Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দি গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রতিবেদন : অকার্যকর মেগাসিটি ঢাকা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আসন্ন বর্ষা মওসুম উপলক্ষে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে অকার্যকর মেগাসিটি বলে আখ্যায়িত করেছে ব্রিটেনের দি গার্ডিয়ান পত্রিকা।
পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে বলা হয়ঃ বাংলাদেশের জনবহুল রাজধানী ঢাকায় কয়েক দশক ধরে পয়ঃনিষ্কাশনের কাজ করার সময় দুঃখজনক ঘটনা ঘটতে দেখেছেন সুজন লাল রাউত। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের ঘটনাই ছিল সবচেয়ে মর্মান্তিক। দিনভর প্রবল বৃষ্টির ফলে বরাবরের মত রাস্তাগুলো তলিয়ে গিয়েছিল পানিতে। রামপুরায় পানি আটকে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি ম্যানহোল সাফ করার জন্য ৭ জন নিষ্কাশন কর্মী কাজ শুরু করেন। সাধারণত পয়ঃনিষ্কাশন কর্মীরা পানির স্রোতে ভেসে বা ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচতে কাজের সময় শরীরে দড়ি পেঁচিয়ে রাখেন। তবে এ কর্মীরা ছিলেন কাজে নতুন। তারা আসন্ন বিপদ সম্পর্কে জানতেন না বা এ ধরনের পরিস্থিতিতে কিভাবে কাজ করতে হয় সে অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। তাই পয়ঃনিষ্কাশনের পানিতে তারা ডুবে যান। পথচারীরা হাতুড়ি আর শাবল দিয়ে রাস্তা খুঁড়ে তাদের তিন শ্রমিককে মৃত অবস্থায় বের করে আনেন। ৪ জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন। একজন পরে হাসপাতালে মারা যান। এ দুর্ঘটনা আমাদের মধ্যে আতংকের সৃষ্টি করে। এর পর কয়েকমাস পর্যন্ত ড্রেনের দিকে তাকাতেও আমরা ভয় পেতাম।
বাংলাদেশে বর্ষা মওসুমে ঢাকার কিছু অংশ মাসে কয়েকবার তলিয়ে যায়। নালাগুলো পানিতে উপচে পড়ে অকার্যকর হয়ে যায় এবং নিচু এলাকাগুলো পানি ভরা বাথটাবের মত হয়ে ওঠে। ঢাকা ট্রিবিউনের মত সংবাদপত্রগুলোতে ভিড়ে ঠাসা বাসগুলোর পানির মধ্য দিয়ে চলার ছবি এবং যাত্রী ও নগর বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য ‘ঢাকা আবার পানির নিচে’ , ‘সেই একই পুরনো কাহিনী’ শিরোনামে খবর ছাপা হয়েছিল।
রাস্তার পাশে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেও নিষ্কাশন কর্মীরা কাজে নিয়োজিত হন। কেউ ম্যানহোলগুলোতে বাঁশের লাঠি প্রবেশ করিয়ে খুঁচিয়ে ময়লা পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন। অন্যরা অর্ধনগ্ন হয়ে তরল নোংরার মধ্যে নামেন ও খালি হাতে সেই নোংরা ময়লা আর্বনা পরিষ্কার করতে বাধ্য হন। গত বছর গলা পর্যন্ত আবর্জনার মধ্যে ডুবে কাজ করার ছবি ভাইরাল হয় পড়লে বিশ^ মিডিয়া তাকে ‘বিশে^র নিকৃষ্ট কাজ’ বলে ঘোষণা করে।
ইউএন হ্যাবিটাট-এর মতে, ঢাকা হচ্ছে বিশে^র সবচেয়ে জনবহুল শহর। এর প্রতি কিলোমিটার জায়গায় ৪৪ হাজার ৫শ’ জন লোক আছে এবং প্রতিদিন গ্রাম এলাকা থেকে আরো মানুষ আসছে। ঢাকা বসত ও আবর্জনার শহর। জনসংখ্যার চাপে ধুঁকতে থাকা রাজধানীতে পয়ঃনিষ্কাশনকারীরা তাদের স্বাস্থ্য ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাসিক প্রায় ২২৫ পাউন্ড আয় করেন।
মানুষ বেশি, সম্পদ অতি সামান্য
ঢাকা হচ্ছে অতিরিক্ত জনসংখ্যার টেক্সটবুক উদাহরণ। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক নুরুন নবী বলেন ( তিনি বলেন, তারা আমাকে পপুলেশন ম্যান বলে, সুপারম্যান-এর মত), আপনি যদি বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতির কথা বলেন, ঢাকা হচ্ছে বিশে^ জনসংখ্যার দিক দিয়ে দ্রæত বেড়ে ওঠা নগরী। কোনো স্থানে যে পরিমাণ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারেন তার চেয়ে বেশি মানুষ যদি বসবাস করেন তাহলে তাকে ঘনবসতিপ‚র্ণ বলে আখ্যায়িত করা হয় ঘনবসতিপ‚র্ণ বলে ।
