পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পবিত্র কোরআনের ৯নং সূরার নাম ‘তওবা’। এ সূরার ৩৬নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় বারটি মাসের মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ।’ আয়াতে মাসগুলোর নাম, উল্লেখ না থাকলেও রমজান ও হজ্জ্বের মাসের নাম বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ আছে। ‘হজ্জ্ব’ নামক একটি স্বতন্ত্র সূরাও রয়েছে। আবার রমজান মাসের বরকতময় রাত, ‘আল কদর’ নামক আলাদা সূরাও রয়েছে অর্থাৎ লাইলাতুল কদরের কথা বলা হয়েছে। সূরা ‘দোখানে’ লাইলাতুন মোবারাকার তফসিরী ব্যাখ্যায় না গিয়ে বলতে হয়, অনেকের মতে ‘লাইলাতুন মোবারাকা’র অর্থ ‘শবে কদর’ হলেও কোন কোন বর্ণনায় উহা ‘শবে বরাত’ অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত। এ রাতের কারণেই ‘শাবান’ মাসকে ফজিলত বা মর্যাদাপূর্ণ করা হয়েছে। বর্ণনা রয়েছে, রসূলুল্লাহ (সা.) বারটি মাসের মধ্যে প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা ফজিলত, মাহাত্ম, তাৎপর্য ইত্যাদি ছাড়াও নানা বিষয়ের উল্লেখ করেছেন এবং শবে-বরাতের মাহাত্ম সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন। ‘শাবান’সহ অপরাপর সকল মাসের অস্তিত্ব প্রাচীনত্ব, গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং মাহাত্ম সম্পর্কে কেবল মাত্র আল্লাহদ্রোহীরাই প্রশ্ন তুলতে পারে।
শবে-বরাতের ফজিলত সংক্রান্ত বর্ণিত কিছু কিছু হাদীস মোহাদ্দেসীনে কেরাম বিতর্কিত সনদের কারণে বিশুদ্ধ বা শুদ্ধ মনে করেননি। এগুলোতে অনেক অতিরঞ্জণ ও বাড়তি কথা রয়েছে। হজরত আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (রহ.) তাঁর বিখ্যাত, ‘মা সাবাতা বিস্ সুন্নাহ’ গ্রন্থে শবে-বরাতের ফজিলত সংক্রান্ত জাল বা দুর্বল এবং বিতর্কিত হাদীসগুলো আলাদাভাবে উল্লেখ করেছেন এবং সহি হাদীসগুলোও আলাদাভাবে বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া লেখকের যুগে ‘শবে-বরাত’ উপলক্ষে ভারতে যেসব বেদা’ত, কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ^াস প্রচলিত ছিল তারও একটা তালিকা পেশ করেছেন।
আমাদের দেশে এক শ্রেণির লোকের মধ্যে ‘লাইলাতুল বরাআত’ বা ‘শবে-বরাত’ সম্পর্কে সংশয়-সন্দেহ বিরাজ করছে, এমনকি শবে-বরাতের অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগ সত্য হলে অবশ্যই বলতে হবে, ইসলামবিদ্বেষী শক্তিবর্গ, ইসলামের ছিদ্র-অনুসন্ধানী চক্রগুলো, যারা অহরহ ইসলামকে সন্দিগ্ধ ও সংশয় যুক্ত করে উপস্থাপনে আত্মনিয়োগ করেছে, ইতোমধ্যে তার বহু বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এসব ইসলাম বিরোধী ইসলামকে বিতর্কিত, বিকৃত ও সংশয়যুক্ত এবং হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য আত্মনিয়োগ করেছে। পবিত্র কোরআনকে পর্যন্ত বিকৃত করার জন্য ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মাত্র বছর খানেক আগেই পবিত্র মক্কা শরীফে শত শত বিকৃত কোরআন মজিদ সউদী কর্তৃপক্ষ বাজেয়াপ্ত করেছে। এগুলো বাইরে থেকে মক্কায় সরবরাহ করা হচ্ছিল বলে আমাদের দেশের সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়েছিল। এসব ইসলামবিরোধী অপশক্তি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অকাতরে নানাভাবে, নানা কৌশলে ব্যয় করছে এবং অর্থলোভীদের মধ্যে অতি সুকৌশলে বিতরণ করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। তাদের খপ্পরে পড়ে বিভ্রান্ত হওয়ার লোকের অভাব নেই।
যেসব অপশিক্ত পবিত্র কেরাআন বিকৃতির দুঃসসাহস করতে পারে, তারা লাইলাতুল বরাআতের অস্তিত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টির অপচেষ্টা করবে না, তা কীভাবে বিশ^াস করা যায়? ইসলামের হাক্কানী উলামায়ে কেরাম, মাশায়েখ, মসজিদের ঈমাম ও খাতিবগণ ‘শবে-বরাত’ উপলক্ষে প্রচলিত কুসংস্কারগুলোর বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার এবং লেখালেখি, বক্তৃতা, বয়ান-বিবৃতি এবং ওয়াজ-নছিয়ত ইত্যাদির মাধ্যমে কোরআন-হাদীসের আলোকে শবে-বরাতের অস্তিত্ব, মর্যাদা ও মাহাত্মকে সমুন্নত করে চলেছেন। কিন্তু ইসলামে সংশয় সৃষ্টিকারীরা শবে-বরাতের অস্তিত্ব, মর্যাদাকে প্রশ্ন বিদ্ধ ও ক্ষুণœ করার অপচেষ্টায় ব্যস্ত।
বিভিন্ন হাদীস হতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, শাবানের মাস আল্লাহর এবাদত-বন্দেগির জন্য অত্যন্ত উত্তম। এই মাসে একজন মুসলমানের জন্য সঠিক কর্মপন্থা হবে এই যে, অধিক পরিমাণে আল্লাহর এবাদত-বন্দেগি ও তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। হযরত আবদুল কাদের জীলানী (রহ.) বলেছেন, ‘মাহে শাবানে আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর বান্দাগণের ওপর বড় বড় দান করা হয় এবং তাদের জন্য পূণ্যের দ্বার উন্মুক্ত ও তাঁর অশেষ রহমত নাযিল করা হয়।’
আরবী ‘লাইলাতুল বরাআত’ কথাটিকে প্রচলিত ভাষায় ‘শবে-বরাত’ বলা হয়। ‘শব’ শব্দটি ফারসি। তার অর্থ রাত্রি। এটি আরবী ‘লাইলাতুন’ শব্দের সাথে সমার্থবোধক। ‘বরাত’ শব্দটি আরবী ‘বরাআত’ শব্দের অপভ্রংশ। তার অর্থ ‘মুক্তি’। এক কথায় ‘লায়লাতুল বরাআত’ শব্দটির অর্থ ‘মুক্তির রাত্রি’। সুতরাং ‘শবে-বরাত’ কথাটির অর্থও তাই।
ইসলামী বিধি অনুসারে ‘শাবান’ মাসের ১৪ই দিবাগত রাত্রিকে ‘লাইলাতুল বরাআত’ বলা হয়। হযরত রসূলেপাক (সা.) তাঁর পবিত্র হাদীসসমূহে রাত্রিটির অনেক গুণকীর্তন করে গেছেন। হযরত (সা.) বলেন, ‘যখন শাবানের ১৪ই দিবাগত রাত্রি আসবে তখন তোমরা অধিক পরিমাণে নামাজ পড় এবং পরের দিন রোজা রাখ। কারণ, আল্লাহপাক ঐদিন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম আসমানে রহমতের সাথে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ আমার কাছে মাফ চাইবে, আমি তার গোনাহ্ মাফ করে দেব। যে কেউ রিজিক চাইবে, আমি তার রিজিক বাড়িয়ে দেব, যে কেউ রোগ হতে মুক্তি চাইবে, আমি তার মুক্তিদান করব’।
