Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিপিইসি ও ভারত-পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তানের মধ্যে শক্তির খেলা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২২ এপ্রিল, ২০১৮, ৬:৫৮ পিএম

যুক্তরাষ্ট্র-চীন সঙ্ঘাতের সময় সম্ভাব্য নৌ অবরোধ এবং সেইসাথে চীনের পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের লক্ষ্যে পাকিস্তান দিয়ে আরব সাগরে যাওয়ার একটি স্থল সড়ক চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) তৈরিতে খুবই আগ্রহী চীন। এই রুটটি কতটা উন্নত এবং এর বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুটি কী?
মস্কোর হাইয়ার স্কুল অব ইকোনমিক্সের ভিজিটিং প্রফেসর অস্ট্রেলিয়ার জেফ স্কুবার্ট সিপিইসিকে পাকিস্তানের অবকাঠামো প্রয়োজন পূরণ ও চীনের আরব সাগরে কিংবা বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত মহাসাগরে যাওয়ার ও দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ জিনজিয়াঙের উন্নয়নের জন্য দরকার বলে অভিহিত করেছেন। এই রুট দিয়ে চীন কেবল রফতানিই করবে না, আমদানিও করবে। বিশেষ করে তেল আমদানি করবে। চীন আশঙ্কা করছে, যুদ্ধ হলে মালাক্কা প্রণালী দিয়ে থাকা রুটটি বন্ধ হয়ে যাবে।
অবশ্য এই রুট দিয়ে তেল পরিবহন কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্নভিন্ন মত রয়েছে। পাকিস্তান ও চীনের মধ্যকার সীমান্ত অঞ্চলটি পর্বতময় ও খুবই শীতল এলাকা। এখানে ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়। ফলে এখান দিয়ে তেল পরিবহন খুবই কঠিন হবে। টাকা থাকলে অবশ্য অনেক সমস্যার সমাধান করা যায়। চীনারা বিকল্প রেললাইন দিয়ে কাজটি করতে পারে। এখান দিয়ে চীন দিনে আড়াই লাখ ব্যারেল তেল পরিবহন করতে পারবে। চীনের দিনে তেল আমদানি করতে হয় ৯০ লাখ ব্যারেল। সেই হিসেবে পাকিস্তান দিয়ে রুটটি খুবই অপ্রতুল। তবে জরুরি অবস্থায় ওই আড়াই লাখ ব্যারেলই কম কিসে! তবে সিপিইসি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এখানে এখনো পাইপলাইন বসেনি।
‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ প্রকল্পটি মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করবে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে জেফ বলেন, তাত্ত্বিকভাবে তা করবে। কিন্তু রাশিয়া যেখান ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন করতে চায়, সেখানে তাকে রাশিয়ার সাথে আলোচনা করতে হবে। তাছাড়া তুর্কমেনিস্তান থেকে গ্যাস আনতে হলে কাজাখস্তানকে রাজি করানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হবে। আবার কাজাখস্তানও জ্বালানি রফতানির গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণত হচ্ছে। তবে চীন মনে করছে, কাখাজস্তান কিন্তু পাকিস্তানের মতো এত নির্ভরযোগ্য হবে না।
বিনিয়োগ আকর্ষণ করার ব্যাপারে সিপিইসি হবে পাকিস্তানের জন্য বিপুল সম্ভাবনাময়। এ কারণে পাকিস্তান একে স্বাগত জানাচ্ছে। অনেকে মনে করছে, এর মাধ্যমে চীনের কাছে পাকিস্তান ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু মনে রাখতে হবে, পাকিস্তান জ্বালানি স্বল্পতায় ভুগছে। পাকিস্তানের কোনো সরকারই বিদ্যুৎব্যবস্থা যথাযথ করতে পারছে না।
গোয়াদর বন্দরটি চীনা বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে কেবল বাণিজ্যিক জাহাজই নয়, চীনা নৌবাহিনীর রণতরীও ভিড়তে পারে। চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি এবং পাকিস্তানের কাছে পরমাণু অস্ত্র থাকায় ভারত গোয়াদর বন্দরে হামলা চালানো বা একে অবরোধ করতে সাহসী হবে না। এক্ষেত্রে ভারতের বিকল্প হলো ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নত করে চাবাহার বন্দরকে কাজে লাগানো। এর মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে যেতে পারবে ভারত। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের সম্পর্ককে বিবেচনায় নিলে এটি কতটুকু ফলপ্রসূ হবে সে প্রশ্ন থেকে যায়।