অতিরিক্ত জনবহুল না হলেও নগরগুলো ঘনবসতি সম্পন্ন হতে পারে। ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশ সিঙ্গাপুরে অধিক জনঘনত¦ রয়েছে, প্রতি বর্গ কিলোমটারে ১০,২০০ জন। কিন্তু খুব কম মানুষই একে ঘিঞ্জি বলবে। এ নগরীতে অধিবাসীদের স্থান সংকুলান করা হয়েছে বহুতল ভবনগুলোতে। কিছু মানুষ থাকে ছাদের উপর ‘স্কাই গার্ডেন’ ও রানিং ট্র্র্যাকে।
অতিরিক্ত জনবহুল তখনি হয় যখন একটি নগরী ব্যবস্থাপনার চেয়েও দ্রæত বেড়ে ওঠে।
আমি এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছি
পয়ঃনিষ্কাশন কর্মী সুজন বলেন, সরকার ঢাকা মহানগরীকে ভালোভাবে ব্যবস্থাপনার চেষ্টা করছে , কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী সফল হচ্ছে না।
বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ দেশে তার পেশায় অনেকের মত সুজনও হিন্দু। হিন্দুরা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিপীড়িত হয়েছিল। এখনো তারা বৈষম্যের শিকার। তিনি একজন দলিতও, এশিয়া ব্যাপী যারা অস্পৃশ্য বলে পরিচিত। বাংলাদেশে ঘৃণা করে তাদের মেথর বলা হয়।
সুজন বলেন, আমি পূর্বপুরুষের এ পেশায় জড়িত। আমি আর কোনো কাজ জানি না। লম্বা, ৪০-এর ঘরে বয়স, ঘন গোঁফের সুজন বলেন, আমার পরিবার প্রতিপালন করতে হয়, সন্তানদের লেখাপড়া আছে, প্রতি মাসে ঘর ভাড়াসহ অন্যান্য বিল দিতে হয়। আমি এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছি যদিও জানি এটা আমাকে অসম্মান ও অপমান ছাড়া আর কিছু দেয়নি।
এ এক ধন্যবাদহীন, বিপজ্জনক কাজ। সেপ্টিক ট্যাংক পরিষ্কার করার সময় সেটা বিস্ফোরিত হয়ে মারা যান সুজনের এক বন্ধু। সম্প্রতি সুজনের ভাই সুশীল ১০ ফুট গভীর ম্যানহোল পরিষ্কার করতে গিয়ে বিপদে পড়েন। তিনি বলেন, আমাদের যদি একটি ওয়াশার বা পাম্প মেশিন থাকত তাহলে ঝুঁকি কমত। আমরা ম্যানহোল পরিষ্কার করার আগে সেটা পাম্প দিয়ে শুকিয়ে নিতে পারতাম। তাছাড়া নিচে নামার জন্য আমাদের মই দরকার। কিন্তু আমাদের শুধু কাজ করার হুকুম দেয়া হয়। তখন আমাদের লোক যোগাড় করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শেষ করতে হয়।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যের উপর এর প্রতিক্রিয়া আছে। নোংরার মধ্যে ডুবে কাজ করলে রহস্যময় চুলকানি হয়। তার মতে,সুয়ারেজ লাইনগুলো পচা ময়লার কারণে অ্যাসিড যুক্ত ও বিষাক্ত। সুতরাং পরিচ্ছন্নতাকারীদের স্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষ করে ত¦কের সমস্যা নিশ্চিত। তবে প্রায়ই তারা তা উপেক্ষা করে দেশী মদ কিনে পান করে, নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এক সময় পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। যদি তারা হুঁশে থাকত তাহলে বুঝতে পারত যে ধীরে ধীরে কি ক্ষতি তাদের হয়েছে।
ন্যূনতম বাসযোগ্য নগরী
ঢাকায় বাস করা মানে নানা রকম দুর্ভোগ পোহানো। অনুন্নত এলাকাগুলোতে জড়াজড়ি করে বাস করে দরিদ্ররা। ঢাকার জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই বস্তিবাসী। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের সময়ের বড় একটা অংশ কেটে যায় ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে পড়ে। ঢাকা নিয়মিত ভাবে ন্যূনতম বাসযোগ্য শহরের তালিকায় থাকে। এ বছর লাগোস, ত্রিপোলি ও দামেস্কের পরেই আছে ঢাকা।
অধ্যাপক নুরুন নবী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে, ’৬০-এর দশকে ঢাকার খালি রাস্তায় গাড়ি চালানো যেত। শহরের পুরনো অংশে মোঘল আমলের খালগুলোতে মানুষজন গোসল করতে পারতো। তবে উন্নয়নের খাতিরে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। খালগুলো ভরাট হয়েছে। আর এতে করে নষ্ট হয়েছে নিষ্কাশনের অত্যন্ত গুরুত্বপ‚র্ণ একটি উৎসের। বিশ্বের অন্যান্য অংশের মতন, বাংলাদেশও দ্রæত ও অপরিকল্পিত নগরায়নের শিকার হয়েছে। সৌভাগ্যের খোঁজে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ রাজধানীতে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু তাদের জায়গা দেয়ার মতন অবকাঠামো তৈরি হয়েছে কি? গরীব মানুষের থাকার মত সুবিধা কোথায়? অধ্যাপক নবী বলেন, আপনি ভারতে যান, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ। সেখানে আপনি কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদসহ বাস করার মতো অনেক শহর পাবেন। আপনি বেঁচে থাকতে পারবেন। কিন্তু এখানে, আমাদের কাছে এখনো (বাস করার জন্য) আছে কেবল ঢাকাই ।