‘শাবান’ মাসের পরই পবিত্র ‘রমজান’ মাস। বিশ^ মুসলিমের সিয়াম সাধনের নির্দিষ্ট কাল। ‘লাইলাতুল বরাআত’ প্রকৃতপক্ষে তারই আগমন বার্তা নিয়ে আসে পক্ষকাল পূর্বে। একটি মাত্র সাওম বা রোজার মাধ্যমে সবাইকে সর্তক করে দেয়; ‘সাবধান হয়ে যাও পক্ষকাল পরেই তোমাদের সিয়াম সাধনের সময় উপস্থিত হচ্ছে।’ তেমনি একটি মাত্র রাত্রির নামাজের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘পক্ষকাল পরে এমনি প্রতিটি রাত্রিতে তোমাদেরকে নামাজ ও বন্দেগির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’ তা হল রমজানের ‘তারাবীহ’।
হযরত রসূল করীম (সা) শাবানের শেষ পনের দিন রোজা রাখতে নিষেধ করতেন। তিরমিজি শরীফে এ সম্বন্ধে হযরতের পরিষ্কার হাদীস রয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন শাবানের প্রথম পনের দিন অতিবাহিত হয়ে যাবে তখন বিগত বছরের কাজা রোজা ব্যতীত অন্য কোন রোজা রাখবে না।’ এতে ভালরূপেই বুঝতে পারা যায় যে, ‘শাবান’ মাস হতে ‘রমজান’ মাসের কৃচ্ছসাধনার জন্য এ মাসে সবাইকে প্রস্তুত হতে হযরত (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন। রমজানে সারা মাস রোজা রাখতে হবে, এই কারণে শাবানের শেষ পনের দিন ভালরূপে খাওয়া-দাওয়া করে শরীর মজবুত করার জন্য হযরত (সা.) উল্লেখিত হাদীসটিতে ইঙ্গিত করেছেন। বর্তমান সময়ে এতদুদ্দেশ্যে ‘শাবান’ মাসের প্রথম পনের দিনই খাওয়া-দাওয়ার ধুম পড়ে যায়। আর শেষের পনের দিনের কথা কেউ মুখেই তোলে না। অনুরূপভাবে ‘লাইলাতুল বরাআত’ উপলক্ষে দেশের প্রায় সর্বত্র খুব বেশিভাবে মোমবাতি জ¦ালানোর ব্যবস্থা করা হয়। কোন কোন অঞ্চলে লোকজন মসজিদের প্রতি ইঞ্চিতে একটি করে মোমবাতি জ¦ালিয়ে দেয়। কোন অঞ্চলে এ রাত্রিতে পুকুরগুলিতেও সুপারী পাতার খোলা, মোমবাতি জ¦ালিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া সর্বত্রই পাকা কবর ও অন্যান্য কবরস্থানে মোমবাতি জ¦ালানো, শহরে-বন্দরে সর্বত্রই আতশবাজী, পটকা প্রভৃতির দৌরাত্ম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বস্তুত এই সমুদয় কার্য যে কতদূর গর্হিত এবং ইসলাম বহির্ভূত, অনেকেই তা চিন্তা করার প্রয়োজন মনে করে না। আল্লামা শাহাবুদ্দীন মাহমুদ আলুসী বাগদাদী তাঁর প্রণীত বিশ^বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ রুহুল মাআনীতে লিখেছেন, সর্বপ্রথম ঐ ধরনের রাত্রিগুলোতে অধিক সংখ্যক বাতি জ¦ালানোর ব্যবস্থা করেছিল খলিফা হারুণ-অর-রশীদের কুখ্যাত উজির বংশ বারামেকাগণ। কারণ তাদের পূর্ব পুরুষগণ অগ্নি উপাসক ছিল এবং সম্ভবত এই জন্য তাদের অগ্নিপূজার অভ্যাসটি তারা পাল্টাতে সক্ষম হয়নি। লাইলাতুল বরাআত উপলক্ষে বেশি সংখ্যক বাতি জ¦ালানোর আর একটি কারণ সম্ভবত প্রতিবেশী কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের দীপালি পূজার প্রভাব।