আফগানিস্তানে আমেরিকান ব্যর্থতার জন্য পাকিস্তানকে দোষারোপ করে ভারতকে আরো বড় ভূমিকা পালন করার মার্কিন অবস্থান প্রসঙ্গে জেফ বলেন, কিন্তু ভারত কিভাবে যাবে আফগানিস্তানে? পাকিস্তান দিয়ে তাদের যাওয়ার সম্ভব নয়। ফলে সামরিক উপস্থিতির প্রশ্ন ওঠে না। ফলে আফগানিস্তানের সাথে তারা প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বাড়ানোর কথা বলতে পারে। মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র চায় আফগানিস্তান থেকে সরে যেতে। কিন্তু কিভাবে সরে যাবে, তা তারা জানে না।
সিপিইসি একটি দারুণ প্রকল্প। তবে এটি একইসাথে জটিলও। এটি চালু হলে এশিয়ার অবয়ব বদলে যাবে। এশিয়াজুড়ে যেসব বড় অবকাঠামো প্রকল্প হচ্ছে, এটি তার একটি মাত্র। স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামরিক ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পাশ্চাত্যের দেশগুলো এসব প্রকল্পের দিকে নজর দিতে পারছে না।
‘বেইজিংয়ের ভারত-নেপাল-চীন করিডোর পরিকল্পনায় উদ্বিগ্ন দিল্লী’
চীন ভারতের কাছে হিমালয় অঞ্চলে ত্রিদেশীয় অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণের প্রস্তাব দিতে পারে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই পরিকল্পনার অধীনে ভারত, চীন ও নেপালকে সংযুক্ত করা হবে। তবে, এই প্রস্তাব দিল্লীর দিক থেকে সামান্যই সাড়া পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ বেইজিংয়ের সম্প্রসারণশীল অবকাঠামো প্রকল্পগুলো নিয়ে এরইমধ্যে ভারত তাদের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে।
বেইজিংয়ে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ কুমার গিয়াওয়ালির সাথে বৈঠকের পর চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, ‘হিমালয় অঞ্চল দিয়ে আমাদের ত্রি-মাত্রিক সংযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা উচিত। চীন ও নেপাল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে যৌথভাবে কাজ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে, যেখানে সংযোগ স্থাপন একটা প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
চীন ও নেপাল রেল, সড়ক, বিমান, বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ খাতে ধীরে ধীরে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী – এমন তথ্য জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এর ফলে একটা পরিবেশ তৈরি হবে এবং চীন, নেপাল এবং ভারতের মধ্যে ত্রিদেশী ইকোনমিক করিডোর গড়ে তোলা সহজ হবে, যেটা ভবিষ্যতে গড়ে উঠতে পারে।’
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের চারদিনের চীন সফর শুরুর আগে ওয়াং এ মন্তব্য করলেন। শনিবার স্বরাজের ওই সফর শুরু হবে। ওয়াংয়ের সাথে বৈঠক ছাড়াও স্বরাজ ২৪ এপ্রিল সাংহাই কোঅপারেশান অর্গানাইজেশানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেবেন।
এই সফরে দুই দেশ তাদের সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আলোচনা করবেন। গত বছর দোকলামে সড়ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সেনাবাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেয়ায় দুই দেশের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়। ওই অচলাবস্থা দুই মাসেরও বেশি স্থায়ী হয়েছিল। স্বরাজের সঙ্গে বৈঠকে চীন ত্রিদেশীয় অর্থনৈতিক করিডোরের প্রসঙ্গটি তুলতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
