Inqilab Logo

রবিবার, ৩০ জুন ২০২৪, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ২৩ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বজ্রপাতে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে দেশ

তালগাছ দিয়ে ঠেকানোর প্রক্রিয়া শুরু : মার্চ মাসে একদিনে মৃত্যুবরণ করেছে ১২ জন

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

দেশে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু কমানোর জন্য দেশব্যাপী ১০ লাখ তালগাছ লাগানো হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, বজ্রপাত যেহেতু সাধারণত উঁচু কোন কিছুতে আঘাত করে, সেজন্য তালগাছকেই তারা বেছে নিয়েছেন বজ্রপাত ঠেকানোর জন্য। তাদের ভাষায়, বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকানোর জন্য এটাই সবচেয়ে কার্যকর স্থানীয় প্রযুক্তি। এর পাশাপাশি হাওর অঞ্চলে টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনাও নিয়েছে সরকার। গত কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এদিকে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানির দিক দিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। এজন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও কাজের বিনিময়ে টাকা কর্মসূচির নীতিমালা পরিবর্তন করে সারাদেশে ১০ লাখ তাল গাছ রোপণ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল ইনকিলাবকে বলেন, বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকাতে সারা দেশে ১০ লাখ তালগাছ লাগানো হয়েছে। কালবৈশাখীর ঝড়ঝঞ্ঝা শুরুর পর থেকে এ বছরও দেশে বজ্রপাতে মানুষ হতাহতের ঘটনা ঘটে চলেছে। বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচার কৌশল সম্পর্কে গণসচেনতা সৃষ্টির মাধ্যমে মৃত্যুর হার কমানো যেতে পারে। তিনি বলেন, হাওর এলাকায় তালগাছের পাশাপাশি টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে সারাদেশে বজ্রপাতে ৬৪ জেলায় ৩৩৭ জন মানুষ মারা যায়। বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে হাওর অঞ্চলে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেলায় ১৩ জন, সিলেট জেলায় ১৬ জন এবং নেত্রকোনায় ১২ জন মারা যায়। এছাড়া বজ্রপাতে বহুসংখ্যক গবাদি পশুরও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের ৩১ র্মাচ কালবৈশাখী ঝড়, শীলা বৃষ্টি ও বজ্রপাতে একদিনে দেশের আট জেলায় মৃত্যুবরণ করেছে ১২ জন, আহত হয়েছে ৫৭ জন। দুর্যোগ ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বজ্রপাতে ২০১৩ সালে ২৮৫ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে মারা যায় ২০১ জন। ২০১১ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল কম ১৭৯ জন। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৪৬ জন। ওই বছরের মে মাসেই ১২০ জন প্রাণ হারায়। এ ছাড়া এপ্রিলে ৫৫ জন ও জুনে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালের ৫-৬ মে ৩৩ জন। ২০১৫ সালের ২-৩ মে ১৯ জন। ২০১৬ সালে শিশু ৭৯ জন, মহিলা ৫১ জন এবং পুরুষ ২২০ জন মৃত্যুবরণ করে। ২০১৭ সালে বজ্রপাতে শিশু ৫২ জন, মহিলা ৪৩ এবং পুরুষ ২০০ জন মৃত্যুবরণ করে। বজ্রপাতে চলতি বছরে সরকারি হিসেবে ১২ জন এবং বেসরকারি হিসেবে ১০ জন মৃত্যুবরণ করেছে, আহত হয়েছে ৬০ জন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ্রপাতকে এখনো সরকারিভাবে দুর্যোগের তালিকাভুক্ত করা হয়নি। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পুরো বৈশিষ্ট্য নিয়ে বজ্রপাতের ঘটনা ক্রমে বাড়ছে। সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র (এসএমআরসি) বজ্রপাতের ওপর ২০০৯ সাল থেকে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। সার্ক স্টর্ম প্রোগ্রাম নামে একটি প্রকল্পের অধীনে এ গবেষণা হচ্ছে। এই কেন্দ্রের গবেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানির দিক দিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। সার্কভুক্ত অন্য দেশের তুলনায় বজ্রপাতে এখানে মৃত্যুর হার বেশি। সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ের গবেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করে ৮শ’ থেকে ৯শ’ মানুষ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর সারা বিশ্বে বজ্রপাতে যত মানুষের মৃত্যু হয় তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশের।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিশ্বে বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়েছে। ২০০০ সালে যেখানে বছরের একটি নির্ধারিত সময়ে দুইবার বজ্রপাত রেকর্ড করা হয়েছে, সেখানে এখন ওই একই সময়ে তিনবার বজ্রপাত হচ্ছে। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালে দেশে বজ্রপাত বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। উপকূলীয় এলাকায় এর মাত্রা আরো কয়েক গুণ বেশি। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এই শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর তাপমাত্রা আশঙ্কাজনভাবে বাড়বে। তখন বজ্রপাতের হার সাড়ে ১২ শতাংশ বাড়বে। দেশে প্রতি বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪০ বার বজ্রপাত হয়। দেশের ৩৫টি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে যেখানে ২০১০ সালে ৬৫৮টি বজ্রপাত রেকর্ড করা হয়েছে সেখানে ২০১৫ সালে ১২৯৫টি বজ্রপাত সংঘটিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাত বৃদ্ধি পায় সাড়ে ১২ শতাংশ। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এই শতাব্দীর শেষে বজ্রপাতের পরিমাণ আরো ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। বৃষ্টিপাতের তীব্রতা ও মেঘের পরিমাপের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে আবহাওয়া অধিদপ্তরের বজ্রপাতের পরিমানের রেকর্ড থেকে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এপ্রিল মাসে বজ্রপাতের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে উপকূলে বজ্রপাত পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। ২০১০ সালে ঢাকায় এপ্রিলে বজ্রপাতের পরিমাণ ছিল ১৫ বার। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ বারে। ২০১৬ সালে সিলেটে বজ্রপাতের পরিমাণ ছিল ২৩০ বার। ২০১৭ সালে তা বাড়িয়ে রাজশাহীতে হয়েছে ৩৫০ বার। চলতি বছরের মার্চ মাসে ঢাকায় আট জেলায় বজ্রপাতের পরিমান ছিল ৪২০ বার। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সহকারী অধ্যাপক ও লরেন্স বার্কলে জাতীয় গবেষণাগারের ফ্যাকাল্টি বিজ্ঞানী ডেভিড রম্প বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করছেন। বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী সায়েন্স-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে তিনি বলেছেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি সম্পর্কযুক্ত। ২০০০ সালে যেখানে বছরের একটি নির্ধারিত সময়ে দুইবার বজ্রপাত রেকর্ড করা হয়েছে, সেখানে এখন ওই একই সময়ে তিনবার বজ্রপাত হচ্ছে। জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, অত্যধিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার, গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধির কারণে গোটা বিশ্বেই বজ্রপাত বাড়ছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও বিসিএস’র ফেলো ড. সমরেন্দ্র কর্মকার ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশে বজ্রপাত ও এতে মৃত্যু দুটোই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এ জন্য বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় রয়েছে। কারণ, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প আসে। এদিকে উত্তর দিক থেকে উষ্ণতা নিয়ে জলীয় বাষ্প আসায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ।
আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের (এসএমআরসি) বিজ্ঞানী আবদুল মান্নান বলেন, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানির দিক দিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। সার্কভুক্ত অন্য দেশের তুলনায় মৃত্যুর হারও বেশি। এর হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সচিব


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