Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমাদের বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান চেতনা এবং স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যু

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২১ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আর্ন্তজাতিকভাবে আমাদের জাতিগত অবস্থানের পর্যালোচনা কোন পর্যায়ে তা নিয়ে তেমন কোন তথ্য উপাত্ত না থাকলেও আমরা প্রায়শ: নিজেরাই নিজেদের ‘হুজুগে বাঙালী’ বলে আখ্যায়িত করি। বিশ্বখ্যাত পর্দাথবিদ স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যুর পর আমাদের হুজুগেপনা এবং আত্মপ্রবঞ্চনার একটি বাস্তব দিক ফুটে উঠেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সুত্র ধরে দেশের প্রায় সবগুলো টিভি চ্যানেল ও জাতীয় দৈনিক স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যু সংবাদ ফলাও করে প্রচার করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের গণমাধ্যমগুলো শুধু হকিংয়ের মৃত্যু সংবাদ, জীবন ও কর্মের একদিনের পর্যালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। নানাভাবে বিশেষ আয়োজনের মধ্য দিয়ে স্টিফেন হকিংয়ের স্মরণ ও মূল্যায়ণ চলছেই। স্টিফেন হকিং কোন হলিউডি মেগাস্টার, শোবিজের জনিপ্রয় মুখ বা আলোচিত, প্রভাব সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেননা। অক্সফোর্ড ক্যাম্ব্রিজের একজন অধ্যাপক, পর্দাথ বিজ্ঞানী, যিনি পর্দাথ বিজ্ঞান ও বিশ্বব্রহ্মান্ড বিষয়ক কয়েকটি বই লিখে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছেন। হকিংয়ের সবচেয়ে বেশী অনুদিত ও প্রচারিত গ্রন্থ ‘অ্যা ব্রিফ হিস্টোরি অব টাইম’ আরো অর্ধশতাধিক ভাষার সাথে বাংলায়ও অনুদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। অতএব বাংলাদেশে তার কিছু পাঠক শুভানুধ্যায়ী থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তার মৃত্যুর পর হকিংয়ের কর্মজীবন ও অক্সফোডের সহকর্মীদের নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনায় একটি অমোঘ সত্য বেরিয়ে আসলো, তা হচ্ছে, এই বাংলাদেশের মাটির সন্তান জামাল নজরুল ইসলাম হকিংয়ের সিনিয়র, খুব কাছের ঘনিষ্ট সহকর্মী ছিলেন। স্টিফেন হকিং এবং জামাল নজরুল ইসলামের মধ্যে একটি বহুমাত্রিক পারিবারিক সম্পর্ক ও মেলবন্ধন ছিল, যা জামাল নজরুল ইসলামের ইন্তেকালের পরও অব্যাহত আছে। তার চেয়েও বড় সত্য হচ্ছে, বিজ্ঞানের শিক্ষক, বিশ্লেষক ও লেখক হিসেবে জামাল নজরুল ইসলাম হকিংয়ের চেয়ে বড় ছিলেন। তাদের কর্মজীবন ও লেখালেখির আনুপার্ববিক পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, স্টিফেন হকিং জামাল নজরুল ইসলামকে অনুসরণ করেছেন। গণমাধ্যমে ধারাবাহিক উপস্থিতি, আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ, বইয়ের বিক্রি ইত্যাদির মানদন্ডে স্টিফেন হকিং জামাল নজরুল ইসলামকে তো বটেই, সমসাময়িক বিশ্বের যে কোন বিজ্ঞানী, পর্দাথবিদ বা কসমোলজিস্টকে ছাড়িয়ে গেলেও তিনিই যে সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ পর্দাথবিদ ছিলেন তা কিন্তু হলফ করে বলা যাচ্ছেনা। এএলএস(অ্যামিওট্রপিক লেটারাল স্কেলেরোসিস) নামের দুরারোগ্য মোটর