Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

দশ বছরে দেশের উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে?

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

প্রত্যেক সরকারই মনে করে, তার সময়ে দেশে যত উন্নয়ন হয়, আর কোনো সরকারের আমলে হয় না। বর্তমান সরকারের সময়েও প্রতিদিন এ কথা বলা হচ্ছে। উন্নয়ন নিয়ে এ সরকার এতটাই আত্মতুষ্টিতে ভুগছে যে, অতীতের কোনো সরকার যেন এর ধারেকাছেও যেতে পারেনি। এ সরকারের প্রায় দশ বছরের শাসনামলে যে উন্নয়ন হয়েছে তা যেন নজীরবিহীন। তাই সরকার উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে জনসভা করে তাকে ভোট দিয়ে আবারো ক্ষমতায় আনার জন্য বারবার আহ্বান জানাচ্ছে। জনসভায় আগতদের ওয়াদা করিয়ে ভোট নিশ্চিত করা হচ্ছে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, তার চলমান দুই মেয়াদে যে ইতিহাস সৃষ্টি করা উন্নয়ন হয়েছে, তাতে তাকে পুনরায় ভোট না দেয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এমন আত্মবিশ্বাসী যে, তাদেরকে পুনরায় নির্বাচিত করা ছাড়া জনগণের সামনে যেন আর কোনো বিকল্প নেই। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তো বলেই ফেলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি কেবল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তার কথার অর্থ এমন হতে পারে, জনগণ বর্তমান সরকারের উন্নয়নে যারপরনাই খুশি এবং আগামী নির্বাচন না হলেও চলে। শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য নির্বাচন করতে হবে বলে করা হবে, এর বেশি কিছু নয়। আবার সরকারের অভূতপূর্ব এই উন্নয়ন নিয়ে নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজের অনেকে কেন কথা বলছেন না এবং প্রভাবশালী পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য মিডিয়ায় কেন লেখালেখি হচ্ছে না, এ নিয়েও তার বেশ অক্ষেপ রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রায়ই কটাক্ষ করে বলা হয়, তারা কী সরকারের উন্নয়ন দেখে না? তারা কি অন্ধ? তাদের কি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে? সরকারের পক্ষ থেকে এমন ক্ষোভ প্রকাশ করা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, সে তার উন্নয়নের ব্যাপারে অন্ধ। সে মনে করে, তার আমলে যে উন্নয়ন হয়েছে বা হচ্ছে, ভবিষ্যতে তা আর কেউ করতে পারবে না। ফলে যখন নাগরিক সমাজের অনেকে বা প্রভাবশালী মিডিয়াগুলো যখন সরকারের প্রভুত উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে কথা না বলে কিংবা লেখালেখি না করে, তখন তার রাগ হতেই পারে। সে বলতেই পারে, তোমরা কেন সমস্বরে বলছ না এবং শ্লোগান দিচ্ছ না, এ সরকারের মতো উন্নয়ন বাংলার ইতিহাসে আর কেউ করতে পারেনি, পারবেও না এবং এই সরকারকেই চিরকাল ক্ষমতায় দেখতে চাই। তবে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন নিয়ে তার সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াগুলো যে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে না, তা নয়। তারা নিরন্তর বলে যাচ্ছেন। তারপরও সরকারের মন ভরছে না। কারণ, সরকার ভাল করেই জানে, তারা তার সমর্থক এবং প্রশংসা করবেই। সরকার এটাও জানে, দলবাজ হওয়ায় তাদের এ প্রশংসা জনগণের কাছে খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হয় না বা হচ্ছে না। কাজেই তাদের পাশাপাশি নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী এবং মিডিয়ার প্রশংসা দরকার। নিজ সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ার সাথে যদি নিরপেক্ষদের প্রশংসা যুক্ত হয়, তবে উন্নয়ন শ্লোগানের ষোলকলা পূর্ণ হয়। এ কাজটি কেন নিরপেক্ষরা করছেন না, এ নিয়েই সরকারের দারুণ রাগ-ক্ষোভ। সরকারের এই যে অন্তহীন সাফল্যের মধ্যে কত কি রয়েছে! মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের সার্টিফিকেট পাওয়া, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, পদ্মাসেতুসহ আরো কত কত উন্নয়ন! অথচ নিরপেক্ষবাদীরা এগুলোর প্রশংসা করে কোনো কথা বলছে না। তারা কেবল গণতন্ত্র নেই, সুশাসন নেই, আইনের শাসন নেই, মানবাধিকরা নেই, এই নেই, সেই নেই-এর মধ্যে আছে।
দুই.
