Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতের ছায়ামুক্ত হচ্ছে ভুটান

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৮ মে, ২০১৮, ১০:৪১ পিএম

ভুটান ও ভারত চলতি বছর তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর উদযাপন করছে। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ২১ ফেব্রæয়ারি নয়া দিল্লিতে আনুষ্ঠানিকভাবে বছরব্যাপী উদযাপনের সূচনা করেন। ভারত-ভুটান সম্পর্ককে সাধারণত দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিবেচনা করা হয়: সরকারি উষ্ণ সংস্কারণ এবং মৃদু উষ্ণ জনগণ পর্যায়েল সংস্করণ।
সরকারি চশমা দিয়ে দেখা
নয়া দিল্লিতে গত ফেব্রুয়ারিতে বক্তব্য রাখার সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ভুটানের সাথে ভারতের বিশেষ ও নজিরবিহীন মৈত্রী ও সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা, সর্বোচ্চ বিশ্বস্ততা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ওপর দুই দেশের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত।
নয়া দিল্লির সাথে ভুটানের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক শুরু হয়েছিল ১৯৫৮ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহেরলাল নেহরুর সফরের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সালে। ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ভারতে নিযুক্ত কানাডার পন্ডিত-রাষ্ট্রদূত, নেপাল ও ভুটানে নিযুক্ত নন-রেসিডেন্ট রাষ্ট্রদূত ডেভিড এম ম্যালন বলেন, তারপর থেকে ভারত ও ভুটানের মধ্যকার সম্পর্কে মূল বিষয় ছিল ভারতের হাতে প্রতিরক্ষার ভার অর্পণ করে দিয়ে ভারতের কাছ থেকে সহায়তা লাভ। মূলত চীনকে সামনে রেখে এমন কাজ করা হয়। বস্তুত, দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশে সা¤প্রতিক সময়ে ভারতের ভাবাবেগ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে এই কারণে যে ভুটান তার বৃহৎ প্রতিবেশী ও এর ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগের প্রতি দৃঢ়ভাবে অবস্থান গ্রহণ করেছে। সরকারি বক্তব্যে বলা হচ্ছে, দুই দেশের সম্পর্ক টেকসই, দৃষ্টান্তমূলক ও পারস্পরিক কল্যাণকর। অবশ্য বাস্তবে ওই সম্পর্ক ততটা নমনীয় নয়। এটি কেবল দুই দেশের ভৌগোলিক আকারের কারণেই নয়, সেইসাথে ভুটানের প্রতি শীর্ষ ভারতীয় কর্মকর্তাদের উন্নসিকতার আলোকেও। আর ভুটানে ১৯৪৯ সালের চুক্তির ধারা ২ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষোভ রয়েছে। তাছাড়া দেশটির অর্থনৈতিক নাজুকতা ও দক্ষিণের প্রবেশদ্বার নিয়ে ভারতের সব বিষয়ে খবরদারি নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে। ভুটানিরা সবসময়ই ১৯৪৯ সালের চুক্তির ২ নম্বর ধারাটি যে বৈষম্যমূলক তা বলে থাকে। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বলবত থাকা ওই ধারায় বলা হয়েছিল: ভারত সরকার ভুটান প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। আর ভুটান সরকার পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের উপদেশে চালিত হবে। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২ নম্বর ধারাটি পরিবর্তন করে বলা হয়: ভুটান ও ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ মিত্রতা ও সহযোগিতা বজায় রাখার জন্য ভুটান ও ভারত একে অপরের জাতীয় স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো নিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করে যাবে। কোনো দেশই অপর দেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর কোনো তৎপরতায় তাদের দেশের ভূখন্ড ব্যবহৃত হতে দেবে না।
২০০৭ সালের চুক্তিটি অধিকতর সমান অবস্থানে পুনঃকাঠামোভুক্ত করা হয়েছে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ২ নম্বর ধারায় আরো সম্মানজনক করার মাধ্যমে ভারত ঠিক কাজটিই করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতি সাড়া দিয়ে ভুটানকে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারে সক্ষম সার্বভৌম দেশের মর্যাদা দিয়েছে ভারত।
সাধারণ ভুটানিরা কী বলে
ভুটানে ভারতবিরোধী ভাবাবেগ দৃশ্যমান হয় ২০১৩ সালে। ওই সময় দেশটিতে দ্বিতীয় পার্লামেন্টারি নির্বাচন হতে যাচ্ছিল। ভারত সরকার হঠাৎ করেই কেরোসিন ও রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি কমানোর ঘোষণা দেয়। ভুটানি জনগণ এটিকে তাদের তীব্র প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ নির্বাচনে ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপ বিবেচনা করে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, নয়া দিল্লি চেয়েছিল, ক্ষমতাসীন সরকার যেন হেরে যায়। কারণ ভর্তুকি প্রত্যাহারের সাথে সাথে জ্বালানি ও রান্নার গ্যাসের দাম বেড়ে যাবে বলে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল। বিরোধী দল একে ইস্যু করে বলে, ভুটান তার ঘনিষ্ঠতম মিত্রকে হারিয়েছে। ফলে বিরোধী দল বিপুলভাবে জয়ী হয়। ভুটানের রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে ভর্তুকি হ্রাস ছিল ভুটানকে জিম্মি করার ভারত সরকারের প্রয়াস। তাছাড়া সমালোচকেরা মনে করতে থাকেন, নেপাল গেমই খেলছে ভারত।
ভুটান চলতি শরতে তৃতীয় পার্লামেন্টারি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে ভারতীয় হস্তক্ষেপ আবার উত্তপ্ত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। সামাজিক মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, থিম্পুর নতুন অনভিজ্ঞ সরকারের প্রতি ভারতের আগ্রহের এত কারণ কী?
