গলবার দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদনের প্রধান শিরোনাম ছিল : ‘সবাই সব জানতো, তবু মাদক বন্ধ হয়নি”। উপ-শিরোনাম ছিল : ইয়াবা আসে প্রধানত টেকনাফ, নাইক্ষ্যাছড়ি সীমান্ত দিয়ে। সীমান্ত থেকে মাঠ পর্যায়ে মাদকের সব তথ্যই ছিল পুলিশের কাছে। এর অর্থ হচ্ছে যাদের উপর মাদক নির্মূলের দায়িত্ব, তাদের অনেকেই মাদক পাচারের সাথে জড়িত। এ অবস্থায় এ সর্বনাশা বিপদ থেকে দেশবাসীর রক্ষা পাওয়া বাস্তবে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
আগেই বলা হয়েছে মাদক বিরোধী অভিযান ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ মাদক বিরোধী অভিযানের আগাম তথ্য পুলিশের সোর্সের মাধ্যমে পেয়ে যাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। ফলে তা বিশেষ করে মাদক ব্যবসায়ীদের গডফাদারদের পালিয়ে থাকতেও অসুবিধা হচ্ছে না। দৈনিক সমকাল পত্রিকার গত সোমবারের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল : বাড়ি থেকে পালিয়েছে ইয়াবা বা গডফাদাররা। আর অনেকে তো শুধু বাড়ি থেকেই পালায়নি পালিয়েছেন দেশ ছেড়েও। তাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য আগাম ব্যবস্থা প্রস্তুত রেখেছে তথাকথিত বন্ধু রাষ্ট্র ভারত।
এমনিতে মাদকের বিরোধী অভিযানে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টদের মধ্যেই রয়েছে নানা দূর্বলতা। ফলে অধিকাংশ মাদক ব্যবসায়ী মাদক বিরোধী অভিযান চলার মধ্যেই দেশে বহাল তবিয়তে অবস্থান করছেন। দেশের মধ্যে থাকা সত্তে¡ও তাদের গায়ে সামান্যতম টোকা দেওয়ার সাহস পাচ্ছেনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এর সাথে দেশের পাশাপাশি তথাকথিত বন্ধু দেশ ভারতও যদি মাদক ব্যবসায়ীদের আশ্রয় দিতে এক পায়ে খাড়া হয়ে থাকে, শুধু থাকে না, বাস্তবে তার প্রমাণ দিয়েও চলে, তাহলে বাংলাদেশের মাদক-বিরোধী অভিযান সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কি? থাকেনা।
মাদক বিরোধী অভিযান দেশী-বিদেশী কোন কর্তৃপক্ষের সাহায্যে সফল হবে এ দুরাশা বাদ দিয়ে বরং পবিত্র রমজান মাসে মাদব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযানে সক্রিয় অংশ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবো এবং এ প্রশ্নে অবহেলা করলে আমরা পরকালে কেউ সর্বশক্তিমান আল্লাহর তায়ালার শাস্তি এড়াতে পারবো না, এই বিশ্বাস নিয়ে যদি সমগ্র জাতি ও জনগণ যদি নিজ নিজ অবস্থানে থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাদক বিরোধী সর্বাত্মক অভিযানে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি, তাহলে মাদক-বিরোধী অভিযান সফল হওয়া অনেকটাই সম্ভব হবে।



 

Show all comments
  • কামাল ২ জুন, ২০১৮, ১:৫৮ এএম says : 0
    আশা করি সরকার ও প্রশাসন বিষয়গুলো আমলে নিবেন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাদকবিরোধী


আরও
আরও পড়ুন