শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
পূর্বে প্রকাশিতের পর
বড় মেয়েটা কিছুক্ষণ আগে যে আমার গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করছিল তার নাম বর্ষা, মাদুরে ঘুমোচ্ছে মেঘ।
আমি তাদেরকে বাসায় নিয়ে এলাম। আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাবার পর সুচিত্রার বিয়ে হয়েছিল। স্বামী ছিল ট্রাকড্রাইভার। দুই বছর আগে রোড এ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে সে। স্বামীর গ্রামের বাড়িতে সম্বল বলতে সামন্য ভিটে ও ছোট একটা খড়ের ঘর ছিল। কয়েকদিন আগে বন্যার জলে সেটা তলিয়ে গেছে। অসহায় সুচিত্রা অসহায় দুই মেয়ে নিয়ে কোথাও ঠাঁই না পেয়ে শহরে এসে ওভারব্রিজের নিচে আশ্রয় নিয়ে ভিক্ষে করছে। বাসায় আসতে আসতে গাড়িতে বসে এ কথাগুলো আমাকে জানালো সুচিত্রা। বাসায় পৌঁছানো মাত্র লোকজন জড়ো হয়ে গেল তাকে দেখতে। আমার স্ত্রী তো প্রথমে চিনতেই পারে নি। যে মেয়েটি এক সময় আমাদের ঘরদোর দোকানের শো রুমের মতো ঝকঝকে, তকতকে করে রাখতো। সে মেয়েটি নিজেই এখন কেমন রোগা, লিকলিকে। কোথায় তার সেই নায়িকার মতো চেহারা, সাজগোজ।
আমরা সুচিত্রাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসেছি। আমার স্ত্রীর হুকুমে কাজের মেয়েটা বর্ষা আর মেঘকে খেতে দিয়েছে। খাবার পেয়ে তারা মুঠো ভরে খাচ্ছে। টি.ভিতে তখন উত্তম-সুচিত্রার বাংলা সিনেমা চলছিল, হারানো সুর। সুচিত্রা একবারও সেদিকে তাকাল না। ড্রয়িংরুমে বসে রইল মাথা নীচু করে।
আমার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই এখন কোথায় থাকিস?’
সুচিত্রা নির্বাক। তার মুখে কোনো ভাষা নেই। শব্দ নেই।
আমি বললাম, ‘সুচিত্রা, তুমি কি কোনো কাজ করতে চাও?’
এবার তার মুখে শব্দ জুটল। বলল, ‘হ, ভাইজান। আমার এক দূর সম্পর্কের খালা কইছে আমারে একটা গার্মেন্টসে কাজ যোগাড় কইরা দিব।’
‘কোথায় সেটা?’
‘সাভার। আগামী কালই আমারে যাইতে হইব। গেলেই জয়েন।’
‘ঠিক আছে চাকরি করো। তবে আর ভিক্ষা করো না।’
তারপর সুচিত্রা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। যাবার সময় আমার স্ত্র¿ী তার হাতে কিছু টাকা দিলে তার সে কি আনন্দ! এর দুই মাস পরে একদিন সুচিত্রা আমাদের বাসায় এসে জানালো, সাভারে গার্মেন্টসের সেই চাকরিটা পেয়েছে সে। আপতত দুই মেয়েকে নিয়ে একটি বস্তিতে উঠেছে। মাস শেষে বেতন পেলে ছোটখাটো একটা বাসা নেবে তারপর তার অফিসের ঠিকানা আমাকে দিয়ে চলে গিয়েছিল। সে-ই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। যে অফিসে সে চাকরি করত তার ঠিকানা লেখা কার্ডটি এখন আমার হাতে।
নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড
৩য় তলা [রানা প্লাজা]
সাভার, ঢাকা
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাঁদছি এখনো। একটু পর পর ধ্বংসস্তুপ থেকে আহত ব্যক্তি কিংবা মৃতদেহ উদ্ধার করে নিয়ে আসছে উদ্ধারকর্মীরা। শত শত স্বজন স্রোতের বেগে ছুটে যাওয়া কচুরিপানার মতো দৌড়ে ছুটছে সেদিকে। পাগলের মতো খুঁজে ফিরছে তাদের হারিয়ে যাওয়া মানুষটিকে। কেউ খুঁজে পায় জীবিত আহত লাশ, কেউ পায় থেতলানো মৃত লাশ, কেউবা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসে ধ্বংসস্তুপের সামনে। অপেক্ষায় অশ্রæসজল চোখে তাকিয়ে থাকে উদ্ধারকর্মীদের দিকে। এই বুুঝি উদ্ধার হয়ে এলো প্রিয় মানুষটি। সুচিত্রা ৩য় তলায় কাজ করত। জানি না সে বেঁচে আছে কিনা। যদি সে মরে গিয়ে থাকে তাহলে তার দুই মেয়ে বর্ষা ও মেঘের কী হবে? মেয়ে দুটো এখন কোথায় আছে? সুচিত্রার সাথে যখন আমার শেষবার দেখা হয় তখন সে বলেছিল মাস শেষে বেতন পেলে ছোটখাটো একটা বাসা নেবে। সে কি মাস শেষে বেতন পেয়ে বাসা নিয়েছিল? আমি তা জানি না। জানলে তার মেয়ে দুটোকে সেখান থেকে নিয়ে আসতে পারতাম। সাত দিন পার হয়ে গেল। সুচিত্রার জীবিত বা মৃত সন্ধান পেলাম না।
কেটে গেল আরো কিছুুদিন। এ ক’দিন আমি ধসে পড়া ভবন, সাভারে অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠ ও বিভিন্ন্ হাসপাতালে খুঁজে বেড়িয়েছি। কিন্তু কোথাও সুচিত্রার খোঁজ পাই নি। এর মধ্যে একজন উদ্ধারকর্মীর সঙ্গে কথা হল। সে বলল, ‘আপনি কাকে খুঁজছেন?’
আমি বললাম, ‘আমার এক আত্মীয়।’
‘কী নাম?’
‘নাম সুচিত্রা।’
‘সুচিত্রা নামে একজনকে ভেতরে চাপা পড়ে চিৎকার করতে দেখেছি। এমনভাবে আটকে ছিল, উদ্ধার করতে হলে বিম বা কলাম কাটতে হবে।’
আমি উদ্ধারকর্মীকে জাপটে ধরে কাঁদতে কঁাঁদতে বললাম, ‘ভাই, তাকে উদ্ধার করেন। তার দুটো বাচ্চা আছে। পৃথিবীতে সুচিত্রা ছাড়া তাদের আর কেউ নেই।’
উদ্ধারকর্মীটি চুপ করে শুধু আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। আমি দেখলাম আবেগ ছুঁয়ে গেছে তাকে। তার চোখ বেয়ে নেমে এসেছে অশ্রæবিন্দু। চোখের জল মুছে নিয়ে আমার হাতে একটা পরিচয়পত্র বাড়িয়ে দিল। তাতে সুচিত্রার নাম লেখা। আমি নির্বাক হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। সুচিত্রার জন্য নয়, তার দুটো মেয়ের জন্য। জানি না এখন তারা কোথায় আছে। আমি লাশের দুর্গন্ধ শরীরে নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।