পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। এই কাতারে উঠতে যে তিনটি শর্ত রয়েছে, সেই তিন শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। এরই স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। গড় মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, একই সঙ্গে এই তিন শর্তের সবই পূরণ করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের হিসাবে একটি দেশ তখনই উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে পারে যখন তার গড় মাথাপিছু আয় ১২৩০ ডলার বা তার ঊর্ধ্বে উঠবে, মানব সম্পদ উন্নয়নের সূচক ৬৬ বা তার ঊর্ধ্বে হবে এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচক ৩২ বা এর নীচে হবে। এই তিন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ১২৭২ ডলার, ৭২.৮ এবং ২৫। উল্লেখের অপেক্ষা রাখেনা, বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন ও তার স্বীকৃতি নি:সন্দেহে একটি সুখবর। কাগুজে হলেও এ অর্জন ও স্বীকৃতি অনুপ্রেরণাদায়ক। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ও সক্ষমতা তার রয়েছে, এটা তার পরিচয় বহন করে। আগামী ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। সামনের এই বছরগুলো তার জন্য তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট সূচকগুলোর উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা তাকে রক্ষা করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতে এটা খুবই চ্যালেঞ্জিং। উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে দেশের মানুষের কাছে দৃশ্যমান ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। এর সুফল যেটুকু পাওয়ার কথা তা যেন মানুষ পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যবেক্ষণে দেখা যাবে, উন্নয়নের কোনো সূচকই ইতিবাচক অবস্থানে নেই। সরকারের তরফে বড় বড় মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পগুলো দেখিয়ে বলা হচ্ছে, দেশ উন্নত হচ্ছে, উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এইসব প্রকল্প বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় অর্থের বড় অংশটিই বেরিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়ন ও জীবনমান বৃদ্ধিতে অর্থের যোগান মোটেই উল্লেখযোগ্য ও যথেষ্ট নয়। দেশের তাবৎ মানুষ, বিশেষিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যাকে বলা হয় উন্নয়নের মূলশক্তি, দিনে দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত যুবকদের অধিকাংশের আয় নেই, উপার্জন নেই, নেই কোনো ভবিষ্যত।। বেকারত্ব তাদের সম্ভবনাকে নি:শেষ করে দিচ্ছে। তারা হয়ে পড়ছে নিরাবলম্ব। উন্নয়ন যদি গণমানুষের কোনো কাজে না আসে, তারা যদি তার সুফলভোগী হতে না পারে তবে সেই উন্নয়নের কোনো অর্থ নেই। অনেকেরই জানা, দেশের সম্পদের প্রায় ৯০ শতাংশের মালিক ১০ শতাংশ মানুষ। আর ১০ শতাংশ সম্পদ আছে ৯০ শতাংশ মানুষের হাতে। উন্নতি হলে ১০ শতাংশ ‘ভাগ্যবান’ মানুষেরই হচ্ছে। অবশিষ্ট ৯০ শতাংশ মানুষ থেকে যাচ্ছে বঞ্চিত। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমাগত বাড়ছে। মানুষের সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নই আসলে উন্নয়ন, যার অনুপস্থিতি প্রকটভাবে দৃশ্যমান।
উন্নয়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন। বিভিন্ন উৎস থেকে এই অর্থের যোগান আসে। দেখা যাচ্ছে, প্রায় সকল উৎসই এখন নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। বিনিয়োগে দীর্ঘদিন ধরে খরা চলছে। কি বেসরকারী বিনিয়োগ, কি বিদেশিক বিনিয়োগ-কোনো ক্ষেত্রেই সুখবর নেই। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই নাজুক অবস্থা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিনিয়োগ শিল্পায়ন, রফতানি, কর্মসংস্থান ও মানুষের জীবনমান ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদির জন্য অপরিহার্য। বিনিয়োগবঞ্চিত দেশে কার্যকর ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে ব্যাংকিং সেক্টরের শোচনীয় দশার কথাও উল্লেখ করতে হয়। এক সময় ব্যাংকিং সেক্টরে উদ্বৃত্ত তারল্যের পাহাড় জমে উঠেছিল। এখন সেই পাহাড়ে এমন ধসই নেমেছে যে, ব্যাংকগুলো তাদের দৈনন্দিন লেনদেন চালাতেই হিমসিম খাচ্ছে। ব্যাংকিং সেক্টরে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ নেই। তাহলে বিনিয়োগ হবে কিভাবে? ওদিকে রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির টান দেখা দিয়েছে। রেমিট্যান্সও আর আগের মতো আসছে না। রাজস্বখাতে আয়লক্ষ্য অনর্জিত থেকে যাচ্ছে। এমতাবস্থায়, উন্নয়নচাহিদা পূরণে বর্ধিত অর্থ কোথা থেকে আসবে? বাণিজ্যে ঘাটতি বা ভারসাম্যহীনতা এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশী। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। রফতানি থেকে এসেছে দুই হাজার ১০৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আর আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ১১৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ নিয়ে অতীতে অনেক গর্ব করা হয়েছে। অথচ এখন সেই বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি অনেক কমে গেছে। দেশের মানুষ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খুবই বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্য রয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বহন সাধারণ মানুষের সক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এক খবরে জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ঢাকা সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর। গ্রামের ক্ষেত্রেও সম্ভবত একথা সমনভাবে প্রযোজ্য। অন্য এক খবরে জানা গেছে, সুখী দেশের তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আরও নেমে ১১৫- তে দাঁড়িয়েছে। বলা বাহুল্য, কাগজ-কলমে দেশের উন্নয়ন অনেক হয়েছে। বাস্তবে উন্নয়ন কতটা হয়েছে এসব তথ্য-উপাত্ত থেকেই তা উপলব্ধি করা যায়।
বিদ্যমান পরিস্থিতির এই প্রেক্ষাপটে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ কবে নাগাদ যেতে পারবে তা নিয়ে সংশায়িত হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। জাতিসংঘের স্বীকৃতিতে উল্লসিত ও তুষ্ট হওয়ার তাই যেমন সুযোগ নেই। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে সম্ভাবনা কিছু বাড়বে, এমন কথা অর্থনীতিবিদরা বলেছেন। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়বে বাংলাদেশের। মর্যাদা বাড়বে। পাশাপাশি বিনিয়োগ সম্ভাবনাও বাড়বে। তবে বিনিয়োগ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে হবে। অন্যদিকে এই উত্তরণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় রকমের ধাক্কাও লাগবে। যেমন, রফতানি আয় কমে যেতে পারে, রেমিট্যান্সপ্রাপ্তি কমে যেতে পারে, বৈদেশিক অনুদান ও ঋণ কমে যেতে পারে, সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে কম সুদে ঋণ পাওয়ার সুযোগ। স্বপ্নোন্নত দেশ হওয়ার কারণে যে বিশেষ সুবিধাগুলো বাংলাদেশ এখন পায়, তা আর পাবে না। নি:সন্দেহে এগুলো দেশের জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকা উচিৎ ছিল, যা এখনো প্রণীত হয়নি। তারা মনে করেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করতে হবে, মানব সম্পদের উন্নয়ন সাধন করতে হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধন করতে হবে, অবকাঠামোসহ বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে হবে, সর্বোপরি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার এসব দিক সামনে রেখে একটি যথোপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা দ্রুত প্রণয়ন করবে, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।