দিল্লীতে ইন্সটিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের সহযোগী ফেলো প্রশান্ত কুমার সিং নিক্কি এশিয়ান রিভিউকে বলেন, ‘চীন ভারতকে (ত্রিদেশীয় করিডোর নিয়ে) বোঝানোর চেষ্টা করবে কিন্তু সফল হবে নাও হতে পারে।’
তিনি বলেন, এ ধরনের প্রকল্পের ব্যাপারে সম্মত হওয়ার আগে ভারত সার্বিক আস্থা ও স্বচ্ছতার পরিবেশ খুঁজবে, যেটা চীনের সাথে তাদের নেই। চীনের উচ্চাকাক্সক্ষী বিআরআই প্রকল্পের অংশ চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) নিয়ে দিল্লী এরইমধ্যে বেইজিংয়ের প্রতি অসন্তুষ্ট। ৬০ বিলিয়ন ডলারের সিপিইসি বিতর্কিত কাশ্মীর এলাকা দিয়ে গেছে। এটা ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ – এই যুক্তিতে এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে দিল্লী।
৫ এপ্রিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিআরআইয়ের ব্যাপারে তাদের অবস্থান আবারও খোলাসা করেছে। ভারত চীনকে বিআরআই নিয়ে সহযোগিতা করতে পারে, মিডিয়ায় এ ধরনের রিপোর্ট প্রকাশের পর মন্ত্রণালয় থেকে ওই প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। এতে বলা হয়, ‘ভারতের অবস্থান অপরিবর্তিতই রয়েছে এবং এতে কোন পরিবর্তন হয়নি।’
এতে আরও বলা হয়, ‘চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর সিপিইসি ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক সংহতিকে লঙ্ঘন করেছে। কোন দেশই এমন কোন প্রকল্পকে মেনে নিতে পারে না, যেটা তাদের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখ-তাকে অগ্রাহ্য করে।’
নেপাল ও ভারতের সাথে ত্রিদেশীয় করিডোরকে চীন দেখছে সস্তা পণ্য রফতানির সুযোগ হিসেবে।
নয়াদিল্লীর কাছে সোনিপাত এলাকায় ও.পি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সের সাবেক গবেষক পঙ্কজ ঝা বলেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নেপালের সাথে ঐতিহাসিকভাবে খোলা সীমান্ত রয়েছে ভারতের। তাছাড়া চীনা পণ্যের ব্যাপারে ভারতের অনীহাও রয়েছে।
তিনি বলেন, চীন এরইমধ্যে থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা এবং বাংলাদেশের মাধ্যমে তাদের পণ্য ভারতে পাঠাচ্ছে। তাছাড়া ভারতের সাথে চীনের বিশাল বাণিজ্য ব্যবধান তো রয়েছেই।
ঝা বলেন, ‘চীন এখন এই ত্রিদেশীয় করিডোর তৈরি করতে চায় যাতে ভারত ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নেপালকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ভারতের এ ব্যাপারে অত আগ্রহ নেই, বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় পণ্যবাহী যানবাহনকে ছাড়পত্র দেয়ার জন্য যেহেতু তাদের যথেষ্ট শুল্ক অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারত মনে করে যদি তারা নেপালকে চীনের হাতে ছেড়ে দেয়, তাহলে ভারতের পুরো উত্তরাঞ্চল চীনের কাছে উন্মুক্ত হয়ে যাবে এবং চীন (নেপাল প্রান্ত দিয়ে) সীমান্তের খুব কাছে চলে আসবে।’
ভারত ও চীন দুটো পারমানবিক শক্তিধর দেশ যাদের মধ্যে দীর্ঘ সঙ্ঘাতপূর্ণ সম্পর্ক চলে আসছে। দুই দেশের মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে। ১৯৬২ সালে দুই দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছে। আঞ্চলিক এই্ দেশ দুটো তাদের প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোসহ অন্যান্য দেশের উপর প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছে। এখানে ভারতেরও নিজস্ব উচ্চাকাক্সক্ষী সংযোগ প্রকল্প রয়েছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বাড়াতে ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মধ্যে ত্রিদেশীয় হাইওয়ে নির্মাণ করছে তারা। সূত্র : এসএম অনলাইন



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