Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কৃষকের স্বার্থ উপেক্ষিত

| প্রকাশের সময় : ৭ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম


গত বছর হাওর অঞ্চলে আকস্মিক ও আগাম বন্যায় বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রায় সব হাওরই ডুবে যায় এবং কৃষকরা ভরা ধান ঘরে তুলতে না পেরে সম্পূর্ণ অসহায় ও নিরালস্ব হয়ে পড়ে। হাওর অঞ্চলে বোরো ধানই একমাত্র ফসল যা দিয়ে হাওর অঞ্চলবাসীর সারা বছরের খাদ্যসংস্থান ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরণ হয়। বোরো ধানের এই উৎপাদন বিপর্যয়ে কৃষকরা চরম দুর্দশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হয়। এক বছর তারা দু:সহ জীবনযাপন করেছে। আশার বুক বেধে অপেক্ষা করেছে, ফের বোরো ধান উঠলে তাদের সুদিন আসবে। অত্যন্ত মর্মান্তিক বাস্তবতা এই যে, বোরো ধানের উৎপাদন এবার আশাতীত হলেও তাদের দিনবদলের সম্ভবনা তিরোহিত হতে বসেছে। ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে তারা শোচনীয়ভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। ধান বিক্রী করে উৎপাদন খরচ পর্যন্ত উঠছে না। একমন ধান উৎপাদনে যেখানে খরচ হয়েছে ৭০০ টাকার মতো, সেখানে সেই একমন ধান বিক্রী করতে হচ্ছে ৫৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকায়। এরমধ্যে নতুন উপসর্গও এসে উপস্থিতি হয়েছে। অকালবর্ষণ ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর কাজ ব্যহত হচ্ছে। ঠিকমত শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না এবং শ্রমিক-মজুরি অত্যাধিক। বজ্রপাতের ভীতিও কাজের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। একথাও কারো অজানা নেই, গত বছর হাওর অঞ্চলই শুধু নয়, উত্তরাঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলেও বোরো ধানের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এবার হাওর অঞ্চলের মতো গোটা দেশেই বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এবং দেখা যাচ্ছে, সর্বত্রই সমস্যা অভিন্ন। কোথাও ধানের উপযুক্ত মূল্য কৃষকরা পাচ্ছে না। ফলে তাদের মুখের হাসি হারিয়ে গেছে। স্বপ্ন দু:স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচও যদি না উঠে তবে কৃষকদের উদ্বিগ্ন, বিচলিত ও হতাশ হওয়াই স্বাভাবিক। এর প্রতিক্রিয়া হতে পারে ভয়াবহ। ঋণ-দেনার নিগড়ে তারা আটকে থাকতে পারে, তাদের সংসারের প্রয়োজন অপূর্ণ থাকতে পারে, একই সঙ্গে তাদের মধ্যে আবাদ-উৎপাদনে অনীহা তৈরি হতে পারে।
কৃষক যদি তার কোনো উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পায়, তবে সেই ফসলের আবাদ কমিয়ে দেয়। হয় জমি পতিত ফেলে রাখে, না হয় অন্যান্য ফসলের আবাদ করে। অতীতে আমরা দেখেছি, ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণেই কৃষক পাটের অবাদ কমিয়ে দিয়েছে, আখের আবাদ ছেড়ে দিয়েছে। অনুরূপভাবে এখন ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে যদি ধানের আবাদ তারা কমিয়ে দেয় তবে তাদের দোষ দেয়া যাবে না এবং সেক্ষেত্রে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। কৃষিফসলের ন্যায্যমূল্য নিয়ে প্রতি বছরই সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানে সরকারকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। কৃষক যাতে ধানের ন্যায়সঙ্গত মূল্য পেতে পারে, সে জন্য প্রতিবছরই লোক দেখানো ক্রয়অভিযান পরিচালনা করা হয়। এক্ষেত্রে সরকার এমন একটি নীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করে যাতে কৃষকের আসলে কোনো লাভ হয় না। লাভ হয় মধ্যসত্ত¡ভোগী ফড়িয়া-দালাল-ব্যবসায়ী ও মিলারদের। ধান ও চালের একটা দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয় বটে, তবে সেই নির্ধারিত দামে কৃষক ধান-বা চাল বিক্রী করতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা, সরকারের ক্রয়লক্ষ্য কোনো বছরই অর্জিত হয়না। চলতি বোরো মওসুমে ধান-চাল সংগ্রহের তেমন কোনো পদক্ষেপই দেখা যাচ্ছেনা। ধানের বাজার বস্তুত মধ্যসত্ত¡ভোগীদেরই নিয়ন্ত্রণে। শুরু থেকেই যদি সরকারের তরফে ধান-চলে সংগ্রহের উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যেমন অনেকটাই নিশ্চিত হতে পারে, একইভাবে সরকারের ক্রয়লক্ষ্য অর্জন ও তরান্বিত হতে পারে। যথাসময়ে যথাপদক্ষেপ নিতে সরকারের অনীহা ও ব্যর্থতার কারণ কি, সেটা একটি বড় প্রশ্ন। খবর পাওয়া গেছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সরকারের তরফে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করা হয়েছে। বেসরকারী পর্যায়েও যথেষ্ট পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে। জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৮৫টন চাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। আর আমদানি হয়েছে ১৫ লাখ ৪৬ হাজার ২৩৫ টন। আগে খোলা এলসিতেও চাল এসেছে। পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, ভারত থেকে আমদানিকৃত নি¤œমানের চালে বাজার ভরে গেছে। বোরো মওসুম শুরুর ঠিক আগ দিয়ে এই বিচার-বিবেচনাবর্হিভূত বিপুল চাল আমদানি কেন, তার জবাব আর কেউ নয়, সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকদেরই দিতে হবে। প্রশ্ন ওঠে সঙ্গতকারণেই, সরকার কি মধ্যসত্ত¡ভোগী এবং আমদানিকারকদের সুবিধা দেয়ার ব্যাপারেই অঙ্গীকারাবদ্দ? সরকারের কৃষকবান্ধব নীতি কি আমরা কখনোই প্রত্যক্ষ করতে পারবো না?
সরকারের উদ্দেশ্যমূলক নীতি-ব্যবস্থা, কৃষকদের প্রতি অবহেলা-উপেক্ষা এবং ত্রæটিপূর্ণ ও অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে দেশের কৃষক সমাজসহ সাধারণ খেটে খাওয়া ও স্বল্প আয়ের মানুষের দু:খ-দুদর্শার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। উন্নয়নজোয়ারের যত গালগল্পই শোনানো হোক না কেন, অধিকাংশ মানুষের জীবন কাটছে এখন দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যদিয়ে। সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা মাথাপিছু আয় ও জনগণের ক্ষয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলে দারিদ্র হ্রাসের যত সাফল্যই প্রচার করুন না কেন, বাস্তবে দরিদ্র বেড়েছে, মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে এবং আয়বৈষম্য হয়েছে সম্প্রসারিত। আমাদের সংবাদদাতা কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রামের কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষের দু:খ-দুদর্শা, অনিশ্চয়তা ও হতাশার যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা শুধু ওই এলাকার চিত্র নয়, গোটা দেশেরই চিত্র। তার প্রতিবেদনে একজন স্বল্প বেতনের দোকনকর্মচারী একটি টিনশেড রুমে কী করুণভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করে তার চিত্র যেমন উঠে এসেছে তেমনি ওই এলাকার কৃষকসহ সাধারণ মানুষ কী ভয়াবহ কষ্ট-যাতনা, ভীতি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে তার চিত্রও উঠে এসেছে। সেখানকার কৃষকরা এতটাই হতাশ যে, উৎপাদিত ধান ও ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে আবাদঘাট পর্যন্ত ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। ঋণ-দেনায় তারা এতটাই জর্জরিত যে, জমি-সম্পত্তি, গবাদিপশু, হাঁসমুরগী পর্যন্ত বেঁচে দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে। একদিকে নিদারুণ অভাব-দারিদ্র অন্যদিকে নিত্যপণ্যের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিতে তারা রীতিমত বেদিশা। এই সঙ্গে তাদের জানমালের নিরাপত্তা পর্যন্ত সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেছে। গ্রামবাংলার মানুষের এই বেহাল অবস্থা, এই দু:খ-দারিদ্র, দুর্দশা-অনিশ্চয়তা অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তব ও সত্য। যখন দেশের মানুষকে মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নয়নশীল দেশের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে তখন কৃষকসমাজ ও সাধারণ মানুষের এই নাজুক ও নতজানু অবস্থা দুভার্গ্যজনক। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান ৬০ শতাংশের অধিক। কর্মসংস্থানেও কৃষির অবস্থান শীর্ষে। বলা হয়, কৃষিই অর্থনীতির মূল স্তম্ভ, কৃষির উন্নতি মানেই দেশের উন্নতি। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কৃষি ও কৃষকই সবচেয়ে অবহেলিত। কৃষক ও জনবান্ধব নীতির অনুসরণ ছাড়া দেশের যর্থাথ উন্নয়ন ও গণমানুষের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করা যায় না। এই দিকটি আমলে নিয়ে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন ও সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্রতী হওয়ায় বিকল্প নেই। সরকার এদিকে ত্বরিত নজর দেবে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেবে, এটাই আমরা আশা করি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কৃষক


আরও
আরও পড়ুন