পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাঙালীর ইতিহাস ও সমাজ জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের প্রতিটি রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে দ্বিধা-দ্ব›দ্ব, বিভক্তি ক‚টচাল এবং আত্মবিস্মৃতির জটাজাল। হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয়, আর্থ-সাসমাজিক ও মনোজাগতিক বিভাজন একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। বিশেষত বাঙ্গালী হিন্দু ও মুসলমানের শত শত বছরের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আদান-প্রদান ও মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করার সুযোগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা মানুষও হতে পারল না! বঙ্গমাতা কবিতার শেষ ছত্রে কবি রবীন্দনাথ লিখেছেন, ‘সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে মানুষ কর নি’। রবীন্দ্রনাথের চেতনা ও মণীষায় বিশ্বনাগরিকতা ও বিশ্বলোকের আলো রেখাপাত করেছিল বলেই বাঙ্গালীর মানুষ হয়ে ওঠার আকাঙ্খা তার মধ্যে জাগ্রত ছিল। তবে রবীন্দ্রনাথ বাঙ্গালীর অভিন্নতায় বিশ্বাস করতেন। যদিও হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় পার্থক্যের কারণে ভাষাভিত্তিক বাঙালীর সাংস্কৃতিক পার্থক্য অনস্বীকার্য। এমনকি অভিন্ন ভাষা ও ধর্মীয় সংস্কৃতির উত্তরাধিকার সত্বেও শুধুমাত্র ভৌগলিক ও রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে আধুনিক বিশ্বের অনেক দেশের মধ্যে সুস্পষ্ট সাংস্কৃতিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। একই খৃষ্টধর্ম এবং ইংরেজী ভাষার অভিন্ন বর্ণ ও ব্যকরণের অংশীদারিত্ব নিয়েও বৃটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা অষ্ট্রেলিয়ার রাজনীতি ও লোকজ সাংস্কৃতিতে সুষ্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। সারাবিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসন চালানো বৃটিশরা নিজের দেশে আইরিশ বা স্কটিশদের সাথে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পার্থক্য ঘুচিয়ে একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক বলয়ে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা কখনো করেনি। গত তিনহাজার বছরে ভারতীয় উপমহাদেশে যে ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক বিবর্তন সংঘটিত হয়েছে তার কোন অধ্যায়ই গুরুত্বহীন নয়। সভ্যতার উত্থান পতনের ঘটনা ও পরম্পরার ইতিহাস প্রতিটি জাতির সাধারণ প্রবাহমানতা ইতিহাস। আর্যদের আগমনের মধ্য দিয়ে প্রাচীন ভারতবর্ষে এতটা প্রভাবক শক্তি হয়ে উঠেছিল যে এক সময় অনার্য একটি বিদ্রæপাত্মক শব্দে পরিনত হয়েছে। অর্থাৎ যারা আর্য নয় তারা নিশ্চিতভাবেই নেটিভ এই নেটিভদেরকে আগন্তুক আর্যদের উত্তরসুরীরা অনার্য বলে গাল দিত। আমাদের বাংলা সাহিত্যেও এর অনেক উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে খ্রষ্টীয় সপ্তম শতকে এসে ভারতের রাজনৈতিক অখন্ডতা যখন নানাভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, বহুধাবিভক্ত ভারতের দুর্বলতা সুযোগেই মুসলমানদের আগমন এবং প্রভাব বিস্তার সহজ হয়েছিল। সিন্ধু উপত্যকায় মুহামম্মদ বিন কাসিমের অভিযানের মধ্য দিয়ে প্রজাপীড়ক রাজা দাহিরের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতে ইসলামী সভ্যতার বিজয় পতাকা সম্প্রসারিত হতে শুরু করেছিল। এরপরের ৮শ বছরের ইতিহাস এ দেশের প্রায় সকলেরই জানা। মুসলমানরা আটশ বছর ধরে ভারত শাসন করেছিল। তারা কখনো আর্যদের মত ভারতীয়দের গায়ে বিদ্রæপাত্মক সিল লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে বলে আমাদের জানা নেই। তবে একশ্রেনীর মানুষ মাঝে মধ্যেই এ কথা বলার চেষ্টা করেন যে, মুসলমানরা তরবারির জোরে ভারত দখল করেছিল। এ দাবী সত্যের অপলাপ মাত্র। কোরানের শান্তি ও সাম্যের বানী বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে কখনো কখনো তরবারি ধারণ করতে হয়েছে