যে কোনো সরকারের জন্য পরপর দুইবার বা দশ বছর ক্ষমতায় থাকা বিরাট সৌভাগ্য এবং চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। স্বৈরাচার হিসেবে পরিচিত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছাড়া আর কোনো সরকার এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকেনি। অবশ্য দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আইয়ুব খান একনাগাড়ে দশ বছর একইভাবে দেশ শাসন করেছিলেন। তিনিও মানুষের সামনে উন্নয়নের ঝান্ডা উড়িয়েছিলেন। উন্নয়নের দশকপূর্তি উৎসব করেছিলেন। গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা বঞ্চিত দেশের মানুষ অত্যাচার-নিপীড়নের মধ্যে মুখবুজে আইয়ুব খান ও এরশাদের শাসনামলে বসবাস করেছে। অবশ্য তাদের মধ্যে এই সান্ত¦না ছিল, তারা স্বৈরাচার, তারা এমন করতেই পারে। তবে গণতান্ত্রিক কোনো রাজনৈতিক দল যদি এমন আচরণ করে, তবে তাদের দুঃখ অন্তহীন হয়ে পড়ে এবং তা ভাবতেও পারে না। তারা কল্পনাও করেনি, প্রথমবার বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে পরেরবার ঐ একই দল ত্রুটিপূর্ণ ও বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে স্বৈরাচারের মতো আচরণ করবে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সুশাসন, বাকস্বাধীনতার মতো মৌলিক বিষয়গুলো পেছনে ঠেলে আইয়ুব খানের মতো জনগণকে উন্নয়নের চশমা পরিয়ে দেশ শাসন করবে। উন্নয়নের এমন ধোয়া তুলবে, যাতে দেশবাসী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল যেন এই কাজটিই নিরন্তর করে চলেছে। তবে হ্যাঁ, উন্নয়ন যে একেবারে হচ্ছে না, তা নয়। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। কোনো দেশের উন্নয়নই স্থবির হয়ে পড়ে থাকে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার যেভাবে উন্নয়নের জোয়ার তুলছে, সেভাবে হচ্ছে কিনা? গণতন্ত্র, সুশাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বজায় থাকলে যে হারে উন্নয়ন হওয়ার কথা, তা হয়েছে কিনা? কিংবা এসব দমিয়ে যে গতিতে উন্নয়ন হওয়ার কথা, সে গতি পেয়েছে কিনা? সাধারণ অর্থে একটি দেশের উন্নয়নের মূল সূচক হচ্ছে, সে দেশের সাধারণ মানুষ কতটা স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে পারছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের মানের উন্নয়ন বিগত দশ বছরে যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে কতটা হয়েছে? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দেয়া মুশকিল। সরকারি দল নিশ্চিতভাবেই বলবে, যেভাবে উন্নতি হওয়ার কথা, তার চেয়ে বেশি হয়েছে। এর বিপরীতে সরকারের বাইরে যারা রয়েছে এবং নির্মোহভাবে যারা বিচার করেন, তারা বলবেন দশ বছরের সময়কালে যেভাবে উন্নতি হওয়ার কথা, সেভাবে হয়নি বা এ সময়কে ছাপিয়ে যায়নি। অনেকেরই ধারণা, এ সরকারের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, উন্নয়নকে কাগজে-কলমে বেশি দেখানো যার সাথে বাস্তবতার যথেষ্ট পার্থক্য থেকে যায়। বাংলাদেশ যে স্বল্প উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে, তা আরও পাঁচ বছর আগে দেখালেও এমন কোনো হেরফের হতো না। কারণ মার্চ মাসে এসে এ ঘোষণা দেয়ার পর দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সাধারণ মানুষের জীবনমান যে রাতারাতি বদলে গেছে, তা