Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

পাবলিক পারসেপশন গুরুত্বহীন নয়

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বিচিত্র এই বাংলাদেশ! এ দেশে কার ভাগ্যে কী লিখা আছে তা কেউ উপলব্ধি করা তো দূরের কথা অনুমানও করতে পারে না। এ দেশে কারাগারের ভাত কখন কার রিজিকে নির্ধারিত রয়েছে তাও সকলের উপলব্ধির বাইরে। কারাগারের স্বাদ থেকে অনেক জনপ্রিয় অথবা ইতিহাসের বরপুত্র রেহায় পায়নি। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেও পরে অনেককে কারাগারের স্বাদ উপভোগ করতে হয়েছে। জেনারেল এরশাদ, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, যারা দাপটের সাথে দেশ চালিয়েছেন তাদেরও কারাগারের ভাত খেতে হয়েছে। এটাই প্রতিয়মান হয় যে, মৃত্যুর স্বাদের মতো কারাগারের স্বাদ গ্রহণের সময়ক্ষণ বলা যায় না। তবে রাজনীতিবিদদের কারাগার ততক্ষণ পর্যন্ত স্পর্শ করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ক্ষমতায় থাকেন। স্মরণে পড়ে ১/১১ সরকারের সময়ের ঘটনা, যখন দুই প্রধানমন্ত্রীর (সাবেক ও বর্তমান) সাথে জেলে ছিলাম। তখন শেখ হাসিনা অভিযোগ করে বলেছিলেন যে, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় জোর করে তাকে তুলে নিয়ে জাতীয় সংসদ ভবনে স্থাপিত ক্যাঙ্গারু কোর্টে হাজির করা হয়। তিনি এটাও অভিযোগ করেছিলেন যে, তার খাদ্যে স্লো পয়জন করা হয়েছে। তার বক্তব্য সত্য মেনে নিয়েই প্রশ্ন করছি যে, এ কাজগুলি কে বা কারা করেছে? যারা স্লো পয়জন দিয়েছে বা চিকিৎসার ব্যাঘাত ঘটিয়ে তাকে ক্যাঙ্গারু কোর্টে জোরপূর্বক হাজির করেছে তারা তো আমেরিকা বা মঙ্গল গ্রহ থেকে আসেনি। তারাতো জনগণের বেতনভুক্ত এ দেশেরই রাষ্ট্রীয় কর্মচারী। বিচার ব্যবস্থার নামে যখন নিবর্তন ও নির্যাতন চলে তখন মানুষের আর্তনাদ বিনাবাক্যে নিঃশ্বাসের সাথে বিলীন হয়ে যায়। মানুষ প্রতিবাদের শক্তি সামর্থ্য হারিয়ে তাকিয়ে থাকে সৃষ্টিকর্তা ও আদালতের দিকে। যখন আদালত কোনো কারণে অসহায় মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে পারে না তখন অসহায় মানুষ শুধু ভরসা করে সৃষ্টিকর্তার উপর। সৃষ্টিকর্তার উপরই যদি প্রতিটি বিষয়ে ভরসা রাখতে হয় তবে মানুষ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নামে কথিত ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখবে কেন? প্রধান বিচারপতিকে যেখানে চাপের মুখে দেশ ত্যাগসহ পদত্যাগ করতে হয় সেখানে বিচার বিভাগের মেরুদন্ড শক্ত রাখার জো কোথায়?