বটে, তবে ইসলামের সাম্য-মৈত্রির বানীর শক্তি তরবারির চেয়ে বহুগুন বেশী। ইংরেজের ভারত দখল এবং মুসলমানের ভারত শাসনের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। ঔপনিবেশবাদি ইংরেজরা ভারতে এসে সম্পদ লুন্ঠন করে বৃটেনে নিয়ে গেছে। আর মুসলমানরা ইরান,তুরস্ক থেকে এ দেশকে ভালবেসে এখানকার সমাজকে বদলে দিতে নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দেয়ার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই পশ্চাতপদ, বর্ণবিভাজিত ভারতীয়রা দলে দলে ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হয়ে সারা ভারতে মুসলমানরা এক শতাব্দীর মধ্যেই দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। মুসলমানরা তরবারির জোরে ভারতীয়দের উপর ইসলাম ধর্ম চাপিয়ে দিয়েছিল এমন একটি প্রশ্নের জবাবে হার্বাড ও কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ভাষাতত্ব বিভাগের প্রফেসর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশিট্য বুদ্ধিজীবী, ভারতের পদ্মশ্রী পদক প্রাপ্ত সংস্কৃত ভাষার ইহুদি বংশোদ্ভুত পন্ডিত শেলডন পোলক বলেছেন, মুসলমান শাসকরা যদি ইচ্ছা করত, তবে ভারতে কোন হিন্দুই অবশিষ্ট থাকতনা।
পশ্চিমা সমাজে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলস্তম্ভই হচ্ছে মাল্টিকালচারালিজম। বর্ণ ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রয়াসের কারণেই এখন বিশ্বে সন্ত্রাস ও অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা বেড়ে চলেছে। ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ভারতের অন্যতম প্রধান গৌরবজনক বৈশিষ্ট। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা এই বৈচিত্র্যকে মানবিক সাম্য ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দ্বারা মেনে নিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই ভারতের রাজনৈতিক বিভাজন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। প্রায় দুইশ বছরের ইংরেজ শাসনে মুসলমানরা ছিল ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর। অতএব মুসলমানদের দাবিয়ে রাখতে গিয়ে নানাভাবে বঞ্চনার শিকারে পরনিত করায় এ সময়ের অগ্রসর মুসলমানরা শেষ পর্যন্ত অনগ্রসর পশ্চাতপদ জাতিতে পরিনত হয়। ইংরেজ শাসনে ভারতের রাজধানী দিল্লী থেকে কলকতায় স্থানান্তরিত হলেও বিশাল বাংলার পূর্বাঞ্চল তথা পূর্ব বাংলা ছিল সব দিক থেকেই বঞ্চিত, পিছিয়ে পড়া ও অনগ্রসর। পলাশী যুদ্ধের দেড়শ বছর পরে ইংরেজরা পিছিয়ে পড়া পূর্ববঙ্গকে সামনে এগিয়ে নেয়ার চিন্তা থেকেই ঢাকাকে রাজধানী করে ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে একটি আলাদা প্রদেশ গঠনের ঘোষনা দিয়েছিল। ইংরেজের সে ঘোষনার বিরুদ্ধে একটি আবেগী অবস্থান নিয়ে কলকাতা কেন্দ্রিক, জমিদার, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীরা শক্তিশালী আন্দোলনের মাধ্যমে তা প্রতিহত করেছিল। মাত্র ৫ বছরের মাথায় ১৯১১সালেই বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষনা দেয় বৃটিশ রাজ। বঞ্চিত ও অবহেলিত পূর্ববাংলার মানুষের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা কিছুটা লাঘব করতেই মুসলমান নেতাদের দাবী মেনে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দিয়েছিল বৃটিশরা। কলকাতার কায়েমী স্বার্থবাদি মহল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধেও অনেক কুযুক্তি খাড়া করলেও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর মধ্য দিয়ে তাদের প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২ দশকের মাথায় ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে মুসলমানদের পক্ষ থেকে বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবী জানানো হয়েছিল। তবে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় কিন্তু অখন্ড বাংলার রাজনৈতিক রূপরেখা ভারতের কংগ্রেস নেতাদের কাছে কাছে কোন পাত্তাই