শিক্ষা-দীক্ষায় বঞ্চিত থাকার কারণে আমাদের এক শ্রেণির মুসলমান, যে এহেন পবিত্র লাইলাতুল বরাআত উপলক্ষে অমুসলমানদের ধর্মনীতি অনুসরণ করে চলছে তা খুবই বেদনাদায়ক। নানা প্রকার বেদা’ত এবং কুসংস্কারের ফলে পবিত্র শবে-বরাতের মর্যাদাও দারুণভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। মুসলিম সমাজে ‘শবে-বরাত’ উপলক্ষে যেসব কুসংস্কার প্রবল হয়ে আছে তা সংখ্যায় নিতান্ত কম নয়।
নিচের একটি ক্ষুদ্র তালিকা হতে এর ভয়াবহ চিত্র সহজেই অনুমেয়। এই তালিকা বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থের আলোকে প্রণীত হয়েছে। যথা- ১. হালুয়া-রুটির বিশেষ আয়োজন করা, ২. আতশবাজী, ৩. আলোকসজ্জা, ৪. পীর-দরবেশগণের মাজার পূজা, ৫. হাতি-ঘোড়ার কৃত্রিম ছবি রাখা, ৬. রাত্রে মাইকযোগে কোরআন তেলাওয়াত, ৭. মৃত আত্মীয়-স্বজনদের রুহের আগমনে বিশ^াস করা, ৮. মসজিদে মোমবাতি ও আগরবাতি জ¦ালানো, ৯. নাচ-গান ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করা, ১০. নানা প্রকার খেলাধুলা ইত্যাদি।
অজ্ঞ ও অন্ধ বিশ^াসীরা মনে করে থাকে যে, শবে-বরাতে ইসলামের দ্বিতীয় ‘ওহোদ’ যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং সে যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর দন্ত মোবারক শহীদ হলে তিনি হালুয়া জাতীয় এক প্রকারের নরম জিনিস খেয়েছিলেন। শবে-বরাতের ‘হালুয়া প্রথা’ সম্বন্ধে এই যুক্তি যে কতই ভিত্তিহীন তা ইসলামী ইতিহাসের একজন সাধারণ ছাত্রও বলতে পারে। ওহোদ যুদ্ধ শবে-বরাতের সময় সংঘটিত হয়েছিল বলে আজ পর্যন্ত কোন ঐতিহাসিক লেখেননি। প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধ ‘শাওয়াল’ মাসেই হয়েছিল, শবে-বরাতে নয়। হযরতের দন্ত মোবারক শহীদ হয়েছিল সত্য, কিন্তু তিনি যে হালুয়া খেয়েছিলেন তার প্রমাণ কি? হালুয়া খেয়ে থাকলেও শবে-বরাতের সাথে এর কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
মূলত এটা একটি ধর্মবিগর্হিত কুসংস্কার মাত্র। শবে-বরাত বা ধর্মের সাথে এর কোন স¤পর্ক নেই। হ্যাঁ, ঐ রাতে হযরত (সা.) আহলে বাকির ন্যায় শহীদানে ওহোদের জন্য মাগফেরাত কামনা করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এতে খুব জোরে এইটুকু প্রমাণ করা যায় যে, শবে-বরাতে মুর্দাদের মাগফেরাত ও তাদের রুহের সওয়াব রেছানীর জন্য দোয়া এস্তেগফার করা ভালো। এরূপ করা শরীয়তের পরিপন্থী নয়, কিন্তু হালুয়া-রুটি প্রথা যে একেবারে কুসংস্কার তা বলাই বাহুল্য। এ প্রসঙ্গে ফাতেহাখানী প্রথাও বেদা’ত বা কুসংস্কারের বহির্ভ‚ত নয়। ইসলামে এরূপ কার্যকালাপের কোন স্থান নেই।