নিউরণ ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে প্রায় অর্ধশত বছর ধরে প্যারালাইজড অবস্থায় পর্দাথ বিদ্যা ও সৃষ্টিত্তত্ত¡ নিয়ে স্টিফেন হকিংয়ের কর্মযজ্ঞ বিশ্বের মানুষের সিম্প্যাথি অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ষাটের দশকের শুরুতে মাত্র বাইশ বছর বয়েসে তার এএলএস রোগ ধরা পড়ার পর ডাক্তাররা ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন তিনি আর বড়জোর দু’বছর বাঁচবেন। এ হিসেবে মাত্র ২৪ বছর বয়েসেই তার জীবনাবসান হওয়ার কথা। ডাক্তারের দেয়া সেই ভবিষ্যদ্বানীকে মিথ্যা প্রমান করে পরবর্তি ৫২ বছর ধরে তার নিরলস, নিশ্চিন্ত কর্মময় জীবন বিশ্বের সাধারণ মানুষের জন্য অনুপ্রেরনার উৎস হয়ে থাকবে। গত ১৪ মাচ ৭৬ বছর বয়েসে মৃত্যুবরণ করার আগ পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টেই নিজের প্রণিধানযোগ্য মতামত ও অবস্থান তুলে ধরতে পিছপা হননি স্টিফেন হকিং। বিগ ব্যাং থিউরী বা থিউরী অব এভরিথিং নিয়ে বই লিখে তিনি কোটি পাঠকের কাছে পৌছে গিয়েছিলেন। তার এই জনপ্রিয়তার কারণে হলিউডের পরিচালকরা তাকে নিয়ে সিনেমা বানিয়ে সাফল্য পেলেও বিজ্ঞানে তার অবদান বিজ্ঞানভিত্তিক প্রামান্য গবেষনা দলিল হিসেবে প্রমাণীত না হওয়ায় নোবেল পুরস্কারের মত পুরস্কার তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। তবে একাত্তুরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অক্সফোর্ডে জিনিয়াস হিসেবে পরিচিত জেএন ইসলাম বা জামাল নজরুলইসলাম শ্রেফ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে ফিরে না আসলে তিনি হয়তো নোবেল পুরস্কারে ভ’ষিত হতেন। এটা অনেক প্রাজ্ঞজনের ধারনা। এর কারণ হচ্ছে, প্রায় একই ক্যাটাগরির বিখ্যাত রচনাগুলো স্টিফেন হকিংয়ের আগেই জেএন ইসলাম লিখে প্রকাশ করেছিলেন। যা’ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যভুক্ত হয়েছিল।
স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে আমরা যা করছি তার চেয়ে অগ্রগণ্য পদার্থ বিজ্ঞানী জেএন ইসলামকে নিয়ে তার শতভাগের একভাগও করিনি। মূলত আমরা জামাল নজরুল ইসলামকে জানার বা বোঝার চেষ্টাও করিনি। স্টিফেন হকিংকে নিয়ে আমাদের অতি উৎসাহ অগ্রসর পাঠক ও আলোচকদের এ বিষয়ে একটি তুলনামূলক পর্যালোচনার সুযোগ এনে দিয়েছে। এই পর্যালোচনায় একটি বিষয় আবারো প্রতিভাত হয়েছে, আমরা নিজেদের সন্তান ও সম্পদ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে শিখিনি। যে জামাল নজরুল ইসলাম স্টিফেন হকিংয়ের চেয়েও বড় বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন, অসাধারণ দেশপ্রেমিক ছিলেন, যিনি স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পশ্চিমাবিশ্বে জনমত গঠনে অসামান্য অবদান রেখেছেন, যিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটা বেতনে গবেষনা ও অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যার্বন করেছিলেন বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার, শিক্ষা ও চেতনাকে এ দেশের নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। আমরা তাঁর অবদানকে মূল্যায়ণ করতে পারিনি। তিনি যদি অর্থবিত্তের মোহে আবদ্ধ থাকতেন, তাহলে তিনি বৃটেন ছেড়ে দেশে চলে আসতেন না। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে মাত্র ৩ হাজার টাকার বৃত্তি দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ করেছিল। সমসাময়িক বিশ্বে বিজ্ঞান শিক্ষার এত বড় দিকপাল সবদেশে ছিলনা, নেই। স্টিফেন হকিংয়ের সবচেয়ে কাছের সিনিয়র সহকর্মী, চন্দ্রশেখর সুব্রামনিয়াম, প্রফেসর আব্দুস সালাম, অমর্ত্য সেনের মত নোবেল বিজয়ী মনীষীদের কাছেও তিনি অনেক সম্মানজনক উচ্চ আসন লাভ করেছেন। আমাদের সরকার এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন এসব ব্যক্তিত্বকে দাওয়াত করে আনা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে প্রথমেই প্রফেসর জেএন ইসলামের খোঁজ নিয়েছেন। পশ্চিমা বিশ্বের বিজ্ঞানশিক্ষা ও একাডেমিসিয়ানদের মধ্যে প্রফেসর জেএন ইসলামের অবস্থান কোথায় আমাদের সরকারী আমলাদের যেন সে সম্পর্কে তেমন কোন ধারনাই ছিলনা। তা না হলে তারা নোবেল বিজয়ীদের পাশে জামাল নজরুলইসলামকেও বসানোর ব্যবস্থা করতেন। অগত্যা প্রফেসর আব্দুস সালাম বা অমর্ত্য সেনের মত নোবেন বিজয়ীরা বাংলাদেশে আমন্ত্রিত হয়ে আসার পর নিজেরাই প্রফেসর জেএন ইসলামের খোঁজ করে তাঁর সাথে দেখা করতে চট্টগ্রামে ছুটে গেছেন। পশ্চিমাবিশ্বে এক বিষ্ময়কর প্রতিভা হিসেবে স্বীকৃত সেই জামাল নজরুল ইসলাম ২০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করার পর দেশের গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও একাডেমিসিয়ানদের কাছ থেকে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। আমাদের গণমাধ্যমে জামাল নজরুল ইসলামের মৃত্যু তেমন কোন তাৎপর্যপূণ ঘটনা হিসেবে ধরা পড়েনি, অথচ স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যু আমাদের কাছে অনেক বড় ঘটনা হিসেবে মনে হয়েছে। বিজ্ঞান আর কল্পবিজ্ঞান এক কথা নয়। যে সব গ্রন্থ স্টিফেন হকিংকে বিশ্বময় খ্যাতি ও প্রতিপত্তি দিয়েছিল সে সব গ্রন্থকে জনপ্রিয় সাহিত্য হিসেবে সাধারণ পাঠকের কাছে তুলে ধরার কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায়না। তবে হকিংয়ের আগেই মহাকাশ বিজ্ঞান ও সৃষ্টিত্বত্ত সম্পর্কিত(কৃষ্ণ গহ্বর ও প্রসারমান বিশ্ব) মৌলিক গ্রন্থগুলোর লেখক জেএন ইসলাম। স্টিফেন হকিং এবং জেএন ইসলামের মধ্যকার সম্পর্ক, কর্মক্ষেত্রে তাদের তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের হুজুগেপণা এবং আত্মপ্রবঞ্চনার খতিয়ানই বেরিয়ে আসে।
বিজ্ঞান গবেষনায় স্টিফেন হকিংয়ের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার শুরু সম্ভবত তার পিএইচডি গবেষনাপত্রের শিরোনাম থেকে। হকিংয়ের থিসিস, ‘প্রোপার্টিজ অব এক্সপান্ডিং ইউনিভার্স’ ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে লাখ লাখ মানুষ তা পড়েছিল বলে জানা যায়। সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের ধারণা আধুনিক বিজ্ঞানে একটি নতুন আবিষ্কার হলেও সাড়ে ১৪০০ বছর আগে পবিত্র কোরআনের বেশ কিছু আয়াতে সম্প্রসারণশীল বিশ্বের কথা বলা হয়েছে। যে সত্য আবিস্কার করতে আধুনিক বিজ্ঞানের মহাকাশ গবেষকদের বিংশ শতাব্দীর শেষাবধি অপেক্ষা করতে হল সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের সেই ধারনা মহাগ্রন্থ আল কোরহানে দেড়হাজার বছর আগেই উৎকীর্ণ ছিল! এ বিষ্ময়কর ঘটনাকি হকিংয়ের মত বিজ্ঞানীদের কোরআনের প্রতি অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট ছিলনা? তিনি কোরআন পড়েছিলেন কিনা জানা না গেলেও আধুনিক বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রের গবেষনায় কোরআনের সুত্র পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের অনেককেই বিষ্ময়াবিভুত করেছে। এ ক্ষেত্রে মানব ভ্রণ ও মানবদেহ গঠনের ধারাবাহিক অবস্থার বর্ণনা অন্যতম। মিশরীয় মমি নিয়ে গবেষনা করতে গিয়ে ফরাসী সার্জন-গবেষক প্রফেসর মরিস বুকাইলি কোরআনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর লেখা ‘বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান’ অর্ধশতাধিক ভাষায় অনুদিত হয়ে কোটি পাঠকের হৃদয় জয় করা গ্রন্থ। মহাবিশ্বের প্রসারমানতা নিয়ে কোরানিক ডিসকোর্স মহাকাশ বিজ্ঞানীদেরও সমানভাবে আলোড়িত করার কথা। এ ক্ষেত্রে ড. মরিস বুকাইলির অভিজ্ঞতা ছিল এমন, তিনি যখন ফেরাউনের মমির গবেষনা করে দেখতে পেলেন, হাজার হাজার বছর আগে সমুদ্রে ডুবে যাওয়া একজন মানুষের লাশ এটি। আর ফেরাউনের পানিতে ডুবে মরা এবং তার লাশ অক্ষত রাখার কথা কোরআনে উল্লেখিত দেখে তার মধ্যে যে বিষ্ময় জেগেছিল, তিনি তা সবাইকে জানাতে চাইলে তাঁর সহকর্মীরা এ বিষয়ে কাউকে কিছু না বলতে তাকে অনুরোধ করেছিলেন। অর্থাৎ ধর্মীয় কারণে একটি সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার প্রয়াস বিজ্ঞান গবেষকদের মধ্যেও দেখা গেল। একে কি সত্যবাদিতা বলা যায়? বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার যদি কোরআনের বর্ণনার সাথে মিলে যায় তাতে কি বিজ্ঞান বা কোরআনের ক্ষতিবৃদ্ধি হয়? আমাদের দেশেই শুধু নয়, সারাবিশ্বেই বিজ্ঞান চেতনা যেন ধর্মচেতনা ও আধ্যাত্মবাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষত: ইসলাম ও মুসলমানের ক্ষেত্রে এটা যেন অনেক বেশী বাস্তব। এ কারণেই মৃত্যুর পর স্টিফেন হকিং বিশ্ব গণমাধ্যমে যেভাবে প্রক্ষেপিত হল, তার সমকক্ষ অথবা তারচেয়েও বহুমাত্রিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেও বাংলাদেশি মুসলমান বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের বেলায় তার কিয়দংশও জোটেনি। প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামকে নিয়ে কবি ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহারের একটি লেখা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে জামাল নজরুল ইসলামের মত বিশ্ববরেণ্য গবেষক ও বিজ্ঞানী কে আমরা যর্থাথ সম্মান ও মূল্যায়ন করতে না পারার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘বিজ্ঞানীর যোগ্য সামাজিক সম্মান আমরা দিতে জানিনা, তাঁদেরকে ঘিরে আমাদের কোন সামাজিক সংঘ নাই, চিন্তার আদান প্রদানের ক্ষেত্রে কোন সাধারণ পাটাতন নাই। ফলে, জ্ঞানবিজ্ঞানের আউলিয়া হয়ে তাঁরা নির্জন সাধনায় একা একা রত থেকেছেন’। আমাদের মত অনগ্রসর সমাজেও জামাল নজরুল ইসলামের মত পথিকৃত বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছিল পশ্চিমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ছায়ায়। তিনি যখনই পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে নিজভ’মে আস্তানা গেড়েছেন তখনই তাকে একা হয়ে যেতে হয়েছিল। আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর মত প্রতিভার পাশে দাঁড়াতে পারেনি।
বিজ্ঞানে কাকতালীয় বিষয়ের কোন ব্যখ্যা নেই। স্টিফেন হকিংয়ের জন্ম ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারী। এর তিনশ’ বছর আগে ১৬৪২ সালের ৮ জানুয়ারী পাপাল যুগের বিজ্ঞানী গ্যালিলিও’র মৃত্যু হয়েছিল। আর ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ আইনস্টাইনের জন্ম হয়েছিল, ২০১৮ সালে ১৪ই মার্চ স্টিফেন হকিং মৃত্যুবরণ করলেন। কালজয়ী বিজ্ঞানীদের জন্ম-মৃত্যু তারিখের এমন পালাবদলকে পর্দাথবিজ্ঞান বা গাণিতিক হিসাবের কোন সঙ্গত ব্যাখা আছে কিনা জানিনা। তবে মানুষের ইমোশন ও ভাবাবেগের মূল্য বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় না হলেও বিজ্ঞানীরা কখনো কখনো একই সঙ্গে কবি ও রাজনীতিকের ভ’মিকা পালন করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে আমরা আইনস্টাইনকে টেনে আনতে পারি। আইনস্টাইন বলেছেন, মানুষের জন্য ‘ইমাজিনেশন ইজ মোর ইম্পর্ট্যান্ট দ্যান নলেজ’। কথাটা যেন কোন পদার্থ বিজ্ঞানীর নয়, কবির। ইঙ্গ-মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হতে আইনস্টাইনকে আহ্বান করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মোটর নিউরণ ডিজিজে আক্রান্ত, অসাড় স্টিফেন হকিংকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সমসাময়িক বিশ্বের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টে মতামত দিতে দেখা গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর হকিং আমেরিকার সামাজিক-রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে চরম হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি ট্রাম্পের হাত ধরে বিশ্ব এক বিপজ্জনক ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে আন্তর্জাতিক কনভেনশন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনায় চরম হতাশা প্রকাশ করেছিলেন হকিং। সমাসাময়িক ও ভবিষ্যত বিশ্বের রাজনীতি, পারমানবিক যুদ্ধাস্ত্র, অর্থনীতি, জলবায়ু , প্রযুক্তি ও পরিবেশগত ঝুঁকি সম্পর্কে ৬ দশক আগে আইনস্টাইন যেমন বিশ্বের সামনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা বানী উচ্চারণ করেছিলেন। নিজের শারিরীক অক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় স্টিফেন হকিংও একই ধরনের ভ’মিকা পালন করে গেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে বিজ্ঞান গবেষক ও অ্যাকাডেমিসিয়ানদের ভ’মিকা প্রত্যক্ষ করলে হতাশ হতে হয়। এখানে দ্বিমেরুকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে আর কিছুই লক্ষ্যনীয় নয়। একশ্রেনীর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখকই এখন দেশের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান গবেষক, চেতনাবাজ বুদ্ধিজীবী এবং ডগমাটিক থিঙ্কট্যাংক। তারা পশ্চিমাদের আবিষ্কৃত ব্যবহারিক প্রযুক্তিকেই বিজ্ঞানের জয়জয়কার হিসেবে দেখাতে চায়। শিক্ষাব্যবস্থায় ভেজাল, রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা, অর্থনীতিতে সীমাহীন লুণ্ঠন, নদনদীর পানির উপর