পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর কার্যক্রম বন্ধ এবং একে রক্ষার জন্য পরিবেশবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ বহু প্রতিবাদ করলেও তা কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশও মানা হচ্ছে না। এসব প্রতিবাদ এবং আদালতের নির্দেশ থোড়াই কেয়ার করে সুন্দরবন ধ্বংসের যত রকমের কার্যক্রম রয়েছে, তার সবই করা হচ্ছে। এর ফলে বিশ্বের একমাত্র বৃহৎ প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বনটি ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে। ধীরে ধীরে এর পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদনে বিস্তারিত উল্লেখ করে বলা হয়, সরকার সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯০টি বিভিন্ন শ্রেণীর ক্ষতিকর শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৪টি লাল ক্যাটাগরির বা সুন্দরবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ১৯৯৯ সালে সরকার সুন্দরবনের আশপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সুন্দরবনের জন্য পরিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী এই সীমার মধ্যে কোনো শিল্পকারখানা স্থাপন করা যাবে না বলে আইন করে। এই আইন লঙ্ঘন করেই সরকার সংরক্ষিত এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপন করার অনুমতি দিয়েছে। ১৯০টি শিল্পকারখানার মধ্যে রয়েছে, সিমেন্ট কারখানা, এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার, তেল পরিশোধনাগার, পান-সুপারি প্রক্রিয়াজাত প্ল্যান্ট, শিপ বিল্ডিং ইয়ার্ড, ধান ভাঙানোর কল, কাঠ কল, ইটখোলা, সিগারেট ও আইসক্রিম কারখানা, মাছ ও কাকড়া ফার্মস, হ্যাচারি, লবণাক্ত পানি পরিশোধন এবং ওয়েল্ডিং কারখানা। কিছু রেস্টুরেন্ট ও গাড়ির সিট তৈরির কারখানাও গড়ে উঠেছে। এসব কারখানা সুন্দরবনের চারপাশে দশ কিলোমিটারের মধ্যে যেসব এলাকায় রয়েছে তার মধ্যে আশাসুনিতে ৭টি, পাইকগাছায় ১৩টি, দাকোপে ৩৪টি, মংলায় ৭২টি, মোড়েলগঞ্জে ৪টি, শ্যামনগরে ১৩টি, কয়রায় ৪৫টি এবং শরনখোলায় ২টি। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষতিকর কারখানা রয়েছে মংলায়। এসব শিল্পকারখানা থেকে নির্গত হচ্ছে, বিষাক্ত ধোঁয়া, তরল বিষাক্ত কেমিক্যাল, বর্জ্য ও লবণাক্ত পানি।
সুন্দরবন বাংলাদেশের জন্য কত বড় প্রাকৃতিক সম্পদ, তা যেন সরকার উপলব্ধি করতে পারছে না। পরিবেশবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এর গুরুত্ব বুঝলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছে। তা না হলে বনটির জন্য ক্ষতিকর শিল্পকারখানা স্থাপন করার অনুমতি দিত না। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা সর্বোপরি ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে, সেখানে এ বন ধ্বংসের যাবতীয় কর্মকান্ডের অনুমোদন কেন দেয়া হচ্ছে, তা বোধগম্য হচ্ছে না। এক রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষতিকর দিক নিয়ে দেশের সকল মানুষ যেখানে সোচ্চার, সেখানে সরকার নির্বিকার। কেবল আশ্বস্থ করেছে, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কেন সুন্দরবনের কাছেই করতে হবে? পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের এমন প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। অথচ এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র যখন ভারতে সুন্দরবনের কাছাকাছি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, তখন সেখানকার জনগণ ও পরিবেশবিদদের প্রতিবাদের মুখে ভারত সরকার তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। অনুরূপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রই ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশে সুন্দরবনের কাছে স্থাপন করা হচ্ছে। ভারতের নীলনকশা এবং তাকে খুশি করতেই যে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কাছে স্থাপন করা হচ্ছে, তা সচেতন মানুষের বুঝতে বাকী থাকে না। সুন্দরবনের কাছাকাছি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতার মাঝেই তার সংরক্ষিত ১০ কিলোমিটারের মধ্যে একের পর এক শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব অনুমোদন দেয়া নিয়ে এটাই প্রতীয়মাণ হচ্ছে, সরকার যেন কিছুতেই চাচ্ছে না, সুন্দরবন সুরক্ষিত থাকুক। আমরা দেখেছি, ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের ভেতরে শ্যালা নদীতে অপরিশোধিত তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যাওয়ায় তার প্রভাবে সুন্দরবনের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্রের কী অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে। প্রত্যক্ষ এ অভিজ্ঞতা থাকা সত্তে¡ও দেখা যাচ্ছে, সুন্দরবন ধ্বংসে তার চারপাশ ঘিরে ক্ষতিকর শিল্পকারখানা স্থাপন করে যেন তার গলায় ফাঁস দেয়া হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সুন্দরবন লাখ লাখ মানুষের জীবিকার উৎস। দেশের বনজ সম্পদের শতকরা ৫১ ভাগ আহরিত হয় এ বন থেকে। শতকরা ৪১ ভাগ বনজ রেভিনিউ এবং ৪৫ ভাগ কাঠ ও জ্বালানি এ বন জোগান দেয়। দেশের অর্থনীতিতে এর অবদান অপরিসীম। এ বন শুধু অর্থনৈতিক শক্তির উৎস নয়, ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আইলা, সিডর, নার্গিসের মতো প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ণশক্তির আঘাত এ বন রুখে দিয়েছে।
যে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ একবার ধ্বংস হয়ে গেলে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না। সুন্দরবনের মতো অমূল্য সম্পদ যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তা আর কখনোই ফিরে পাওয়া যাবে না। মানুষের পক্ষে আরেকটি সুন্দরবন তৈরি করা সম্ভব নয়। সুন্দরবন ধবংস হয়ে গেলে বা না থাকলে কী ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা যেন সরকার উপলব্ধি করতে পারছে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্পকারখানা তৈরির প্রয়োজন রয়েছে, তবে তা সুন্দরবনের কাছেই করতে হবে, যা বন ধ্বংসের কারণে পরিণত হবে তা মেনে নেয়া যেতে পারে না। কলকারখানা স্থাপনের জন্য দেশে অনেক জায়গা রয়েছে। বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এসব জায়গায় ভালভাবে শিল্পকারখানা স্থাপন করা যায়। তা না করে সুন্দরবনের ক্ষতি করেই তার চারপাশে শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে। অথচ এসব শিল্পকারখানা থেকে যে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে, তার চেয়ে সহস্রগুণ সুবিধা দিচ্ছে সুন্দরবন। মানুষের ক্ষুদ্র স্বার্থ সংরক্ষণ করতে গিয়ে দেশের বৃহৎ স্বার্থ বিসর্জন দেয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা সরকারকে আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই, সুন্দরবনের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র ঠিক রেখে একে বাঁচাতে হবে। এর জন্য ক্ষতিকর যে কোনো কর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে। এ উদ্যোগ না নেয়ার ফলে সুন্দরবন যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তবে ইতিহাসে লেখা থাকবে এ সরকারের আমলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়েছিল। তাই আমরা সরকারকে অনুরোধ করব, সুন্দরবন রক্ষায় যেন অনতিবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।