পায়নি। তারা ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে বাংলাকে ভাগ করার ভেদবুদ্ধিকেই মেনে নিয়েছিল। এই ভেদবুদ্ধি বাঙ্গালীর রাজনৈতিক ভাগ্য ভারতীয় এবং পাকিস্তানীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকেই পূর্ববাংলার মুসলমানরা পাকিস্তান ইউনিয়নে যোগ দেয়ার ম্যান্ডেট দিয়েছিল। শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙ্গালীদের নিয়ে পাকিস্তানের অখন্ড রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক মেলবন্ধনের প্রয়াসও মিথ্যা হয়ে গেছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে। তবে ইসলামে বিশ্বজনীন সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের যে চেতনা কাজ করে বাংলাদেশের মুসলমানরাও তাকে যথার্থরূপে অনুধাবন করে থাকে। ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা সামরিক আগ্রাসন এবং বিশ্বের যেখানেই মুসলমানরা নির্যাতন- নিপীড়নের শিকার হয়েছে তখনই বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে। মানবিক কারণে বিশ্বের বহুদেশেই যুদ্ধ বিরোধি র্যালি বের হয়, তবে বাংলাদেশের দরিদ্র সুবিধা বঞ্চিত মানুষ যখন নিজেদের সব বঞ্চনা ভুলে অন্যদেশের মুসলমানদের নিগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পেছনে মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে ইসলামের সাংস্কৃতিক চেতনা ও ভ্রাতৃত্ববোধ। দুই বাংলার হিন্দু-মুসলমানের লোকাচার ও রাজনৈতিক. সাংস্কৃতিক-মনোজাগতিক পরিকাঠামোর মধ্যে লক্ষ্যনীয় পার্থক্য বিদ্যমান।
বাংলাদেশের সংস্কৃতিসেবি ও বুদ্ধিজীবীরা প্রায়শ ‘আবহমান বাংলা’ চিরায়ত বাংলা ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু সেই আবহমান বা চিরায়ত কালের ঐতিহাসিক সীমারেখা সম্পর্কে তারা তেমন কোন আলোকপাত করেন না, ধারনা দেন না। আজকে বাংলাদেশে বাংলা বর্ষবরণের নবপ্রবর্তিত আনুষ্ঠানিকতা, মঙ্গল শোভাযাত্রা ইত্যাদি নিয়ে একটি সামাজিক-রাজনৈতিক বিতর্ক সামনে চলে আসছে তখন এদেশের বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবিদের উচিত হবে অনাকাঙ্খিত বিতর্কের অপনোদন করা। বাংলা বর্ষবরণে মাত্র বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রার যে আয়োজন তাকে এই ভাটি বাংলার মানুষের চিরায়ত মূল্যবোধের কোন সাজ সরঞ্জাম থাকে না। থাকে বাংলার হিন্দুদের ধর্মীয় পূজা-আর্চনার একটি বহুমাত্রিক অনুকৃতি। সঙ্গত কারণে শুরু থেকেই এই মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে এ দেশের এক শ্রেণীর মুসলমানের আপত্তি আছে। রাজনৈতিক অবস্থান থেকে কেউ কেউ তাদেরকে প্রতিক্রিয়াশীলচক্র, ধর্মান্ধ, মৌলবাদি ইত্যাদি শব্দযোগে বলে কটাক্ষ করলেও কখনোই তাদের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়না। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সাম্প্রতিক সময়ে যে ভার্চুয়াল সামাজিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তাতে এটুকু বলা যায়, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় চলা বর্ষবরণের এই সংস্কৃতিকে নিজেদের চিরায়ত সংস্কৃতি বলে মেনে নিচ্ছেনা। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের দাপটের কাছে বাংলা বর্ষপুঞ্জি গৌণ হয়ে গেলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাংলাভাষি মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবেই বাংলা বর্ষবরণের আয়োজন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকার কারণে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা ও পদ্ধতিতেও পার্থক্য দৃশ্যমান হওয়া স্বাভাবিক। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সম্পুৃর্ণ বিপরীত চিত্র। মুঘল স¤্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরী চান্দ্র বর্ষকে সৌরবর্ষে পরিনত করে একটি নতুন ফসলি সন বা দিনপঞ্জি প্রবর্তনের নির্দেশ দিয়েছিলেন ষোড়শ শতকে। রাজদরবারের পন্ডিত ফতেউল্লাগ সিরাজী সে কাজটি যর্থাথভাবেই সম্পন্ন করেছিলেন। অনেকে বাংলা সনকে রাজা শশাঙ্কের প্রবর্তিত শকাব্দের সাথে গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা করে থাকেন। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, বাংলা সনের প্রবর্তনের উদ্যোক্তা স¤্রাট আকবর এবং উপস্থাপক পন্ডিত ফতে উল্লাহ সিরাজী। আজকে আমরা বাংলা ভাষাভাষি শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে স¤্রাট আকবরের প্রবর্তিত বাংলা নববর্ষকে বরণ করছি হিন্দু ধর্মীয় প্রথা ও লোকাচার অনুসরণে। এ দেশের হিন্দুরা তাদের ধর্মীয় প্রথা অনুসরণে বাংলা নববর্ষকে বরণ করতেই পারেন, তাতে কারো কোন আপত্তি থাকার কথা নয়, বিপত্তিটা তখনই ঘটে যখন এ দেশের সরকার এই অনুষ্ঠানকে একটি সার্বজনীন মর্যাদায় অভিসিক্ত করে তাতে সব মসলমানকে শরিক হওয়ার নির্দেশ জারি করে। দেশের সব স্কুল-কলেজ এমনকি মাদরাসাগুলোতেও মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়। ১লা বৈশাখে ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রার সাজসজ্জা ও আয়োজন সম্পর্কে গত রবিবার কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘ঢাকার পয়লা যেন অষ্টমীর একডালিয়া’। রির্পোটার দেবদূত ঘোষঠাকুর তার রিপোর্টের শুরুতেই লিখেছেন, ‘কার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে! কখনো মনে হচ্ছিল কলকাতার কলেজ স্কোয়ার বা একডালিয়ার পূজামন্ডপ। কখনও বা শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের চেহারা। তা সে রমনার বটমূলের বৃন্দগানই হোক কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাজপথে মঙ্গল শোভাযাত্রা। পূজো, বসন্ত উৎসব মিলমিশে একাকার ঢাকার নববর্ষের সকাল।’ এটি কোন প্রতিক্রিয়াশীল মুসলমানের বিবরণ নয়, কলকাতার একজন সাংবাদিক ঢাকার বর্ষবরণের আয়োজনকে এভাবেই তুলে ধরেছেন। কলকাতার পূজামন্ডপের আদলে ও সাজসজ্জায় পালিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালী মুসলমানের অনাগ্রহের এই বাস্তব কারণকে অগ্রাহ্য করার কোন উপায় নেই।
যে অনুষ্ঠানাদি চিরায়ত বা আবহমান কালের ঐতিহ্য ধারণ করে তা হবে লোক সমাজ বা সাধারণ মানুষের স্বত:স্ফুর্ত আবেগের বহি:প্রকাশ। এমন লোকজ উৎসবে মানুষ প্রাণের টানেই সামিল হয়ে থাকে। বাংলা বর্ষবরণে ব্যবসায়ীদের হালখাতা খোলা, গ্রামে-গঞ্জে বৈশাখী মেলা, লাঠিখেলা আয়োজনের চিরায়ত ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে এখানে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের প্রয়োজন হল কেন? আর এই আয়োজনকে সার্বজনীন বাঙ্গালী সংস্কৃতি বিকাশের ধারা হিসেবে দাবী করার হেতু কি? কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে এমন মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করলে তা সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কখনো এমন নির্দেশনা জারি করেছে বলে আমাদের জানা নেই। ব্ংালাদেশে বাঙ্গালী সংস্কৃতি বিকাশের নামে শত শত কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ ও মঙ্গলশোভাযাত্রার এমন আয়োজনে একশ্রেনীর রাজনীতিক ও সংস্কৃতিসেবিদের অতি উৎসাহী ভ‚মিকাকে সাধারণ মানুষ সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে। দেশের চলমান বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে একশ্রেনীর মানুষ গণবিচ্ছিন্ন ও কল্পিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে মাতামাতি করলেও দেশের নতুন প্রজন্ম বাস্তব থেকেই শিক্ষা নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চায়। এবারের পয়লা বৈশাখের সকালে তেল, গ্যাস, বিদ্যুত ও বন্দর রক্ষা কমিটির ব্যানারে জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘প্রাণ প্রকৃতি রক্ষার শোভাযাত্রা ’ বের করেছে। তাদের শোভাযাত্রার মূল শ্লোগান ছিল ‘গো ব্যাক, গেট আউট ইন্ডিয়া’। ভারতের অংশিদারিত্বে সুন্দরবনের ভেতরে প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রের কারণে