বিচার ব্যবস্থার সৃষ্টির ইতিহাস যদি আমরা পর্যালোচনা করি তবে দেখা যায়, বর্তমান বিচার ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে বর্তমান অবস্থায় পরিণত হয়েছে এর দায়িত্ব হলো বিচারপ্রার্থী ছাড়াও জনগণের আস্থা অর্জন করা। দেশে দেশে বিচার ব্যবস্থার ক্রমবিকাশের ও বিবর্তনের ধারা লক্ষ করে যদি অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করা যায় তবে দেখতে পাওয়া যায় যে, অতীতে আজকের মতো সুসংগঠিত সমাজ ও বিচার ব্যবস্থা পৃথিবীর কোনো দেশেই বিদ্যমান ছিল না। আদিম মানব অরাজক ও নৈরাজ্যের মধ্যে বাস করত। মানুষ স্বভাবত প্রতিহিংসাপরায়ণ। সে আঘাত পেলে প্রত্যাঘাত করে প্রতিশোধ গ্রহণ করে থাকে। হোমসের মতে, মানুষের প্রতিশোধ গ্রহণের সহজাত প্রবৃত্তিই পরিপূর্ণ বিচার ব্যবস্থার ভিত্তিস্বরূপ। আদিম সমাজে কোনো লোক অন্য কোন লোকের কার্যের দ্বারা ক্ষুব্ধ হলে সে নিজ ক্ষমতাবলে লড়াই করে প্রতিশোধ গ্রহণ করত। নিজে একা লড়াই করে প্রতিশোধ গ্রহণে অপারগ হলে তার নিজ পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় প্রতিশোধ গ্রহণ করত। যদি পরিবারের সদস্যদের দ্বারা প্রতিশোধ গ্রহণ করতে অক্ষম হতো তখন নিজ গোত্র বা গোষ্ঠির সদস্যদের সাহায্যে প্রতিশোধ গ্রহণ করত। এক কথায় প্রতিশোধ গ্রহণই তখন প্রতিকারের একমাত্র উপায় ছিল। কিন্তু কোনো ব্যক্তির পক্ষে তার পরিবার, গোত্র বা গোষ্ঠি প্রতিশোধ গ্রহণ করত না যদি না তারা বুঝত যে তদ্রƒপ প্রতিশোধ গ্রহণের যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। প্রতিশোধ গ্রহণের দ্বারা বিচার করার ব্যবস্থা আদিমকাল হতে চলে আসছে। এই প্রতিশোধ গ্রহণের নীতি রোমান আইনে ‘লেকসটেলিওনিস’ হিসেবে অভিহিত হয়েছে। হামুরাবির আইন ও হযরত মুসার আইনে প্রধান ভ‚মিকা পালন করেছে এবং বর্তমানে প্রচলিত বহু আইনে শাস্তিবিধানের মধ্যে তা লুকায়িত আছে (সূত্র: বিচার ব্যবস্থার বির্বতন, পৃষ্ঠা-১ এবং হোমস, অলিভার ওয়েগুল, কমন ল লেকচার)।
হোমসের মতে, মানুষের প্রতিশোধ গ্রহণের সহজাত প্রবৃত্তিই পরিপূর্ণ বিচার ব্যবস্থার ভিত্তিস্থাপন করেছে। হোমস যখন এ মতবাদ বা তথ্য প্রদান করেছেন তখন ছিল প্রাগ ঐতিহাসিক যুগ যখন মানুষ সভ্যতার আলো দেখে নাই। এখন তো মানুষ ‘সভ্যতার’ চরম শিখর অতিক্রম করছে। চাঁদের দেশে বা মঙ্গলগ্রহে মানুষ যখন আবাসন করার চিন্তায় মগ্ন সে মুহূর্তে বিচার ব্যবস্থা প্রতিশোধ পরায়ন হবে কেন?
বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তাশীল গবেষকগণ ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থার সংস্কার করার জন্য মন্তব্য করে বলেছেন যে, PPCC অর্থাৎ (1) P (Police), (2) P (Prosecution), (3) C (Court) & (4) C (Correction). পুলিশ বা প্রসিকিউশন মানে এই নয় যে, সরকার পছন্দ করে না এমন কোন ব্যক্তিকে ফাঁসানোর জন্য মিথ্যা এজাহার, মিথ্যা সাক্ষী, জাল কাগজপত্র তৈয়ারসহ যত ষড়যন্ত্রমূলক কাজ করতে হবে, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রসিকিউশন মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে, বিশেষ করে রাজনৈতিক মামলায়। কোর্টের ভ‚মিকা সম্পর্কে বলতে হয় যে, দুঃখজনক এ কারণে যে, ভ‚তপূর্ব প্রধান বিচারপতি বলেছেন যে, ‘নিম্ন আদালত মানে আইন মন্ত্রণালয়’ অর্থাৎ আইন সচিব দ্বারা নির্দেশিত হয়েই নিম্ন আদালতের বিচার প্রর্থীদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের Correction অর্থাৎ সংশোধন এর প্রশ্নে প্রতিটি জেলখানায় ‘রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ’ লিখা রয়েছে। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষের এ শ্লোগানের সাথে বাস্তবতার কতটুকু মিল রয়েছে তা ভুক্তভোগী সকলেরই জানার কথা।
দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র রূপে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল পাবলিক পারসেপসনের উপর ভিত্তি করে। বিএনপি চেয়ারপার্সনের জামিনের শুনানীকালে মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন যে, ‘আমরা পাবলিক পারসেপনের দিকে তাকাই না।’ যদি তাই হয় তবে জনমত কি খুবই গুরুত্বহীন? বিচার বিভাগের উপর জনগণের আস্থা পরিপূর্ণ করতে হলে পাবলিক পারসেপশন অবশ্য অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। বিচার বিভাগককে প্রতিপক্ষ নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ অনেক পূর্ব থেকেই। এ অবস্থা থেকে বিচার বিভাগকে উত্তরণের ভার প্রথম গ্রহণ করতে হবে প্রধান বিচারপতিকেই। বিচার বিভাগ শুধু স্বাধীন নয়, বিবেকমান বিচার বিভাগ প্রমাণের এখনই সময়। সরকার একতরফা নির্বাচনের মজা পেয়ে গেছে। যারা একতরফা নির্বাচনে সরকার গঠনের স্বাদ পেয়েছে তারা পুনরায় তাই করবে। এ অবস্থায় জাতির পাশে থাকার জন্য অর্থাৎ জনগণ যাতে তাদের ভোটাধিকার সুষ্টভাবে প্রয়োগ করতে পারে এ জন্য সার্বিক দিক বিবেচনা করে বিচার বিভাগের ভ‚মিকা হতে হবে অত্যান্ত জোরালো।

লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাবলিক


আরও
আরও পড়ুন