কিন্তু হয়নি। তারা বিগত বছরগুলোর মতো যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেছে। এই সময়ে ঘোষণা দেয়ার কারণ হচ্ছে, সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষের দিকে। সামনে নির্বাচন। কাজেই জনগণকে তার সাফল্যের চমক দেখানো খুবই জরুরী। তাকে দেখাতে হবে, সরকার ব্যাপক উন্নয়ন তো করেছেই এবং বাংলাদেশ ধনীও হয়েছে। এখন দেখা যাক, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে হলে কী শর্ত পূরণ করতে হয়। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের উন্নয়ন নীতিবিষয়ক কমিটির (সিডিপি) শর্ত অনুযায়ী মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, এই তিনটির যে কোনো দুইটির নির্ধারিত পয়েন্ট অর্জন করলেই উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি লাভ করা যায়। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে তিনটি শর্ত পূরণ করেছে বলে দেখানো হয়েছে। ফলে আমরা উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি এবং তা পরবর্তী ৬ বছর ধরে রাখতে পারলে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাব। বলা বাহুল্য, এসব সূচকের যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়, তা সাধারণত সরকারের দেয়া পরিসংখ্যানের ওপরই সিডিপি নির্ভর করে। আর আমরা জানি, কোনো সরকারই পরিসংখ্যানে তার উন্নয়নকে এক সূতাও কম দেখায় না, বরং যতটা সম্ভব বাড়িয়েই দেখায়। এ প্রেক্ষিতে, সরকার তার মতো করে উন্নয়নের সূচক দেখিয়েছে এবং তা মেনে সিডিপি উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক স্বীকৃতি দিয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, সরকার মাথাপিছু আয় দেখিয়েছে ১৬১০ ডলার। উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে এ আয় ১২৩০ ডলার হলেই চলে। মানব সম্পদ সূচক সরকার দেখিয়েছে ৭২.৯ পয়েন্ট। এক্ষেত্রে প্রয়োজন ৬৬। আর অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হয় ৩২ পয়েন্ট বা এর কম। সরকার দেখিয়েছে ২৪.৮। আপতদৃষ্টিতে পরিসংখ্যানগত এই হিসেবে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে। তবে বাস্তব চিত্র কি এতটাই উন্নত? আমরা যদি মাথাপিছু আয়ের কথা ধরি, তবে তা পুরোপুরি হাইপোথেটিক্যাল বা শুভংকরের ফাঁকির মধ্যে পড়ে যায়। এর মধ্যে বেকার এবং কর্ম উপযোগী হয়নি এমন মানুষেরও আয় ধরা হয়েছে। একেবারে সাধারণ একটি হিসাব যদি করা হয় তবে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। যেমন পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের মাথাপিছু আয় যদি ১৬১০ ডলার ধরা হয়, তবে এই পরিবারের মাসে আয় দাঁড়ায় (এক ডলারের ৮০ টাকা মূল্যমান ধরে) ৫৩ হাজার ৬৬৬ টাকা। এখন এমন আয়ের পরিবার বাংলাদেশে কয়টি আছে, তা হিসাব করা পাঠকের কষ্ট হওয়ার কথা নয়। আবার সরকারই বলছে, দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৯০ ভাগই রয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে কম মানুষের কাছে। তাহলে সরকারের মাথাপিছু এই আয়ের হিসাবটি কি সঠিক? এখন সরকার যদি এই ১০ শতাংশ মানুষের উন্নতিকেই গোটা বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় হিসেবে ধরে নেয় তবে কিছু বলার নেই। গত মঙ্গলবার সরকার ঘোষণা