শিক্ষিত ভুটানিরা বৈষম্যপূর্ণ সম্পর্ক নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করছে। তাদের এই শঙ্কার উৎস হলো তাদেরকে ভারতের ছায়ায় বাস করতে হওয়ায়। ১৯৭১ সালে ভারতের উদ্যোগেই জাতিসঙ্ঘের সদস্য হয় ভুটান, দেশটির তিনটি পঞ্চবার্ষিকী উন্নয়ন পরিকল্পনায় অর্থায়ন করে ভারত। ২০০৭ সালে মৈত্রী চুক্তি সংশোধনের পর ভুটান তার পররাষ্ট্র সম্পর্ক নির্ধারণে অনেক বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। বর্তমানে ৫২টি দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে তার। তবে থিম্পুতে কেবল ভারত ও বাংলাদেশের আবাসিক দূতাবাস রয়েছে।
এক বিশেষজ্ঞ বলেন, ভৌগোলিক কারণেই ভারতের বাইরের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভুটানের অবস্থান বেশ নাজুক। ভারতের ওপর ভুটানের পুরোপুরি নির্ভরশীলতা নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অনেক ভুটানিই এই নির্ভরশীলতা কাটাতে চান। কর্ম তেনজিয়াল বলেন, ভুটানের উচিত ভারতের ছায়া থেকে বের হয়ে আসা। তিনি বলেন, ভারতের সাথে আমাদের আরো গভীর পর্যায়ে সম্পৃক্ত হতে হবে। তবে একইসাথে অন্যান্য দেশের (উদাহরণ হলো থাইল্যান্ড) সাথেও আমাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালকে নিয়ে গঠিত উপ-আঞ্চলিক বøক বিবিআইএন-কে ভুটান সন্দেহের চোখে দেখছে। মোটরযান চলাচলভিত্তিক এই চুক্তিটি তারা এখনো অনুস্বাক্ষর করেনি। জনগণ মনে করছে, এই চুক্তির ফলে ওইসব দেশের গাড়িতে ভুটানের ভঙ্গুর পার্বত্য রাস্তাগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। তাছাড়া এর ফলে তাদের কার্বনমুক্ত থাকার নীতি ক্ষুন্ন হবে, তাদের জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়বে।
নতুন সম্পর্কের সময়
গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভারতীয় কূটনীতিবিদ ও সিনিয়র নেতাদের স্পর্শকাতরহীন মন্তব্যের কারণেও ভারতবিরোধী ভাবাবেগ বেড়েছে। আবার ভারতীয় মিডিয়ায় মনে করছে, ভুটান যতটুকু পাওনা, ভারত দেশটিকে তার চেয়ে বেশি দিচ্ছে। কিন্তু ভুটানিরা মনে করছে ভিন্ন বিষয়। তাদের মতে, ভারতকে ভুটান যেসব সুবিধা দিচ্ছে, তার বিনিময়ে তারা পাচ্ছে সামান্যই।
অনেক ভুটানিই ২০১৭ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে দোকলাম অচলাবস্থার পর একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের আহŸান জানিয়েছেন। তারা চীনের সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি স্বাধীনভাবে করার পক্ষপাতী।
পারস্পরিক সহাবস্থানের মূলকথা
সম্ভবত জওহেরলাল নেহরুই ভারত-ভুটান সম্পর্কের সরকারি ভাষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তিনিই ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যতে ভুটানের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিব্বতে সরাসরি চীনা শাসন জারির এক বছর আগে ভুটানে পৌঁছে তিনি বলেছিলেন, ‘ভুটান ও ভারতের স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখা উচিত, যাতে বাইরের কেউ এর ক্ষতি সাধন করতে না পারে।’
ওই ভাবাবেগ এখনো দেখা যায়। আর ভুটান এখন চীনের সাথে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। ভুটানি নেতা ও নীতিনির্ধারকেরা চীন সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলতে সতর্ক। অবশ্য সামপ্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে মতবিনিময় বেড়েছে। আগের চেয়ে বেশি ভুটানি ব্যবসায়ী চীনাদের সাথে কাজ করছে, সংস্কৃতি বিনিময়ও হচ্ছে। ভুটানে চীনা পর্যটক বাড়ছে। আর স্বাভাবিকভাবেই এতে উদ্বিগ্ন ভারত।
অবশ্য দক্ষিণের প্রতিবেশীকে আহত করবে না ভুটান সরকার। ভুটানের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব মনে করে, ভারত-ভুটান মিত্রতা অভিন্ন মূল্যবোধ ও আকাঙ্ক্ষার ওপর নির্ভরশীল।
অবশ্য দুই দেশ যখন বন্ধুত্ব উদযাপন করছে, উভয় দেশের তরুণ জনগণের এই সম্পর্কের ব্যাপ্তি বোঝা উচিত। তাদের জানা উচিত, ভারত কিভাবে ভুটানকে তার পায়ের নিচে রেখে দিয়েছে, কিভাবে উত্তরে ভারতের প্রতিরক্ষা কৌশলে ভূমিকা পালন করছে।
সিনিয়র সাংবাদিক উগিয়েনপেনজর বলেন, ভারতের সাথে দৃঢ় বন্ধুত্বের মাধ্যমে ভুটান যতটা ফায়দা তুলতে পারবে, ভারতও ততটা বন্ধুত্ব বিকাশ ঘটাবে। কারণ দেশটি তার ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগ বোঝে। আমরা একে অপরের বাস্তবতা। সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