‘শবে-বরাত’ উপলক্ষে আতশবাজী একটি ঘৃণ্য কুসংস্কার। প্রথম প্রথম এটা প্রতিযোগিতা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালিত হতো। কিন্তু বর্তমানে আতশবাজী ছেলে-ছোকরাদের খেলার মধ্যেই সীমিত রয়েছে। তখন হতে এই কুপ্রথা মুসলিম সমাজে প্রচলিত হলে তার সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও এটা অনায়াসে বলা যায়, আতশবাজী হিন্দুদের দেয়ালী উৎসব হতে আমাদের মধ্যে প্রবেশ করেছে। হিন্দু সমাজে এখনও এ উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এতদুপলক্ষে তারা গৃহগুলি আলোকসজ্জায় সজ্জিত করে থাকে, সারারাত্রি জাগ্রত থেকে জুয়াখেলার আসর বসায় এবং আতশবাজীর প্রদর্শন করে আনন্দ উপভোগ করে। কিন্তু তাজ্জবের বিষয় এই যে, আজ আমাদের মুসলিম সমাজেও এ কুপ্রথা হরদম চলছে।
হালুয়া-মিষ্টি বিতরণের যেমন একদিকে অর্থের অপচয় হচ্ছে, তেমনি আতশবাজী বাবদও অজস্র টাকা-পয়সার অপব্যবহার হচ্ছে। অথচ পবিত্র কোরআন স্পষ্ট ঘোষণা করছে- ‘ইন্নাল মোবাজ্জেরিনা কানু এখওরানশ শায়াতিন।’ অর্থাৎ অপচয়কারীগণ শয়তানের ভ্রাতা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আমি হযরত রাসূলে করীম (সা.) কে বলতে শুনেছি যে, অপচয়কারী নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতার গুণাহে লিপ্ত হয়ে যায় এবং কোন কোন সময় এই পাপের সাজা দুনিয়াতেও পেয়ে থাকে।’ এতে অনুমান করা যায় যে, অপচয় ও অপব্যবহার কতই নিন্দনীয় এবং ঘৃণ্য কাজ। এ সম্বন্ধে ইসলাম আমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছে যে, প্রথমে হালাল উপার্জন করতঃ নিজের সন্তান-সন্ততিদের প্রয়োজনাদি পূরণ করবে, অতঃপর সম্ভব হলে অভাব গ্রস্তদেরকে জাকাত-সদকার অধিকারে অধিকারী করা হয়েছে, সক্ষম লোকদিগের ওপর জোর প্রদান করা হয়েছে, তারা যেন আল্লাহর রাহে অকাতরে দান করে। অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করে। কিন্তু আজ আমরা তার প্রদত্ত টাকা-পয়সা নিজেদের খেয়াল খুশিমত খরচ করছি এবং আমরা এতই বেপরোয়া হয়ে গেছি যে, আল্লাহর কাছে এর কি উত্তর দিব সে কথাও একবার ভেবে দেখি না।
শবে-বরাতের প্রচলিত বেদা’তগুলো সম্বন্ধে শেখ আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী (রা.) ‘মা সাবাতা বিস্ সুন্নাহ’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শবে-বরাত’ উপলক্ষে আলোকসজ্জা করা, চেরাগ জ¦ালিয়ে দেয়ালে রাখা, আতশবাজী এবং এ কাজের জন্য সমবেত হওয়া ঘৃণ্য বেদা’ত। হিন্দুস্থান ছাড়া অন্য কোথাও এরূপ প্রথার অস্তিত্ব নেই। এই প্রথা তারা (মুসলমানেরা) হিন্দুদের নিকট হতে আমদানি করেছে। তারা (হিন্দুরা) যেরূপে দেয়ালীতে বাতি জ¦ালায়, আমরা বর্তমানে তার অনুসরণ করছি। মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে মেলামেশার ফলেই এরূপ হওয়া সম্ভব হয়েছে। এতে সহজে অনুমান করা যায় যে, ইসলামে এসব কুপ্রথা ও কুসংস্কারের কোন স্থানই নেই।
এক শ্রেণির মুসলমানের ধারণা, শবে-বরাতে মৃত আত্মীয়-স্বজনের রুহ্ জীবিতদের ঘরে আগমন করে থাকে। তাই মৃত রুহের অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের জন্য গৃহ আলোক সজ্জার আয়োজন করা একান্ত আবশ্যক, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বিছানার প্রয়োজন এবং লোটাতে পানি ভরে রাখা চাই, ইত্যাদি ইত্যাদি। ‘শবে-বরাত’ উপলক্ষে জীবিতদের গৃহে মৃত আত্মীয়দের আত্মা আগমনের এ ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক এবং ভিত্তিহীন। পবিত্র কোরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসে এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। যুক্তি ও জ্ঞানের দিক দিয়েও এ ধারণা সমর্থনযোগ্য নয়। উক্ত রাতে মৃত আত্মীয়ের আগমন উপলক্ষে যেসব বিশেষ আয়োজন করা হয় তা শরীয়ত বিরোধী। অবশ্য সেই রাতে মুর্দাদের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করা খুব ভালো কাজ। এক হাদীসে হযরত (সা.)-এর কবরস্থানে গমনের যে উল্লেখ পাওয়া যায়, তার উদ্দেশ্যও মৃত ব্যক্তিদের জন্য দোয়া করা এবং নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণ করা। কিন্তু বর্তমানে ঐ রাত্রিতে মাজার জেয়ারতকে একটি তামাশায় পরিণত করা হয়েছে। ‘তালবিসে ইবলিস’ নামক পুস্তকে একারণেই বলা হয়েছে যে, শবে-বরাতে কবরস্থানে গমন, এতে বাতি জ¦ালানো এবং বুজর্গদের কবরের মাটি আনা এগুলো মূর্খ ও অজ্ঞ লোকদের কাজ। আমাদের মুসলমানের মধ্যে আরও এক শ্রেণির লোক আছে, যারা নির্মিত কৃত্রিম হাতি-ঘোড়ার ছবি রেখে তার ওপর বাতি জ¦ালায় অথচ ইসলামে মূর্তি রাখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘শবে-বরাতে আল্লাহপাক বান্দাদের ওপর অসীম রহমত এবং দয়া প্রদর্শন করে থাকেন। কিন্তু মোশরেক, বিদ্বেষী, হিংসুটে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী এবং অত্যাচারী ও অন্যায়ভাবে হত্যাকারী এসব লোক আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত থাকে।’
শবে-বরাতে আল্লাহর রহমত হতে যারা বঞ্চিত থাকে বলে বিভিন্ন সূত্র হতে জানা যায়, তাদের একটি তালিকা নি¤েœ পেশ করা হলো। তালিকাটি এই: ১. আত্মীয়তা বিচ্ছিন্নকারী, ২. মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, ৩. মদ্যপায়ী, ৪. জেনাকারী, ব্যভিচারী, ৫. টাখনোর নিচে কাপড় পরিধানকারী (পুরুষ), ৬. অন্যায়ভাবে ট্যাক্স আদায়কারী, ৭. যাদুকর, ৮. জ্যোতিষী, ৯. ভবিষ্যদ্বক্তা, ১০. অন্যায়কারী, অত্যাচারী পুলিশ, ১১. লোকের মাল অন্যায়ভাবে শাসন কর্তার নিকট প্রদানকারী, ১২. যে ব্যক্তি ‘নরদ’ খেলে (এটি দাবার ন্যায় এক প্রকারের ক্রীড়া), ১৩. যে ঢোল ও বাদ্যযন্ত্র বাজায় (মজিমুআয়ে ছা’দাত ১৬৮-১৬৯) ইত্যাদি।