করেছে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৫২ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষের দিন দিন কেবল আয় বাড়ছে। অবশ্য সরকার তার উন্নয়ন দেখাতে এ ঘোষণা দিতে পারে। আবার যদি চার হাজার ডলারও ঘোষণা করে দেয়, তাতেও কিছু আসবে যাবে না। কারণ এ আয়ের চেয়ে বেশি আয় হয় ঐ ১০ শতাংশ মানুষের। এদের আয় ধরে যদি মাথাপিছু আয় ঘোষণা করা হয় তবে তা কে হিসাব করতে যাবে? দারিদ্র্যতার হিসাবের বিষয়টিতেও এমন ফাঁকফোকর রয়েছে। দরিদ্ররা তো পরিশ্রম করে হলেও কিছু আয় করে, বেকারদের তো সেই সুযোগও নেই। পত্র-পত্রিকার হিসাব অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ৬ কোটি ৩৫ লাখের মতো। এদের মধ্য থেকে কর্মে যোগদানের হার খুবই কম। তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রের দুর্দশার চিত্র নিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রায় নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। এই যেমন গত ২৮ মার্চ একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এখন প্রায় আড়াই কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। বিগত ১০ বছরে অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৭ লাখ। এখন সরকারের কথা মতো দেশ যদি উন্নয়নের স্বর্ণশিখরে অবস্থান করে থাকে, তাহলে কোটি কোটি মানুষ কেন অপুষ্টিতে ভুগবে এবং বেকার থাকবে? সরকার বলতে পারে, এসব প্রতিবেদন নিছকই সরকারের বিরোধিতা করার জন্য করা হয়েছে। সরকারের ভাল চায় না বলে, এসব অপপ্রচার করা হচ্ছে।
তিন.
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সরকারের দশ বছরের শাসনামলের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পর দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ খুব কমই হয়েছে। একটি স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার যেভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশি-বিদেশি সকলের সহযোগিতা পায়, এ সরকার সেভাবে পাচ্ছে না। উল্টো সম্প্রতি স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় ঠাঁই পেয়ে বদনামের ভাগিদার হয়েছে। যদিও এ ধরনের অভিযোগ আরও আগেই বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা থেকে শুরু করে অন্যান্য সংস্থা করেছে। তারা বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে এমন কথা বলেছে। বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলো তো বলছেই। তবে তাদের কথা বাদ দিলেও সাধারণ মানুষ যে সরকারের এ ধরনের আচরণের কথা জানে না বা বোঝে না তা মনে করার কারণ নেই। ভিন্ন মত সহ্য করার ক্ষেত্রে সরকারের অসহনশীলতার বিষয়টি তারা ভালভাবেই জানে। এতে অবশ্য সরকার কিছুই মনে করছে না। বরং তার আচরণে ও কথা-বার্তায় এটাই ফুটে উঠছে, তারা অনেক বেশি শক্তিশালী এবং তাদের মোকাবেলা করার শক্তি বাংলাদেশে নেই। তার বিরুদ্ধে যায় এমন মত ও পথ যারা অবলম্বন করবে, তাদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে দমন করা হয় বা হবে। একদিকে দমন অন্যদিকে উন্নয়ন-এটাই এখন সরকারের নীতি। সরকার গণতান্ত্রিক যে মূল্যবোধ বা এর যে মৌলিক বিষয়, সেগুলো পেছনে ঠেলে কেবল উন্নয়নকে আকড়ে ধরেছে। অথচ আমাদের দেশের মানুষের মৌল চরিত্রই হচ্ছে গণতান্ত্রিক মানসিকতা ধারণ করা। মানুষের চাওয়া-পাওয়া এই গণতন্ত্রকে ধারণ করেই গড়ে