সেখানকার জীববৈচিত্র ও প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংসের আশংকা সামনে রেখেই এই শোভাযাত্রা। এ কথা ঠিক যে বাংলার আবহমান সংস্কৃতি ও বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের সাথে লোকজ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুসঙ্গ হিসেবে এ দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পাশাপাশি প্রাণ-প্রকৃতির একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। হাজার হাজার বছরে গড়ে ওঠা সেই লোকজ সংস্কৃতি ও প্রাণপ্রকৃতি এখন মানব সৃষ্ট বৈরীতা ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নদীমাতৃক বাংলাদেশের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও জীব-বৈচিত্র্যের উপর সবচে বড় আঘাতটি এসেছে ভারতের কাছ থেকে। পদ্মার উজানে গঙ্গার উপর ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের নদীগুলোকে গলাটিপে হত্যার আয়োজনের শুরু। এরপর তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধ দিয়ে তিস্তা অববাহিকার কৃষি, নৌযোগাযোগ, জীববৈচিত্র্য ও প্রাণপ্রকৃতিকে ধ্বংসের আয়োজন করা হয়েছে। প্রায় সবগুলো অভিন্ন নদীর উপর আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, প্রতিবেশ ও পরিবেশগত নিরাপত্তা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। আমাদের লোক জীবনের সব অনুসঙ্গের সাথে এ দেশের নদনদীর যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে তা যখন ধ্বংসের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছে, তখন আমরা নববর্ষের প্রথম দিনে পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের কাছ থেকে ধার করা মঙ্গল শোভাযাত্রা পালন করছি। সেখানে আমরা ভারতের পানি আগ্রাসন বা পদ্মা, তিস্তা অববাহিকার কোটি মানুষের হাহাকার সেখানে উচ্চারিত হয়না। ক’দিন আগে ঢাকায় এসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব বলে গেলেন, দুই দেশের মধ্যে মানুষে মানুষে বা পিপলস টু পিপলস সম্পর্ক চায় ভারত। দুই দেশের অভিন্ন সংস্কৃতির সবচে গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন হচ্ছে আমাদের অভিন্ন নদীগুলো। আন্তর্জাতিক আইন ও সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণের ন্যুনতম দায়-দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে অভিন্ন নদীগুলোর উপর একতরফা নিয়ন্ত্রণ তথা পানি আগ্রাসন চালিয়ে শুধু মুখের কথায় এ দেশের জনগনের আস্থা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আশা করা যায়না। ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে আমাদের নদনদী ও প্রাণপ্রকৃতির যে অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে ভবিষ্যতে নববর্ষের শোভাযাত্রায় সেই সংকটের চিত্রই উঠে আসবে, এটাই দেশের মানুষের প্রত্যাশা। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতি, অর্থনৈতিক সংকট, সম্ভাবনা, প্রত্যাশা ও প্রাণোচ্ছাসের বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে ভিন্ন ধর্মীয় চেতনা ও অবাস্তব ভাবাবেগপূর্ণ মঙ্গল শোভাযাত্রাকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মেনে নিতে পারছেনা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাঙ্খার বাইরে গিয়ে কোন উৎসবকে সার্বজনীন উৎসবে পরিনত করা যায়না। তথাকথিত মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙ্গালীত্ব টিকিয়ে রাখার চিন্তার মধ্যে হয়তো খারাপ কিছু নেই। তবে আমাদের রাষ্ট্র এবং মানুষ হিসেবে টিকে থাকার প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক উৎসগুলোকে আগে রক্ষা করতে হবে। বিভাজন বৈরীতা পরিহার করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পৃক্ত একটি মানবিক ও অগ্রসর বাংলাদেশ গড়ে তোলাই নতুন প্রজন্মের মূল আকাঙ্খা। এই আকাঙ্খার বাস্তবায়নই রাষ্ট্র ও সরকারের মূল দায়িত্ব।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।