দুর্বল নগর ব্যবস্থাপনা
ঢাকার নগর ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন প্রতিযোগী সংস্থার মধ্যে পড়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব হচ্ছে প্রধান বাধাগুলোর একটি। ঢাকার জলাবদ্ধতা দ‚রীকরণের জন্য বর্তমানে সাতটি ভিন্ন সরকারি বিভাগ কাজ করছে। এই সংগঠনগুলো একপক্ষ অপরপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর এক হাস্যকর খেলায় মেতে থাকে। এদের মধ্যে রয়েছেন শহরের দুই মেয়রও। গত জুলাইয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন রাস্তায় হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে বলেন, ওয়াসা (ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড সুয়েজ অথরিটি) এর জন্য দায়ী, কিন্তু তাদেরকে তেমন একটা কাজে দেখা যায়না। পালটা জবাবে, ওয়াসা খোকনের ওপর দোষ চাপায়। অন্যদিকে, উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ক্রোধ নিয়ে এক সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেউ আমাকে বলুন সমাধান কি?
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম খান বলেন, নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক উৎসের স্বল্পতা থাকায় সরকারকে কয়েক কিলোমিটার লম্বা পাইপলাইন ব্যবহার করে পানি শহরের বাইরে বের করতে হয়। এছাড়া তিনি জনবহুলতাকেও দোষ দেন। তিনি বলেন, আগে আমরা ৬০ লাখ মানুষের জন্য কাজ করতাম। কিন্ত এখন আমাদের ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষের জন্য কাজ করতে হয়। আর এ কারণে পানি ধারণের প্রাকৃতিক উৎস ও ড্রেন সিস্টেম ধংস হয়ে যাচ্ছে। সেখানে স্থাপিত হচ্ছে বসতবাড়ি। ২০১৩ সালে ঢাকায় খাল খননের একটি চুক্তি করা হয়। তবে সে কাজে এখন পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি।
তবে বাংলাদেশে অকার্যকর প্রশাসন সব সময়ই কিছু করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সাড়া বাংলাদেশের জন্য প্রশংসা বয়ে এনেছে।
কিছু নগরবিদ বস্তি সম্পর্কে বিদ্যমান নেতিবাচক ধারণা পুনর্বিবেচনা করছেন। নগর পর্যায়ে জন্মহ্রাসের প্রবণতা অতিরিক্ত জনসংখ্যার আংশিক সমাধান হতে পারে।
হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ এডওয়ার্ড গিøজার বলেন, নগর এলাকায় গঠিত আবদ্ধ সামাজিক আন্দোলনগুলোর সরকার পরিবর্তন ও সুশৃঙ্খল করার ক্ষমতা আছে।
অধ্যাপক নুরুন নবী বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কথা ভুলে যান, এ জাতির জনগণ কর্তৃক বহু ইতিহাস লেখা হবে। একদিন তারা জেগে উঠবে ও তাদের কথা শুনতে বাধ্য করবে।
উল্লেখ্য, বহুদিন ধরে অবহেলিত হলেও পরিবর্তন হচ্ছে না ড্রেন পরিষ্কারকদের ভাগ্য। ঢাকা শহর যত বড় হচ্ছে এখানে অসমতাও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুজন জানান, তার সমপ্রদায় মুসলিম ও হিন্দু উভয় ধর্মের লোক দিয়েই ভরা। তিনি বলেন, কেউ আমাদের দুর্দশার কথা শুনতে আসেনা, সাংবাদিকরাও না। তার মেয়েরা স্কুলে পড়ে। অথচ তাদেরকে বন্ধুদের কাছে বাবার পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হয়। সুজন বলেন, আমার সন্তানেরা স্কুলে যেতে পারে। কিন্তু তাদেরকে আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হয়। নয়তো তারা অপমানিত হতে পারে বা তাদেরকে সবাই এড়িয়ে চলতে পারে। সুজন বলেন, গোটা সিস্টেম আমাদের বিপক্ষে। আমাদের উন্নতির বিপক্ষে, আমাদের উন্নয়নের বিপক্ষে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের সমপ্রদায়ের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বর্ষা

৩ আগস্ট, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