উঠেছে। এখানে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে সমান তালে চালাতে হয়। তা নাহলে যে উন্নয়ন হয়, তাতে জবাবদিহিতা থাকে না, টেকসইও হয় না। আমাদের দেশের মূল সংকট এখন এখানেই। উন্নয়নমূলক যেসব প্রকল্প ও পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেগুলো কতটা টেকসই হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, দেশের সব মত-পথের মানুষকে সমন্বয় করতে না পারলে বা বিভক্ত রেখে যতই উন্নয়নের কথা বলা হোক না কেন, তার সুফল খুব কমই পাওয়া যায়। আইয়ুব খানের আমলেও এমন অনেক উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। তাতে মানুষ খুশি হতে পারেনি। এর কারণ, তার শাসনের ধরন এবং আচরণ মানুষ পছন্দ করেনি। তারাই পছন্দ করেছিল, যারা সরকারকে টিকিয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পেরিছিল। সরকারও তাদের এন্তার সুযোগ-সুবিধা দিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। এ সরকারের সময়ও এমন একটি প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিরোধী মত দমনে রাষ্ট্রের যেসব ইন্সট্রুমেন্ট যেমন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যান্য যেসব বাহিনী রয়েছে, তাদের সুযোগ-সুবিধা শত গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এদের অসামান্য উন্নতি হয়েছে। সরকারের দৃঢ় বিশ্বাস, এসব রাষ্ট্রযন্ত্র তার পক্ষে থাকলে অন্য কারো পক্ষে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো সম্ভব হবে না। আর জনগণের পক্ষে কথা বলার রাজনৈতিক দল ও মতকে যদি দমিয়ে রাখা যায়, তবে জনগণেরও কথা বলার সুযোগ থাকবে না। বরং নিজেদের কথা জনগণের বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। বাস্তবেও তাই দেখা যাচ্ছে। জনগণের বাক স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে উন্নয়নের ফানুস উড়ানো হচ্ছে। আর সরকারকে ঘিরে গড়ে ওঠা স্বার্থেন্বেষী মহলও তার গুণগান গাইছে। এখনতো সরকারকে উৎসাহ দিয়ে কেউ কেউ বলছেন, বিশ্ব থেকে বহু আগে সমাজতন্ত্র বিদায় নিয়েছে, গণতন্ত্রও অকার্যকর হয়ে পড়ছে, কাজেই অন্য কোনো তন্ত্র দিয়ে দেশ শাসন করতে হবে। অর্থাৎ সরকার যে তন্ত্র ধারণ করে বা যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, এটাই ঠিক আছে। তারা এ উদাহরণ দিয়ে বলছেন, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া এভাবেই উন্নতি করেছে। তারা এ কথা বলছেন না, এ দুটি দেশ বিগত দশ বছরে যে হারে উন্নতি করেছে, বাংলাদেশ তার ধারে কাছে আছে কিনা। তারা কিসের সাথে কী তুলনা করেন! তারা এটা ভাবেন না, ঘোড়ার গাড়ির সাথে সুপার সনিক বিমানের তুলনা চলে না। আমাদের দেশের গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রকামী মানুষের সাথে বিশ্বের অন্য কোনো দেশের তুলনা করার অর্থই হচ্ছে, বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। আমাদের দেশকে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, আইনের শাসনকে ধারণ করেই দেশ পরিচালনা ও উন্নতি করতে হবে। এসব স্তব্ধ করে বা মানুষকে অসন্তুষ্ট রেখে উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। যদি তাই হতো, তবে আইয়ুব খান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকেই জনগণ চিরকাল ক্ষমতায় বসিয়ে রাখত। এতো আন্দোলন করত না, জীবনও দিত না।
চার.
