পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দুইজন ‘রহমান’ এর জন্য ‘রাহমানুর রাহীম’-এর নিকট প্রার্থনা। ৩০ মে ২০১৮ হলো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম-এর শাহাদত বার্ষিকী। এই উপলক্ষে গত দুই-তিনদিন যাবত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। আজকের কলামটি কোনোমতেই সংক্ষিপ্ত জীবনী নয়; শ্রদ্ধাঞ্জলী মাত্র। অন্যরা যেন জানতে আরও আগ্রহ প্রকাশ করে, তার জন্য উৎসাহের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করা। জিয়াউর রহমান একজন ‘বীর উত্তম’, যেমন ছিলেন তেমনই আছেন। তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরকার। বঙ্গবন্ধুও ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর সকালে নিহত হয়েছিলেন। যে কোনো কারণেই হোক, আওয়ামী লীগ তাঁকে, শহীদ বঙ্গবন্ধু বা শহীদ মুজিব বলেন না। আমি এর ভালোমন্দ আলোচনায় যাবো না। উভয়ের জীবন নিয়ে আলোচনা করার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র বা স্পেইস এই কলামে নেই, তবে এইটুকু বলতেই হবে যে, উভয়ের নামের শেষ শব্দ ‘রহমান’। মহান আল্লাহ তায়ালার ৯৯টি গুণবাচক নামের মধ্যে অন্যতম সুপরিচিত ও তাৎপর্যপূর্ণ নাম হচ্ছে ‘রহমান’। ঐজন্যই আমার প্রার্থনা থাকবে, ‘রহমানুর রহীম’ মহান আল্লাহ তায়ালা যেন উভয়কে শাহাদতের মর্যাদা প্রদান করেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুটি ছিল, চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থানকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি অংশ কর্তৃক পরিচালিত বিদ্রোহের ফলশ্রুতি (ইংরেজি পরিভাষায়: আফটার ইফেক্ট অব এ মিউটিনি কন্ডাক্টেড বাই পার্ট অব দ্য বাংলাদেশ আর্মি লোকেইটেড ইন চিটাগং ক্যান্টনমেন্ট)। বিদ্রোহকে ইংরেজি পরিভাষায় ও সামরিক ইংরেজি পরিভাষায় মিউটিনি বলা হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সংঘটিত চট্টগ্রাম সেনা বিদ্রোহের বা মিউটিনির বিচার হয়েছিল। কিন্তু আজ অবধি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যার বিচার হয়নি। মিউটিনির বা বিদ্রোহের বিচার হয়েছিল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইন (ইংরেজি পরিভাষায়: বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট) এর ৩১ ধারা মোতাবেক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইন মোতাবেক, অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ব্যারিস্টার অ্যাডভোকেট তথা আইনজীবী অথবা সেটা সম্ভব না হলে সামরিক অফিসারগণের মধ্য হতে আত্মপক্ষ সমর্থনকারী কর্মকর্তা পাওয়ার অধিকার রাখতেন। ২৯ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে ২৫ জনই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার বা মুক্তিযোদ্ধা জুনিয়র কমিশনড অফিসার। অতএব, স্বাভাবিকভাবেই ঐ ২৯ জনের আবেদন ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারগণের মধ্য থেকেই যেন, কাউকে না কাউকে, আত্মপক্ষ সমর্থনকারী কর্মকর্তা হিসাবে নিযুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালের জুন মাসের, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ, মোট ৩ জন আত্মপক্ষ সমর্থনকারী কর্মকর্তা (ইংরেজি সামরিক পরিভাষায়: ডিফেন্ডিং অফিসার) নিযুক্ত করতে সম্মত হন। ১৯৮১ সালের জুন মাসের জ্যেষ্ঠতার ক্রম অনুসারে ঐ তিনজন ব্যক্তি হচ্ছেন: (এক) পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত আর্টিলারি কোর-এর অফিসার, ১৯৭৩-৭৪ সালে পাকিস্তান হতে প্রত্যাগত, ব্রিগেডিয়ার (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আনোয়ার হোসেন, (দুই) মুক্তিযোদ্ধা, কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) মোহাম্মদ আইনুদ্দিন বীর প্রতীক, (তিন) মুক্তিযোদ্ধা, লেফটেনেন্ট কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, তথা এই কলামের লেখক। পাঠক যেন মনে না করেন যে, এই তিনজন ব্যক্তির দায়িত্ব ছিল প্রেসিডেন্ট হত্যা সমর্থন করা। এই তিন জন অফিসারের দায়িত্ব ছিল ২৯ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থন করা; তথা এটা প্রমাণে সহায়তা করা যে, তারা বিদ্রোহের জন্য দায়ী না বা তারা বিদ্রোহ করেননি। কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে অভিযুক্তদের বিচার হয়েছিল; সেনাবাহিনী আইন (অর্থাৎ বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট) মোতাবেকই কোর্ট মার্শালের রায় বাস্তবায়ন হয়েছিল। কিন্তু সেই কোর্ট মার্শাল সম্বন্ধে, সেই কোর্ট মার্শালের পরিচালনার সম্বন্ধে, সেই কোর্ট মার্শালের নিরপেক্ষতা সম্বন্ধে আমার ব্যতিক্রমী মতামত আছে যেটি আমার লেখা বই ‘মিশ্র কথন’-এ লিখেছি, স্থান অভাবে এখানে লিখছি না। কোর্ট মার্শাল (তথা আদালতটি) বসেছিল এবং চলেছিল চট্টগ্রাম মহানগরের লালদীঘীর পাড়ে অবস্থিত কারাগারের অভ্যন্তরে। ঐ কারাগারেই অভিযুক্ত ২৯ জন বন্দী ছিলেন। ঐ ২৯ জনের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হলে, ঘটনা সম্বন্ধে জানতেই হবে। জানার নিমিত্তে ঐ ২৯ জন অভিযুক্তের সঙ্গে আমরা আলাপ করেছিলাম, ঐ ২৯ জনের মধ্যে বেশিরভাগেরই পিতামাতা, স্ত্রী, ভাইবোন প্রমুখের সঙ্গেও আমরা কথা বলেছিলাম। আমরা ৩ জনের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার আনোয়ার একটু কম জড়িত হয়েছিলেন; কর্নেল আইনউদ্দিন এবং লেফটেনেন্ট কর্নেল ইবরাহিম বেশি জড়িত হয়েছিলেন; বেশি কথা শুনেছিলেন; বেশি খবর জেনেছিলেন। আলাপের কারণে, তাৎক্ষণিক ঘটনা প্রসঙ্গে এবং তার আগেরও অনেক ঘটনা প্রসঙ্গে, আমাদের জানার সুযোগ হয়েছিল। এটা অত্যন্ত বিরল সুযোগ ছিল। আশ্চর্যজনক মনে হলেও বাস্তবতা হলো: ভীতিকর পরিস্থিতিতে আমরা কোনো লিখিত নোট রাখতে পারিনি, যা কিছু জমা রাখার সেটা জমা রেখেছিলাম স্মৃতির মনিকোঠায়। অপ্রিয় বাস্তবতা হলো, কালের পরিক্রমায় অনেক কিছু মাথার স্মৃতিশক্তি থেকে ছুটে যায় বা ছুটে যাচ্ছে।
মহা দুর্ঘটনার দায়-দায়িত্ব। সেনাবাহিনীতে চাকরি করার কারণে, সক্রিয় চাকরি জীবনে, এই ধরনের মিউটিনি ও কোর্ট মার্শাল ইত্যাদি বিষয়ে লেখালেখি কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত ছিল। কিন্তু ঘটনার তিরিশ বছর পর (১৯৮১-২০১১) আমি ‘মিশ্র কথন’ নামক বইটি লিখেছি। বইটি লেখার সময় অনেক কথা যেগুলো অভিযুক্তদের কাছ থেকে জেনেছিলাম সেগুলো উল্লেখ করতে পারিনি। কারণ, সেগুলো গবেষকের দৃষ্টিতে বা আইনজীবীর দৃষ্টিতে প্রমাণযোগ্য নয়; কিন্তু আমার নিকট অতি বিশ্বাসযোগ্য। প্রখ্যাত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ দীর্ঘদিন গভীর ও বিস্তৃত গবেষণার পর তাঁর বই লিখেছেন, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে অনেকগুলোর ঘটনা আমার বইয়ে আলোচনায় আনিনি; মাহফুজ উল্লাহ তাঁর বইয়ে এনেছেন। সারমর্ম: তৎকালীন (১৯৭৮-মে ৮১) চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পদাতিক ডিভিশনের জিওসি তৎকালীন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম চাচ্ছিলেন জিয়াউর রহমানকে কাবু করতে; জেনারেল মঞ্জুরকে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও সুনির্দিষ্ট-পরোক্ষভাবে উৎসাহ জোগাচ্ছিলেন ঢাকায় অবস্থানকারী কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের বাইরের কেউ না কেউ। প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের দু’একটি পত্রিকায় এবং অন্যান্য দেশের পত্রিকায়, প্রকাশিত বিশ্লেষণমূলক সংবাদে এবং অনেক বাংলাদেশি লেখকের পুস্তকে এই ধরনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব এবং ১৯৯১ সালের তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ইমাম উদ্দিন চৌধুরী তার লিখিত আত্মজীবনীমূলক পুস্তকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘনিষ্ঠ সহচর এবং ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ সরকারি সহকর্মী কর্নেল অলি আহমদ বীর বিক্রম, মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম, বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এবং আরও কেউ কেউ তাদের লেখা পুস্তকে বা কলামে বা ইন্টারভিউতে এই ধরনের ইশারা দিয়েছেন।
জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বাধীন চট্টগ্রাম ছিল জিয়া-বিরোধী ষড়যন্ত্রের সূতিকাগার। ১৯৮১ সালের ৩০ মে আগ্রহী বিদ্রোহীগণ সফল হয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমানকে হত্যা করতে। কিন্তু এর আগেও একাধিকবার এই চট্টগ্রাম অঞ্চলেই ঐ একই জিওসি মেজর জেনারেলর মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে বা মঞ্জুরের অবগতিতে বা মঞ্জুরের উৎসাহে বা মঞ্জুরের উদ্যোগে; জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার জন্য অথবা নিদেনপক্ষে জিয়াউর রহমানকে কব্জা করে দাবি আদায়ের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। স্থান অভাবে সংক্ষিপ্ত কলামে সব ঘটনা উল্লেখ করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ঘটনাটি ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরের এবং বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি বা সংক্ষেপে বিএমএ-কে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, ১৯৭৬ সালে, কুমিল্লা সেনানিবাসের অস্থায়ী অবস্থান থেকে ভাটিয়ারিতে স্থায়ীভাবে আসে। প্রতিষ্ঠালগ্নে বিএমএ’র কমান্ডান্ট এর দায়িত্ব পালন করছিলেন (মুক্তিযোদ্ধা) কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা। মূলত কর্নেল কেএন হুদা কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন; অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে বা পার্ট টাইম দায়িত্ব হিসেবে তিনি বিএমএর কমান্ডান্ট ছিলেন। এর পরে ১৯৯৩ সালে আমি দায়িত্ব নিই; কর্নেল হুদা এবং আমার মাঝখানে অন্য কোনো মুক্তিযোদ্ধা অফিসার কমান্ডান্ট ছিলেন না। আমি ছিলাম বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ইতিহাসে স্থায়ী বা ফুলটাইম কমান্ডান্টগণের মধ্যে একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ছয় মাস পরপর একটি কোর্সের প্রশিক্ষণ সমাপনী অনুষ্ঠান বা প্রশিক্ষার্থীগণ যে সেনাবাহিনীর অফিসার হলেন তার অনুষ্ঠান স্থির হতো। এই অনুষ্ঠানকে পাসিং আউট প্যারেড বলে। যেহেতু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিকভাবে সামরিক বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক, তাই তরুণ প্রশিক্ষার্থীগণ সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসেবে যোগদানের প্রক্রিয়া তথা কমিশন পাওয়ার কাজটি রাষ্ট্রপতির সুবাদে বা রাষ্ট্রপতির সৌজন্যে হতো। এইজন্য ঐ আনুষ্ঠানিক প্যারেডের অপর নাম হলো প্রেসিডেন্ট’স প্যারেড। কমান্ডান্ট হিসেবে একাডেমির পরিচালনা প্রক্রিয়া, পাসিং আউট প্যারেডের প্রক্রিয়া, প্যারেডের আগে-পরে নিরাপত্তা প্রক্রিয়া, প্যারেডের জন্য মেহমানদের আগমন-নির্গমণ প্রক্রিয়া ও মেহমানদের নিরাপত্তা এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত পদাতিক ডিভিশনের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশন ইত্যাদি সম্মন্ধে আমি ওয়াকিবহাল। তবে ১৯৮০ এবং ১৯৯৩-৯৪ এর মধ্যে হালকা কিছু তফাৎ তো হবেই।
ডিসেম্বর ৮০’র প্যারেডকে কেন্দ্র করে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। সাধারণত জুন এবং ডিসেম্বরে, অর্থাৎ বছরে দুইবার পাসিং আউট প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসের প্যারেডটির তারিখ স্থির হয়েছিল ২০ ডিসেম্বর। শীতকালে তথা ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাসিং আউট প্যারেডে সাধারণত দেশের প্রেসিডেন্ট নিজেই উপস্থিত থাকতেন এবং সালাম গ্রহণ করতেন (১৯৯১ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীও একই রেওয়াজ অনুসরণ করেন)। ২০ ডিসেম্বর ১৯৮০ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য প্যারেডটিতেও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সালাম গ্রহণ করবেন এমনটিই নিশ্চিত বন্দোবস্ত ছিল। শীতকালে অনেক সকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসার জন্য আকাশ পথ অবলম্বন করা অনিশ্চিত হতো কারণ কুয়াশার কারণে বিমান বা হেলিকপ্টার চলাচল বিঘিœত হতো। তাই প্রেসিডেন্ট অনেক সময় আগের রাত চট্টগ্রামে এসে থাকতেন। এবারেও (২০ ডিসেম্বর ১৯৮০) এরকমই বন্দোবস্ত ছিল। যেহেতু পাসিং আউট প্যারেডের ফাংশনটি সামরিক ফাংশন, সেহেতু প্যারেডের পূর্ব রাত্রিতে আরেকটি সামরিক অনুষ্ঠান বা সামরিক ডিনার বা সামরিক নৈশ ভোজ ইত্যাদি আয়োজন করা খুব স্বাভাবিক ছিল। ২০ ডিসেম্বর ১৯৮০-কে কেন্দ্র করে যে হত্যা পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেই পরিকল্পনার মূল উপাদান ছিল ১৯ ডিসেম্বর ১৯৮০’র রাত্রিতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে একটি সামরিক নৈশ ভোজ। ১৯ ডিসেম্বর ১৯৮০ পরিকল্পিত সামরিক নৈশ ভোজের স্থান ছিল চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ভেতরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার (ইবিআরসি) অফিসার্স মেস। নৈশ ভোজের স্বাগতিক বা হোস্ট হবেন জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম। প্রধান অতিথি হবেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রপতি চট্টগ্রাম মহানগরীর সার্কিট হাউজ থেকে আসবেন। যখন সামরিক নৈশ ভোজ চলমান থাকবে, গোপন পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র মোতাবেক, বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নের সৈনিকগণ, অফিসার্স মেস ঘেরাও করবেন। ঘেরাও করার পর প্রেসিডেন্টকে জিম্মি করা হবে এবং চাপের মুখে বা জীবনের হুমকির মুখে তার কাছ থেকে কয়েকটি দাবি আদায় করা হবে। প্রেসিডেন্ট যদি রাজি না হন বা সহযোগিতা না করেন তাহলে একমাত্র পথ খোলা থাকবে, হত্যা। যদি প্রেসিডেন্ট যে কোনো অজ্ঞাত কারণ বশত সার্কিট হাউজ থেকে আসতে অপরাগতা প্রকাশ করেন, তাহলে ঐ সুনির্দিষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়নের সৈনিকগণ সার্কিট হাউজ ঘেরাও করবে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবে, প্রেসিডেন্টকে বন্দি করবে, প্রেসিডেন্টকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসবে, জিওসির নেতৃত্বে প্রেসিডেন্টকে জিম্মি করে দাবি আদায় করা হবে। এই ক্ষেত্রেও যদি প্রেসিডেন্ট অসহযোগিতা প্রকাশ করেন বা অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ করেন তাহলে একমাত্র রাস্তা খোলা থাকবে, হত্যা। সৌভাগ্যবশত বা ঘটনা পরম্পরায়, দায়িত্ব দেওয়া বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর ব্যাটালিয়নটি পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের অবস্থান থেকে, সময়মতো চট্টগ্রাম সেনানিবাসে এসে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু বাস্তবায়িত না হলেও, পরিকল্পনাটি অসমর্থিতভাবে গোয়েন্দাদের কানে চলে আসে।
২৯ মে ১৯৮১ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন; মূল কাজ ছিল রাজনৈতিক এবং তার মধ্যেও বিএনপি দলীয় রাজনৈতিক কর্ম। এই সুযোগটি ষড়যন্ত্রকারীরা কাজে লাগায়। প্রশ্ন: সুযোগটি কী? উত্তর: প্রেসিডেন্টকে হাতের নাগালে পাওয়া। প্রশ্ন: সুযোগটি কী কাজে লাগালেন? উত্তর: তাঁকে হত্যা করা। ৩০ মে ১৯৮১ সালের পূর্বেকার দিনগুলোতে, ষড়যন্ত্রকারীগণ জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বা কী কী প্রস্তুতি নিয়েছিলেন অথবা কেনই বা তাদের একাধিক ষড়যন্ত্র সফল হয়নি, এই কথাগুলো বিভিন্ন জ্ঞানী ব্যক্তিগণ তাঁদের পুস্তকে লিখেছেন, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় জার্নালে। দুটি বইয়ের রেফারেন্স এখানে দিচ্ছি। প্রথম বইটির নাম: ‘মিশ্র কথন’; লেখকের নাম: মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক; প্রকাশক: অনন্যা ২০১১ সাল (বইটি এখন ই-বুক হিসেবে পাঠকের জন্য উন্মুক্ত। দ্বিতীয় বইটি ইংরেজি ও বাংলা ভাষার বই, নাম: ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ: এ পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফী’; লেখকের নাম: মাহফুজ উল্লাহ; প্রকাশক: এ্যাডর্ন পাবলিকেশন, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৬। প্রথম বইটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে জিয়াউর রহমানের মৃত্যু প্রসঙ্গে; অপরপক্ষে দ্বিতীয় বৃহৎ বইটি পুরোটাই হলো জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক জীবনী। মাহফুজ উল্লাহর বইটি, একটি অনবদ্য রচনা, আগ্রহীদের জন্য অপরিহার্য পাঠ।
মানুষ মরণশীল; প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও মরণশীল ছিলেন। জীবন ও মৃত্যু মহান আল্লাহ তায়ালার হাতে; এখানে বান্দার হাত রাখার কোনো জায়গা নেই। মানুষ হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কোনো না কোনোদিন মারা যেতেন। পৃথিবীর বহু দেশের বহু রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বা জাতীয় নেতা দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। আমাদের দেশে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, পরিবশগত কারণে শাহাদত বরণ করেছেন। কিন্তু স্মৃতিতে অমর। চট্টগ্রাম মহানগরের ষোলোশহরে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে, ২৬ মার্চ ১৯৭১ এর প্রথম প্রহরেই তিনি পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে, প্রথমে নিজের নামে ও নিজের দায়িত্বে ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নামে পুনরায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। নয় মাস যাবত সেক্টর কমান্ডার এবং ফোর্স কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তথা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। অতঃপর একজন শৃংখলামুখী অফিসার হিসেবে ১৯৭৫ এর ২৪ আগস্ট সকাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান হিসেবে চাকরি করেন। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী প্রধান হন। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫, যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব টলটলায়মান ছিল, তখন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সুদৃঢ়ভাবে, প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনীর এবং পরোক্ষভাবে পুরো জাতির হাল ধরেন। তিনি ছিলেন জনগণের হৃদয়ের মানুষ। তিনি ছিলেন কাজের মানুষ। সামরিক শৃংখলাকে, সামরিক আবেগকে তিনি উন্নয়ন কর্মকাÐে নিয়ে আসেন। তাঁর দূরদৃষ্টিমূলক, রাষ্ট্রনায়কোচিত কর্মকাÐের কারণে, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে প্রথম পা রাখে; বাংলাদেশ পৃথিবীর জাতিসমূহের মিলনমেলায় নিজের নাম উজ্জ্বলভাবে প্রস্ফুটিত করে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলো, তাৎক্ষণিক প্রতিবেশী অমুসলমান দেশগুলো এবং বিশ্বের নেতৃত্ব প্রদানকারী পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সঙ্গে, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ইরাক এবং ইরান এর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল; উভয় পক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐ যুদ্ধ নিরসনের লক্ষ্যে যেই তিন সদস্যের তথা তিনজন রাষ্ট্রপ্রধানের কমিটি করা হয়েছিল, সেই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। সর্বোপরি সবেমাত্র উদীয়মান সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি চীন এর সঙ্গে যুগপৎ ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক বিরোধীগণ, তাঁর সমালোচনা করতেই পারেন। কিন্তু বিশ্লেষণমূলক ব্যক্তিগণ বিনা দ্বিধায় বলবেন যে, জিয়াউর রহমান সমন্বয়ের রাজনীতি, সহনশীলতার রাজনীতি, সমঝোতার রাজনীতি ও বহুদলীয় রাজনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। গবেষকগণ স্বীকার করেন যে, তিনি উন্নয়ন কর্মকাÐে তৃণমূল মানুষের অংশগ্রহণে বিশ্বাস করতেন, কঠোর শৃংখলায় বিশ্বাস করতেন এবং নিজেকে দুর্নীতির ঊর্ধেŸ রাখায় বিশ্বাস করতেন। তিনি তরুণ ও মেধাবীদেরকে রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে তিনি সেনাপতি থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়েছিলেন; তিনি বন্দুকের যোদ্ধা থেকে কোদালের কর্মী হয়ে দেশ গড়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিলেন। মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর এবং তার সঙ্গীরা, নিজেদের প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, তারা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে ভুল করেছিলেন। যারা জিয়াউর রহমানকে ভালোবাসেন, তাদের অনুভূতি হলো, জিয়াউর রহমান, ১৯ দফার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জন্য একটি ভিশন তুলে ধরেছিলেন। জিয়া প্রেমিকদের অনুভূতি হলো, জিয়ার অনুসরণের মধ্যই বিএনপির সাফল্যের চাবিকাঠি নিহিত।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।