আজকাল বিভিন্ন শহরে-বন্দরে মাইকযোগে কোরআন পাঠ, মসজিদে মোমবাতি, আগরবাতি জ¦ালানো, বিভিন্ন রকমের নাচ-গান এবং খেলাধুলাকে শবে-বরাতের একটি আকর্ষণীয় বস্তু এবং এরূপ কার্যকালাপকে ধর্মীয় উৎসব হিসাবে পালন করার প্রবণতা দেখা যায়। ইসলামে এরূপ কুসংস্কারের অনুমতি নেই। বিশেষত ঐ রাত্রে কিংবা অন্যান্য রাতগুলোতে মাইকে কোরআন পাঠের যে প্রতিযোগিতা চলে, এতে নাগরিক জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। হাসপাতালগুলোতে ও অন্যান্য স্থানের রোগীদের যে কতই অসুবিধা ভোগ করতে হয়, তা অকল্পনীয়। এতে পবিত্র কোরআনেরও অবমাননা হয়। নামাজীরা যতক্ষণ মসজিদে এবাদত করে, ততক্ষণ তাদের আলোর প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু ঐ রাত্রে মসজিদকে ‘প্রদর্শনী’ হিসেবে সজ্জিত করা এবং সহ¯্র মোমবাতি জ¦ালিয়ে অর্থের অপচয় করার বিধান ইসলামে নেই।
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, হুজুর (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘শবে-বরাতে আল্লাহপাক তার বান্দাদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং সকলকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মোশরেক ও হিংসুককে ক্ষমা করেন না।’ (ইবনে মাজা) এই মর্মের হাদীস বায়হাকী ও অন্যান্য কিতাবেও আছে। পরিশেষে একটি কথা অপ্রিয় হলেও বলে রাখা দরকার যে, ইসলামে একটি নীতি বাক্য আছে, ‘আল হক্কুমা শাহিদাত বিহিল আ’দাও’, অর্থ্যাৎ সত্য ওটাই যার প্রতি শত্রæরাও সাক্ষ্য দান করে। এরূপ দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় ভুরি ভুরি রয়েছে। তবে এখানে একটি মাত্র উদাহরণ টেনে লেখা শেষ করতে চাই। ইহুদি, নাসারা, মোনাফেক চক্রগুলোসহ ইসলামের শুরু থেকে এযাবত ইসলামের বিরোধী অসংখ্য, অগনিত, বিকৃত, বিভ্রান্ত চিন্তাধারা পোষণকারী, ফের্কা, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, দল-উপদল ইত্যাদি রয়েছে। ওদের মধ্যে নরম, চরম, কট্টরপন্থী দল-উপদলের সংখ্যাও বিপুল। কিন্তু তাদের মধ্যে ষোল আনাই বিকৃত নয়। কিছু কিছু দলও রয়েছে, যাদের চিন্তাধারায় সত্যতা রয়েছে, তথাপি তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দৃষ্টিতে গুমরা ও বিভ্রান্ত। তারাও ইসলামের শত্রæ। তাদের মধ্যে একটি কট্টরপন্থী সম্প্রদায় আছে যাদের মূল আক্বীদা বিশ^াস হচ্ছে, ‘হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (রা.) স্বয়ং আল্লাহ’ (নাউজুবিল্লাহ)। এ ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের অনুসারীদের একটি ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ বিশে^ বিদ্যমান। এ সম্প্রদায়ের নিকটও শবে-বরাতের অস্তিত্ব ও মাহাত্ম এত অধিক যে, আল্লামা তিবরানীর বর্ণনা অনুযায়ী, বছরব্যাপী তাদের ঈদ উৎসবের সর্বমোট সংখ্যা ৫৭টি (সাতান্ন), ক্রমানুসারে ‘শবে-বরাত’ ৩৪ নম্বর (এই সম্প্রদায়ের নাম ‘নুসাইরিয়া’)। তাই গোড়াতেই বলেছি, সত্যের প্রতি কখনো কখনো শত্রæরাও সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। ‘শবে-বরাত’ বিরোধীরা এ বাস্তবতা হতেও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।