নিজের উন্নতি চায় না, এমন একজন মানুষও পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়ন স্পৃহা তো আকাশ ছোঁয়া। উন্নতির জন্য তারা দিনরাত পরিশ্রম করে। তাদের এই উন্নতির আকাক্সক্ষাকে যে সরকার ধরতে পারবে, তার সাফল্য অবশম্ভাবী। বর্তমান সরকার কী তার প্রায় দশ বছর শাসনামলে জনগণের এই আকাক্সক্ষা ও চাহিদা ধরতে পেরেছে? যদিও ক্ষমতাসীন দল প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে, কেবল তারাই ক্ষমতায় এলে দেশের উন্নয়ন হয়। অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিল, সে সময় কিছুই হয়নি এবং তারা নিজেদের উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি তাই হয়, তবে বাংলাদেশ যে স্বল্প উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক ধাপে পা দিয়েছে, এটা কি শুধু এই সরকারের কারণেই হয়েছে? অতীতের সরকারগুলোর কি কোনোই অবদান নেই? বাস্তবতা হচ্ছে, একটি দেশ হুট করেই উন্নতি করে না। উন্নতি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম। অনেকে তো বলেন, এ সরকারের আমলে ব্যাংক লুটসহ আর্থিক খাতে যে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি ও পাচার হয়েছে তা যদি না হতো এবং গণতন্ত্রের স্বাভাবিক গতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, সুশাসন মানসম্পন্ন অবস্থায় থাকত, তাহলে পাঁচ বছর আগেই দেশ অনেক উন্নতি সাধন করত। তার অর্থ, উন্নতির ক্ষেত্রে আমারা পাঁচ বছর পিছিয়ে গিয়েছি। বিনিয়োগে মন্দাবস্থা, বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠিত কল কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, টাকার মান কমে যাওয়া, মানুষের জীবনযাপনে টানাপড়েন সৃষ্টিসহ নানা সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। জীবনযাপন করতে গিয়ে মানুষের সঞ্চিত অর্থ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আয়ের সাথে ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছে না। সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের এই কষ্টের জীবন সম্পর্কে কি সরকার জানে? অন্যদিকে সাধারণ মানুষেরও কোনো যাওয়ার জায়গা নেই। তারা যে মত প্রকাশ করে সরকারের কর্মকান্ড পছন্দ করছে না, তারও সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। ভোটের মাধ্যমে তাদের মত প্রকাশের যে জায়গাটি রয়েছে, তাও নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল স্থানীয় থেকে শুরু করে সব নির্বাচনেই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। মানুষ যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে এর জবাব দেবে, সে অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হয়েছে।
[email protected]

 



 

Show all comments
  • SHAUKAUT ৬ এপ্রিল, ২০১৮, ৮:৫২ এএম says : 0
    eto jukti diee lavh nei onek khela hoeche shekher beti desh chalahe ete shobai ongsho grojonkore deshke egiee neaa dorkar shorkar sthai jole desh ekta obosthane ahe thanks from venezuela.
    Total Reply(0) Reply
  • Mb.Sohel ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮, ২:৪৯ পিএম says : 0
    ২০০১ হতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বি,এন,পি জামাত সরকার ও ২০০৯ হতে ২০০১৩ সাল পর্যন্ত বর্তমান আওয়ামীলীগের মাহাজোট সরকারের উন্নয়নের প্রধান প্রধান কিছু খাতের তুলনা মুলক চিত্র তুলে ধারা হলো। আশাকরি সাবই বিচার করবেন দেশ পরিচালনার জন্য কাদের দরকার।  প্রবৃদ্ধি অর্জন। বি,এন,পি ২০০৬ = ৫.৭% আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ৬.৭%  মাথাপিছু গড় আয় বি,এন,পি ২০০৬ = ৪২৭ র্মাকিন ডলার আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ৯১৪ র্মাকিন ডলার  সাক্ষরতার হার। বি,এন,পি২০০৬ = ৫১.৯০% আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ৬৫.০৪%  রেমিটেন্স প্রবাহ। বি,এন,পি ২০০৬ = ১৩ বিলিয়ন র্মাকিন ডলার আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ৪৮ বিলিয়ন র্মাকিন ডলার  দারিদ্র হার বি,এন,পি ২০০৬ = ৪১.