ভারতীয় নিয়ন্ত্রণের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয়ের মত ইস্যুগুলো তাদের কাছে যেন কোন ব্যাপারই না। অতএব আমাদের নতুন প্রজন্মকে আগামী দিনের প্রত্যাশিত পরিবর্তন ও সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে দিক নির্দেশনার জন্য দেশীয় রথি-মহারথিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষণায় উঠে আসা বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এ প্রসঙ্গে স্টিফেন হকিংয়ের কয়েকটি ভবিষ্যদ্বানী পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। হকিংয়ের মৃত্যুর পর কেম্ব্রিজ নিউজ অনলাইনে প্রকাশিত প্রধান পাঁচটি ভবিষ্যদ্বানীর মধ্যে রয়েছে, বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুত ও জ্বালানী উৎপাদন ও ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে আগামী কয়েক শ বছরের মধ্যে পৃথিবী কার্যত একটি আগুনের গোলায় পরিনত হবে। চুড়ান্ত পরিনতি হিসেবে একসময় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। সময়সীমা হিসেবে তিনি ২৬০০ সালের মধ্যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। দ্বিতীয়ত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবটের কাছে মানুষের পরাজয় ঘটার আশঙ্কা একসময় সভ্যতার জন্য ধ্বংসাত্মক পরিনতি ডেকে আনতে পারে। তৃতীয়ত, পারমানবিক বোমা তৈরীর মধ্য দিয়ে মানুষ পৃথিবী ধ্বংসের প্রযুক্তি ও মারনাস্ত্র তৈরী করতে সক্ষম হলেও বিশ্ব ও মানব জাতিকে রক্ষার কোন বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারেনি। যেহেতু মানুষের লোভ, হানাহানি ও যুদ্ধোন্মাদনা বেড়ে চলেছে, এ ধরনের বিপদ থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করতে বিকল্প প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি অন্যগ্রহে কলোনি তৈরীর কথা বলেছেন হকিং। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং জলবায়ু ও পরিবেশগত বিপর্যয় সম্পর্কে হকিংয়ের ভবিষ্যদ্বানী যথেষ্ট উদ্বেগজনক। তবে তিনি এ ধরনের বিপদ থেকে বিশ্বকে রক্ষায় আরো কার্যকর ও সম্মিলিত উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। মহাবিশ্ব ও পৃথিবীর জন্ম ও চুড়ান্ত পরিনতি, মানবসভ্যতা ও মানবপ্রজাতির ভবিষ্যত সম্পর্কে স্টিফেন হকিংয়ের হকিংয়ের মন্তব্যগুলোর সাথে তার সহকর্মী ও অন্যান্যদের তেমন কোন দ্বিমত দেখা যায়নি। এসব বাস্তবতা সামনে রেখে বিশ্বসম্প্রদায়ের ভ’মিকা বিশ্বের ভবিষ্যত পুন:নির্ধারণ করবে। তবে ১৯৬২ সালে দূরারোগ্য এএলএস রোগ ধরা পড়ার মাত্র দুই বছর বেঁচে থাকার কথা ছিল স্টিফেন হকিংয়ের। এরপর ৫২ বছর ধরে সৃষ্টিশীল মেধা নিয়ে বেঁচে থেকে স্টিফেন হকিং বিশ্বের সামনে জীবনের এক ভিন্নতর প্রগাঢ় অর্থময়তা প্রমান করে গেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান যা ব্যাখ্যা করতে পারেনা। আইনস্টান থেকে হাইজেনবার্গ এবং স্টিফেন হকিং সকলেই পদার্থবিজ্ঞানের আনসার্টেনটি প্রিন্সিপাল বা অনিশ্চয়তা নীতির কথা বলেছেন। এ অনিশ্চয়তাবাদ মানুষের বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, মহাবিশ্বে এক পরমসত্তা ও মহাবিজ্ঞানীর অস্তিত্বকেই নির্দেশ করে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিজ্ঞানী


আরও
আরও পড়ুন