পশ্চিম তীরে সহিংসতা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ
জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনের
আল জাজিরা : দামেস্কের উপকণ্ঠে দুমায় কথিত রাসায়নিক অস্ত্র হামলার জবাবে মার্কিন জোটের হামলার ঘটনায় প্িচমা বিশ্লেষকেরা সিরিয়া বিষয়ে মার্কিন নীতিতে একটি টেকটোনিক পরিবর্তনের আশা করছেন। অন্যদিকে রাশিয়া শংকিত যে রণাঙ্গনে তার আগের বাধাহীন প্রভাবের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। সিরিয়ার তিনটি সন্দেহজনক রাসায়নিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের হামলার চূড়ান্ত ফল তেমন ব্যাপক হয়নি এবং তা বাশার সরকারের পুনরায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারকে নিরোধ করবে এমন সম্ভাবনা কম।
এটা বলা যায় না যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার সাথে সম্ভাব্য সংঘাতের ব্যাপারে চোখ পিটপিট করছেন। মাত্র দু’মাস আগে মার্কিন জঙ্গি বিমানগুলো দেইর আজ জরে সরকারপন্থী বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এতে কয়েক ডজন রুশ ভাড়াটে সৈন্য নিহত হয়। তবে এ ঘটনা স্বীকার করতে রাশিয়া কয়েকদিন সময় নেয় এবং এর কোনো সামরিক জবাব দেয়নি।
গত ১৪ এপ্রিলে পরিচালিত হামলার প্রভাব ভূমিতে সীমিত, বরং তা প্রতীকী ভাবে সিরিয়ায় রুশ সামরিক প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল এ হামলা সিরিয়ার যুদ্ধকে বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে লড়াইয়ে রূপান্তরিত করেছে। হামলার আগে দু’পক্ষের মধ্যে বাগযুদ্ধ জোরদারের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টনিও গুটেরেস নিজে উল্লেখ করেনঃ প্রতিহিংসাসহ ঠান্ডা যুদ্ধের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে।
বস্তুত সিরিয়ায় গত কয়েক মাসের ঘটনা দেখিয়েছে যে সিরিয়ার যুদ্ধ ধীরে ধীরে ঠান্ডা যুদ্ধের রূপ নিতে চলেছে। বিশ শতকে ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার মত আজ রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ইতিবাচক কূটনৈতিক আলোচনা হ্রাস পেয়ে সরাসরি সামরিক সংঘাত এড়াতে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের পর্যায়ে নেমেছে। এ অর্থে দি¦পাক্ষিক সম্পর্ককে রাজনৈতিক কূটনীতি দিয়ে চালিত করার পরিবর্তে মার্কিন ও রুশ সামরিক বাহিনী দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং অব্যাহত যোগাযোগ, যুদ্ধ নিরোধ ও বিস্তার না ঘটার সমন্বয় করছে।
কূটনীতির উপর সামরিক প্রাধান্য
১৪ এপ্রিল সিরিয়ার উপর পশ্চিমা হামলাকে যদি ঠান্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিচার করা যায় তাহলে দেখা যাবে এটা বিস্ময়কর কিছু নয়। কারণ তা বাশারের সামরিক স্থাপনাগুলো ও সম্ভবত ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত মূলক সামরিক অভিযান ছিল না।
ঠান্ডা যুদ্ধের দিনগুলোতে উত্তেজনা সৃষ্টি হত দ্রæত ,কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে তার অবসানও ঘটত। কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধের সবচেয়ে কাছে পৌঁছেছিল। বাগযুদ্ধ আগাম হামলার হুমকিতে রূপ নেয়, দু’পক্ষই তাদের সামরিক বাহিনীকে উচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখে। ১৩ দিনের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের হুমকি অপসারণ করতে যুদ্ধ নিরোধ চুক্তির জন্য ১৩ দিনের মধ্যে দ্রæত আলোচনা শুরু হয়। কমপক্ষে দু’টি উপলক্ষে দু’দিকের বেসামরিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দ উস্কানির জবাব না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং শেষ পর্যন্ত কিউবা কর্তৃক একটি মার্কিন ইউ-২ গোয়েন্দা বিমান ভূপাতিত করার মাধ্যমে একজন পাইলটের দুর্ভাগ্যের মধ্য দিয়ে এ অধ্যায়ের ইতি ঘটে। সিরিয়ায় সুন্দর ও নতুন স্মার্ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের মার্কিন অঙ্গীকার ও দ্রæত পাল্টা হামলার মস্কোর হুমকি সত্তে¡ও দু’দেশের সামরিক বাহিনী উত্তেজনা হ্রাসের আশায় সতর্ক আচরণ করছে। উভয় দেশের রাজধানী থেকে মারাত্মক হুমকি দিয়ে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর করা হচ্ছে যা দু’দেশের সামরিক বাহিনীর পরিস্থিতি মোকাবেলার বাস্তবতার সাথে খাপ খায় না।
সিরিয়ায় আমরা যা দেখছি তা হচ্ছে নীতি নির্ধারণের রাজনৈতিক ও সামরিক দিকের মধ্যে সংযোগহীনতা। সামরিক বাহিনী যেখানে বাস্তবতা ও বিচার বুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছে সেখানে কূটনীতিকদের কাছে তলোয়ার ঘোরানোটাই যোগাযোগের জন্য পছন্দসই হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক শত্রæতা দু’ দেশের মধ্যে অপরিসীম শূন্যতার সৃষ্টি করেছে যা আংশিক ভাবে পূরণ করছে তাদের সামরিক বাহিনী। তারাই যুদ্ধ পরিহার করতে সংলাপের একমাত্র কার্যকর মঞ্চ বজায় রেখে চলেছে।
রাশিয়ার সাথে পাশ্চাত্যের সংঘাতের নয়া ফ্রন্ট
অতীতের যে কোনো সময়ের কূটনৈতিক বিরোধের চেয়ে বর্তমান সংকট অধিক বিস্ফোরণোন্মুখ। এখন রাশিয়া ও পাশ্চাত্যের মধ্যে কূটনৈতিক বিরোধের সাথে সিরিয়া গভীরভাবে জড়িত। সিরিয়ায়র হামলা চালাতে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের মধ্যে তার প্রমাণ মেলে। যদিও থেরেসা মে ও ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন যে তাদের সামরিক হামলা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে এক শক্ত বার্তা, কিন্তু তা ওয়াশিংটনের সাথে লন্ডন ও প্যারিসের যোগদানের ব্যাখ্যা নয়।
সম্প্রতি ব্রিটেনের স্যালিসবারিতে সাবেক রুশ গুপ্তচর ও তার মেয়েকে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফ্রান্স-রাশিয়ার সম্পর্কও সাম্প্রতিক কালে তিক্ত হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালে ফ্রান্সের যে নির্বাচনে ম্যাক্রোঁ জয়ী হন তাতে রাশিয়ার অন্যায় হস্তক্ষেপের প্রেক্ষিতে তিনি রাখঢাক না করেই তার অসন্তোষের কথা ব্যক্ত করেছেন। তার ভোটের কয়েকদিন পর পুতিনের ফ্রান্স সফরকালে ম্যাক্রোঁ ফ্রান্স বিষয়ে রুশ মিডিয়ার রিপোর্টের সমালোচনা করেন ও তাকে প্রচারণা বলে আখ্যায়িত করেন। ক্রেমলিনের দৃষ্টিতে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য সিরিয়ার ব্যাপারে অধিক ভাবে জড়িয়ে পড়ছে যাতে তারা দেশে থেকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে পারে। রাশিয়া তার সীমান্তের কাছে ন্যাটোর প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে যা শীতল যুদ্ধের সময় থেকেই তার কাছে প্রধান বিষয়।
ঠান্ডাযুদ্ধ যুগের জার্মানি হিসেবে সিরিয়া
মস্কো ও ওয়াশিংটন উপলব্ধি করেছে যে তাদের একের কাছে অপরের কথা তুলে ধরার জন্য সিরিয়াই সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। পুতিন বা ট্রাম্প কেউই সিরিয়ায় সামরিক শক্তি প্রদর্শন করতে চান না, কিন্তু ইসলামিক স্টেট (আইএস) একেবারে বিলুপ্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান আর একই ধরনের সুফল দিচ্ছে না আগের মত।
সন্ত্রাস বিরোধী বাগাড়ম্বর বিলীন হয়ে আসার পর সিরিয়া এখন বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্ব›িদ্বতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। রামিয়া যুক্তরাষ্ট্র তাদের সিরিয়া বিনিয়োগের সর্বোচ্চ প্রতিদান নেয়া অব্যাহত রাখবে এবং সেখানে তাদের কূটনৈতিক বিরোধের খেলা অব্যাহত রাখবে।
এ অবস্থায় এটা অবিশ^াস্য নয় যে সিরিয়া শীতল যুদ্ধ যুগের জার্মানির ভূমিকা নেবে। হতে পারে যে দু’বৃহৎ শক্তি তাদের মিত্রদের সাথে শীতল যুদ্ধ খেলার নয়া নিয়ম ও নয়া রেড লাইন প্রতিষ্ঠার জন্য দেশটিকে ব্যবহার করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মস্কো ও ওয়াশিংটনের পরিকল্পনানুযায়ী জার্মানিকে পূর্ব ও পশ্চিম দু’ দেশে ভাগ করেছিল। সিরিয়ার প্রেক্ষাপটে তা যেন নতুন অর্থ বহন করছে। এ অর্থে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বৈশি^ক কূটনৈতিক বিরোধ সিরিয়া ও তার জনগণের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। এ বিরোধ সিরিয়ার জনগণকে তাদের নিজ ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার বঞ্চিত করবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।