৫১% আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ২৯.০৩%  প্রসবকালীন মৃত্যুর হার। বি,এন,পি ২০০৬ = ১লক্ষ ৩৮৫ জন। আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ১ লক্ষ ১৩২ জন।  কর্মসংস্থান। বি,এন,পি ২০০৬ = ২৪ লক্ষ আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ৭৫ লক্ষ  বৈদেশিক বিনিয়োগ। বি,এন,পি ২০০৬ = ১৮৭ কোটি র্মাকিন ডলার আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ৩৮২ কোটি র্মাকিন ডলার।  মাতৃত্বকালীন ছুটি। বি,এন,পি ২০০৬ = ৪মাস। আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ৬ মাস।  ইন্টার নেট গ্রাহক সংখ্যা। বি,এন,পি ২০০৬ = ৫৭ লক্ষ আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ৪ কোটি  জনশক্তি রপ্তানি। বি,এন,পি ২০০৬ = ৯ লক্ষ ৮ হাজার আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ২০ লক্ষ ৪০ হাজার  শিশু মৃত্যুর হার। বি,এন,পি ২০০৬ = ৬.১০% আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ৩.৯৯%  প্রত্যাশিত আয়ু। ক্স ২০০৬ = ৫৬ বছর। আওয়ামীলীগ২০১৩ = ৭১ বছর।  পোষাক রপ্তানিতে বিশ্বের অবস্থান। বি,এন,পি ২০০৬ = চর্তুথ। আওয়ামীলীগ ২০১৩ = দ্বিতীয়।  খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি। বি,এন,পি ২০০৬ = ৩০ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্য (ঘাটতি) আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ২৩ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্য ( উদ্বৃত)  স্বাস্থ সেবা। বি,এন,পি ২০০৬ = অসম্মতি আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ১৫ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্টা  সর্বোচ্চ বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা। বি,এন,পি ২০০৬ = ৩১০০ মেগাওয়াট। আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ৮৫২৫ মেগাওয়াট।  জ্বালানী তেলের মুল্য বৃদ্ধি গড়। বি,এন,পি ২০০৬ = ১৩৬% বিএনপি ২০১৩ = ৩৮%  সমুদ্র সীমা জয়। বি,এন,পি ২০০৬ = নিস্ক্রিয় আওয়ামীলীগ২০১৩ = ১১১৬৩১ বর্গ কি, মি,  শ্রমিকদের নুন্যতম মজুরি। বি,এন,পি ২০০৬ = ১৬৬২ টাকা। আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ৩০০০ টাকা।  রপ্তানি আয়। বি,এন,পি ২০০৬ = ১.০৩ বিলিয়ন র্মাকিন ডলার। আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ২.৪৩ বিলিয়ন র্মাকিন ডলার।  হাসপাতালের সংখ্যা। বি,এন,পি ২০০৬ = ১৬৮৩ টি। আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ২৫০১ টি।  পবিত্র হজ্ব পালন। বি,এন,পি ২০০৬ = ৪০ হাজার যাত্রী ( সার্বোচ্চ) আওয়ামীলীগ২০১৩ = ১ লক্ষ ১০ হাজার যাত্রী ( সর্বোচ্চ)  মোবাইল গ্রাহক সংখ্যা। বি,এন,পি ২০০৬ = ২ কোটি ৩৬ লক্ষ ১০ হাজার। আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ৯ কোটি ৮৪ লক্ষ ৭০ হাজার।  জেলেদেরকে খাদ্য সহায়তা। বি,এন,পি ২০০৬ = ৬৫০০ মেট্রিক টন। আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ৫৬২০০ মেট্রিক টন।  দৈনিক গ্যাস উত্তোলন। বি,এন,পি ২০০৬ = ১৫৩১ মিলিয়ন ঘনফুট । আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ২২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট।  বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বি,এন,পি ২০০৬ = ৩.৮৮ বিলিয়ন র্মাকিন ডলার আওয়ামীলীগ২০১৩ = ১৩.১১ বিলিয়ন র্মাকিন ডলার।  টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা। বি,এন,পি ২০০৬ = ৭টি। আওয়ামীলীগ ২০১৩ = ১৬ টি। আশাকরি সাবই নিজে বিবেচনা করে দেখবেন, কে বা কারা দেশের জন্য বা দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য প্রযজ্য। কারা দেশকে প্রকিৃত ভালবাসে, কারা সত্তি কারের দেশ প্রেমিক। দেশ উন্নয়নেয় জন্য কাদের প্রযোজন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উন্নয়ন

২৩ ডিসেম্বর, ২০২২
১৮ ডিসেম্বর, ২০২২
২৮ অক্টোবর, ২০২২
২ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন